রেকর্ড করলেন ব্যোমকেশ।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর ৪৩ বছর পরে। একটা নয়, দু’টো নয়, ৩২-টি ব্যোমকেশ বক্সী গল্পের স্বত্ব কিনছেন ‘সাংহাই’, ‘ওয়ে লাকি লাকি ওয়ে’-এর পরিচালক দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়। স্বত্ব কিনে বাংলা ছাড়া অন্য যে কোনও ভাষায় ব্যোমকেশ বক্সির গল্প অবলম্বনে কোনও ছবি বানানোর একমাত্র অধিকার এখন দিবাকরের। সুশান্ত সিংহ রাজপুতকে নিয়ে শুরু করবেন তাঁর প্রথম ব্যোমকেশ চলচ্চিত্র। তার পর ক্রমশ প্রকাশ্য।
সাহিত্য-নির্ভর ছবি এর আগেও হয়েছে। তবে কোনও ভারতীয় লেখক বা পরিচালকের ক্ষেত্রে এটা শোনা যায়নি। তাহলে কি ব্যোমকেশের জন্য উচ্ছ্বাসটা এখন তুঙ্গে?
কেন এই ঝুড়ি ঝুড়ি ব্যোমকেশ বক্সীর গল্প কেনার আগ্রহ দিবাকরের? প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান: “ব্যোমকেশ করাটা আমার স্বপ্ন। অন্য কয়েকটা বাংলা গল্প নিয়েও সিনেমা করার ইচ্ছে ছিল। তবে শরদিন্দুর গল্পগুলো যত বার পড়েছি, ইচ্ছে হয়েছে ব্যোমকেশকে বের করে হিন্দি ছবির দশর্ককে দেখাতে। আর এটা করার কথা ভাবতেই মনে হয়েছে যে আমি যদি এ রকম ভাবে ব্যোমকেশ বানাই, আর তার পর যদি অন্য কোনও পরিচালক আর এক রকম ভাবে অন্য একটা ব্যোমকেশ বানান, তাতে তামাম ভারতীয় দর্শক বিভ্রান্ত হতে পারেন।” |
আর সেটা যাতে না হয় তাই দিবাকর ঠিক করেন যে, প্রত্যেকটি ব্যোমকেশের গল্পের স্বত্ব তিনি কিনে নেবেন। যাতে হিন্দি বা বাংলা ছাড়া অন্য কোনও আঞ্চলিক ভাষায় ব্যোমকেশ ডাব করে বানানোর স্বত্বটা তাঁর কাছেই থাকে।
বিদেশে যে কোনও বড় ফ্র্যাঞ্চাইজি দিয়ে ছবি বানাতে গেলেও ঠিক একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। “ওয়ার্নার ব্রাদার্স যখন ‘ব্যাটম্যান’-এর ফ্র্যাঞ্চাইজি করবে ঠিক করে, তখন ‘ব্যাটম্যান’ সংক্রান্ত সব কিছুর স্বত্ব তারা কিনে নেন। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ব্যোমকেশকে নিয়ে আমি সেটাই করতে চাই,” বলছেন দিবাকর। তবে বাংলার কোনও স্বত্বই তিনি নেননি। কারণ? ‘‘আমি জানি বাঙালিদের একটা নিজস্ব অধিকারবোধ আছে ব্যোমকেশের ওপর। তাঁরা বাংলা ভাষায় ব্যোমকেশ দেখতে চান। আমি বাংলায় ব্যোমকেশ বানাচ্ছি না,’’ পরিচালক জানান।
কিন্তু এই এতগুলো স্বত্ব কিনে ছবি/সিরিয়াল বানানোর মতো কি ব্যোমকেশ-এর মার্কেট তৈরি হয়েছে? যশরাজ ফিল্মস আর দিবাকর ইতিমধ্যেই ব্যোমকেশকে আন্তর্জাতিক দর্শকের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করছেন। দিবাকর মনে করছেন, ব্যোমকেশ যদি ঠিক ভাবে বানানো হয়, তা হলে সেটা শার্লক হোমস-এর ছবির মতোই জনপ্রিয় হতে পারে। তার কারণ শরদিন্দুর প্লট, চরিত্র, পটভূমি আর আবহের আবেদন। রয়েছে সাহিত্য রস, রোম্যান্স, উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর নানা ঘাত-প্রতিঘাত। সেই ১৯৩৩ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত ব্যোমকেশ কাহিনি প্রকাশিত হয়েছিল। এত বছরের ব্যবধানে ব্যোমকেশের স্টাইলটা পালটে গিয়েছে। সেই কারণে নতুন যুগের পাঠকের কাছেও গল্পগুলোর আকর্ষণ তৈরি হয়েছে। এদের সবাই বড় পরদাতে ব্যোমকেশ দেখতে আগ্রহী হবেন।
