|
|
|
|
বুম্বার আত্মজীবনী |
আসলে তাঁর নতুন সিনেমা। বই নয়। কিন্তু একেকটা শট দিতে গিয়ে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়
দেখে ফেলছিলেন দেবশ্রী রায়কে! কখনও বাবা বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে!
আত্মজৈবনিক সেই সব অভিজ্ঞতা বলে ফেললেন ইন্দ্রনীল রায়-কে |
এমন একটা ফিল্ম, যেখানে পরিচালক অ্যাকশন বললেই পুরনো ক্ষতগুলো থেকে আমার রক্ত ঝরা শুরু।
আমার তিরিশ বছরের কেরিয়ারে এরকম বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়নি। মনে হওয়া শুরু হল, আমার জীবনেরই অনেক মুহূর্ত যেন ফিরিয়ে দিয়ে গেল সিনেমা!
নতুন ছবি ‘পরিচয়’-য়ের শ্যুটিং করতে করতেই এ রকম কিছু অভিজ্ঞতা হল। জীবনের অনেক কিছুর সঙ্গে রিলেট করতে পারলাম ছবিটায়। সেগুলো আজ খুব আবেগতাড়িত হয়ে খোলামেলা বলে ফেলছি। কোনও দিন ভাবিনি এই বয়েসে এসে জীবনের পুরনো দরজাগুলো এমন ধাক্কা দিতে পারে যে, কিছুটা ভিতর থেকে শেয়ার করা ছাড়া সামলানোর উপায় নেই।
জীবনে অনেক কিছুই ধাঁধা থেকে গেল। ফিল্মটা করতে গিয়ে ফ্ল্যাশব্যাকের মতো ধাক্কা মারছিল।
চুমকি আর আমি
যেমন রিয়ালাইজ করলাম, আমি আজও বুঝিনি চুমকির (দেবশ্রী রায়) সঙ্গে বিয়েটা কেন ভেঙে গেল।
মনে আছে চুমকির সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পরে ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন্সের বাড়িতে একটা বছর আমি শুধু বসে কাটিয়েছিলাম। খালি মনে হত বাইরে বেরোলে লোকে যদি কিছু জিজ্ঞেস করে তখন আমি কী বলব? আই ওয়াজ ডিভাসটেটেড। ইট ওয়াজ এ ভেরি ইমোশনাল ব্রেক আপ। আমার যে গাড়ি চালায়, সেই প্রদীপের মা আমার জন্য খাবার পাঠাত। আমি ভাবিনি আমি কোনও দিন আবার উঠে দাঁড়াতে পারব। সেই সময়টা স্বপনদা (সাহা), রানা (অভিজিৎ গুহ) না থাকলে আমি হয়তো ঘুরে দাঁড়াতেই পারতাম না। ওরা আমাকে বোঝাত। আসলে আই ওয়াজ নট রেডি ফর ম্যারেজ। |
|
আমার জীবনে প্রচুর সম্পর্ক হয়েছে। সম্পর্ক ভেঙেছেও অনেক। ইন্ডাস্ট্রির বহু মানুষ আজকে তাদের সম্পর্কের নানা সমস্যার কথা আমায় এসে বলে। আমি শুনি। দাদার মতো অ্যাডভাইস দিই। তারা সেগুলো শোনেও।
কিন্তু একেক সময় মনে হয় দু’একজন ছাড়া আমাকে তো সম্পর্কের অ্যাডভাইস দেওয়ার জন্য কাউকে বিশেষ পাশে পাইনি। শুধু দেবশ্রী কেন, অপর্ণার সঙ্গে বিয়ের ক্ষেত্রেও আমি হ্যান্ডেল করতে পারিনি। অর্পিতা যে আমার সঙ্গে দশ বছর ঘর করছে তার পুরো ক্রেডিটটা কিন্তু ওর প্রাপ্য। আমার কোনও অবদান নেই।
আই অ্যাডমিট, আই অ্যাম অ্যা ভেরি ডিফিকাল্ট পার্সন টু বি উইথ। এটা বলছি না যে আমি মারামারি করি, কী আমি চরিত্রহীন লম্পট। কিন্তু আমার কাজ, কী আমার মাঝে মধ্যে নিজের চিন্তা নিয়ে থাকতে চাওয়ার মুহূর্তগুলোতে আমার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করাটা ডিফিকাল্ট।