পরিচালক বাসু চট্টোপাধ্যায় ব্যোমকেশ বক্সী-কে নিয়ে টেলিভিশনে সিরিজ বানিয়েছিলেন। ব্যোমকেশের চরিত্রে রজিত কপূর। সুশান্ত সিংহ রাজপুতেরও ব্যোমকেশ অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল ওই সিরিজের মাধ্যমেই। আন্তর্জাতিক দর্শকের কি ব্যোমকেশকে ভাল লাগতে পারে? বাসু বলেন, ‘‘কেন নয়? আমি তো ব্যোমকেশের প্রতিটি গল্প থেকেই এপিসোড বানিয়েছিলাম। ভাল করে বানালে ব্যোমকেশ নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক দর্শককে টানতে পারবে।”
পরিচালক অঞ্জন দত্ত তিনটি ব্যোমকেশ বানিয়েছেন। আরও তিনটি গল্পের স্বত্ব কেনা রয়েছে তাঁর। বাংলা সাহিত্যে তো গোয়েন্দা কিছু কম নেই। ‘ফেলুদা’ না হয় সন্দীপ রায় বানাচ্ছেন। ‘কাকাবাবু’ নিয়ে সৃজিত এখন ব্যস্ত। কিন্তু বাকিরা? পাঁচকড়ি দে’র লেখা গল্পের মুখ্য চরিত্র ছিলেন ডিটেকটিভ দেবেন্দ্র বিজয় মিত্র আর অরিন্দম বসু। এ ছাড়াও ছিল দীনেন্দ্র কুমার রায়ের লেখা ‘রবার্ট ব্লেক’-এর গোয়েন্দা গল্প।
এ ছাড়াও রয়েছে হেমন্ত কুমার রায়-এর সৃষ্ট তিনটে সেটের ডিটেকটিভ জয়ন্ত-মানিক-সুন্দরবাবু গ্রুপ, হেমন্ত-রবীন গ্রুপ আর ইন্সপেক্টর সতীশ। প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর লেখা মহিলা ডিটেকটিভ কৃষ্ণা, স্বপন কুমারের দীপক চট্টোপাধ্যায় আর শশধর দত্ত-র ‘মোহন’ সিরিজের কথাও উঠে আসে বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দা গল্পের কথা বলতে গিয়ে। আর আছে নীহার রঞ্জন গুপ্তর ‘কিরীটী’। ফর্সা, সাড়ে ছ’ফুট লম্বা এক ডিটেকটিভ। ব্যাকব্রাশ করা কোঁকড়া চুল আর কালো চশমা কিরীটী দেখতেও মন্দ ছিলেন না।
তবু কেন এই সব চরিত্রের প্রতি জাতীয় স্তরে কোনও ক্রেজ তৈরি হয়নি? দিবাকরকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন যে, ব্যোমকেশের প্রতি তিনি বায়াসড্। তাই অন্য কোনও ডিটেকটিভকে নিয়ে ছবি করার কথা তিনি ভাবেননি। আবির চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করেছেন ব্যোমকেশের ভূমিকায়। এর পর আবার তাঁকে দেখা যাবে ফেলুদার চরিত্রে। তাঁর মতে, “সাহিত্যের মানের দিক থেকেই হোক বা গোয়েন্দা গল্পের কথা গোগোল, অর্জুন বা কিরীটী- কেউ কিন্তু ফেলুদা বা ব্যোমকেশের মতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠেননি। ‘কাকাবাবু’ মূলত অ্যাডভেঞ্চার সিরিজ। ব্যোমকেশ লেখা প্রাপ্তবয়স্কদের নিয়ে। অনেক ক্ষেত্রে তিনি অপরাধীকে ধরার পরেও ছেড়ে দিয়েছিলেন। প্রেম করেছিলেন এমন একজনের সঙ্গে যিনি একটি কেস-এ অভিযুক্ত হতেও পারেন! এ রকম বৈচিত্র আর কোথায়?” প্রশ্ন আবিরের। |
প্রবীর চক্রবর্তী (যাঁর কাছ থেকে পরিচালকেরা শরদিন্দুর গল্পের স্বত্ব কিনে থাকেন) বলছেন যে, ব্যোমকেশের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। “এক একটা ব্যোমকেশ ছবি মুক্তি পেলে প্রত্যেকটা বইয়ের পুনর্মুদ্রণ করতে হয়। আজও বছরে ব্যোমকেশের জন্য অনেক রয়্যালটি আসে! ঋতুপর্ণ তো ব্যোমকেশ নিয়ে পাগল ছিল। মন দিয়ে ‘চোরাবালি’-র শ্যুটিং করল,” বলছেন প্রবীর। আরও বলছেন, “বাসুদা একটা সিরিয়াল করেই দেখিয়ে দিয়েছেন ব্যোমকেশের জাতীয় জনপ্রিয়তা। শুধু হিন্দি নয়, গুজরাতি এমনকী মরাঠি সিরিয়াল আর ছবি বানানোর জন্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।”
আরও যেটা পরিচালকদের আকর্ষণ করে থাকে, তা হল ব্যোমকেশ লেখার স্টাইল। শরদিন্দু ১৯৩৮ সালে ব্যোমকেশ লেখা ছেড়ে মুম্বই গিয়েছিলেন। ওখানে চিত্রনাট্য লিখতেন তিনি। “পরিচালকরা বলেন ব্যোমকেশ পড়লে যেন ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। স্ক্রিপ্টটা নাকি আর আলাদা করে লিখতে হয় না,” বলছেন প্রবীর।
ব্যোমকেশের স্বত্ব যে ভাবে বাংলার বাইরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তাতে খুব স্বাভাবিক ভাবেই হয়তো সত্যান্বেষীর জনপ্রিয়তা বাংলার বাইরে ছড়িয়ে পড়বে। সেখানে জনপ্রিয়তার দৌড়ে কি ব্যোমকেশ পেছনে ফেলে দেবে ফেলুদা-কে? এর উত্তরে সন্দীপ রায় বলছেন, “এটা খুব আনন্দের খবর যে, দিবাকর এত নিষ্ঠার সঙ্গে হিন্দিতে ব্যোমকেশ বানাচ্ছে। কিন্তু যতক্ষণ না ছবিটা বানানো হচ্ছে, তার জনপ্রিয়তা সম্পর্কে আগাম কিছু বলা সম্ভব নয়। আজ পর্যন্ত ফেলুদার হিন্দি স্বত্ব কেনার জন্য কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। অন্য ভাষায় ফেলুদা হলে আমার তাতে আপত্তি কেন থাকবে?”
সামনের বছর মুক্তি পেতে চলেছে অঞ্জন দত্ত-র তৃতীয় ব্যোমকেশ। “অন্যান্য গোয়েন্দা গল্পের থেকে ব্যোমকেশ আলাদা। সন্দীপ ফেলুদা করছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু নিয়ে তপন সিংহ ছবি করলেও কাকাবাবু কোনও দিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। অর্জুন, কিরীটী এদের সবার থেকে ব্যোমকেশ আলাদা,’’ বলছেন অঞ্জন।
আরও বলছেন যে, ব্যোমকেশের বিশেষ আকর্ষণ হল কলকাতা। অঞ্জনের মতে, “ব্যোমকেশের গল্পে এথনিসিটিটা খুব স্ট্রং। সেটা যদি ঠিক ভাবে সিনেমাতে ব্যবহার করা যায়, তা হলে বিদেশি দর্শক সেটা দেখতে আগ্রহী হবেন।”
আর এটা কী ভাবে ঠিক করা সম্ভব, সে বিষয়ে দিবাকরও বেশ সতর্ক। প্রথম যখন সুশান্তকে তিনি তাঁর স্ক্রিপ্টটা পড়িয়ে শোনান, অভিনেতা প্রায় এক ঘণ্টা কথা বলতে পারেননি। দিবাকর বলেন, “পরে সুশান্ত বলে, মাথা থেকে গল্পটা কিছুতেই বের করতে পারছে না। তার পর জিজ্ঞেস করে যে, ব্যোমকেশের চরিত্রে বাঙালিয়ানা কতটা থাকবে। হিন্দিটা কি তাঁকে বলতে হবে একটু বাঙালিদের মতো করে? আমি বলি একদম না। আমার ব্যোমকেশ ছবিতে খোলতাই হিন্দি বলবে। যাতে একটা সময়ের পর দর্শকের কাছে ভাষার বিভেদটা কেটে যায়। ব্যোমকেশের প্রত্যেকটি গল্পে তাঁর চরিত্রের এক একটি দিক পরিস্ফুট হয়েছে। আমি চাই বিভিন্ন গল্প থেকে কিছু জিনিস ওভারল্যাপ করে তার পর চিত্রনাট্য তৈরি করতে।”
দিবাকরের ব্যোমকেশ সম্পর্কে আবিরও উদ্গ্রীব। “শার্লক হোমসকে কত রকম ভাবে বানানো হয়েছে! ব্যোমকেশ একটা পিরিয়ড পিস। তাই চ্যালেঞ্জটা মারাত্মক। মনে হয় না দিবাকর ব্যোমকেশের সময়টা পালটে দেবেন। ব্যোমকেশের হাতে সেলফোন থাকবে না নিশ্চয়ই! কিন্তু জাতীয় বা আন্তর্জাতিক দর্শক ব্যোমকেশ আর সেই সময়ের কলকাতার সঙ্গে অপরিচিত। আমি জানতে আগ্রহী, সেই সব দর্শককে দিবাকর কী ভাবে ব্যোমকেশের প্রতি কৌতূহলী করে তুলবেন।” |