আর তখন বয়সও কম ছিল, ধৈর্যও ছিল কম। তবে এত কিছু বলার পর বলছি, আমি আজকেও বুঝিনি চুমকির সঙ্গে বিয়েটা কেন ভাঙল। ওটা একটা ফেয়ারি টেল ছিল। ছোটবেলা থেকে সবাই বলত ‘তোরা বর বৌ হবি।’ আমিও পৃথ্বীরাজ চহ্বাণ হয়ে ঘোড়ায় চেপে বসলাম। আর তার পরেই সব যেন শেষ হয়ে গেল। কেন বিয়ে ভাঙল আজও উত্তর পেলাম না। অনেক চেষ্টা করেও পেলাম না।
আমার জীবনের গল্প
এরকমই একটা স্ক্রিপ্ট এসে পড়েছিল আমার কাছে প্রায় দু’বছর আগে। ছবির নাম ছিল ‘পরিচয়’, পরিচালক বাসু চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে রূপালি গুহ। স্ক্রিপ্টটা পড়লাম, দারুণ পছন্দ হল, ইংল্যান্ডের নিউ ক্যাসেলে গিয়ে শ্যুটিং করলাম। ছবিটা ২৬ জুলাই মুক্তি পাবে। কিন্তু মনের ভিতরে একটা ঝড় থেকেই গেল। কেন ঝড় উঠেছিল? কারণগুলো আজ আর না-বলে পারছি না। ‘পরিচয়’ ছবির গল্প একটি মেয়ে ও তার বাবার। আমি যে চরিত্রটা করছি, সে বহু দিন আগে পরিবার-মেয়েকে ছেড়ে চলে যায়। বহু বছর পর মেয়েটি তার বাবাকে জানতে, বাবাকে বুঝতে ফিরে আসে। ধীরে ধীরে দু’জন দু’জনকে আবিষ্কার করে। মেয়েটি বুঝতে পারে কেন তার বাবা এমন করেছিল, আমার চরিত্রও বুঝতে পারে ‘ইগো’ একটু কমিয়ে মানিয়ে নিলে হয়তো তাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হত না।
এই মেয়ে-বাবার ডিসকভারির গল্পটা কোথায় আমাকে আমার শৈশবে নিয়ে গিয়েছিল। খালি মনে হচ্ছিল, আরে এটা তো আমার নিজের গল্প। মনে হচ্ছিল, আমি এগুলো দেখেছি খুব অল্প বয়েস থেকে। এটা আমার ‘দেজা ভ্যু’ মোমেন্ট। তাই কিছু সম্পর্কের কথা আজকে বলতে ইচ্ছে করছে যা আমি কোনও দিন কোথাও বলিনি।
এই ফিল্মগুলো করার সময়ও কিন্তু মনে সাঙ্ঘাতিক চাপ পড়ে। ছবি শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও একটা রেশ থেকে যায়।
বাপির পারস্পেক্টিভ কি কোনও দিন শুনেছি
আমার বাবা বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়, তাঁর বাবার খুব ক্লোজ ছিলেন। খুব ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছিলেন বলেই বোধহয় ঠাকুরদা’র ওপর অদ্ভুত একটা টান ছিল বাপির। যে দিন ঠাকুরদা’ মারা গেলেন, মনে আছে, বাবা খুব ভেঙে পড়েছিলেন। মুখাগ্নি থেকে পুজো-আর্চা কিছুই করতে পারছিলেন না। বাবার পাশে দাঁড়িয়ে সব কাজ আমিই শেষ করেছিলাম। কিন্তু সেইটুকুই। তারপর ঠাকুরদা’র শ্রাদ্ধ হওয়ার পরপরই বাবা, আমাকে-মাকে-বোনকে ছেড়ে চলে গেলেন। সেই আমার সিঙ্গল পেরেন্টের কাছে বড় হওয়া শুরু। ওই শ্রাদ্ধটাই ছিল টার্নিং পয়েন্ট। কিন্তু আজকে, এই ম্যাচিওর্ড বয়েসে আমি কিছু কনফেশন করতে চাই আপনাদের সামনে। আমার জীবনে আমার মায়ের অবদান বিরাট, সেটা আমি বহু বার, বহু জায়গায় বলেছি। মা সংসার চালাতে মহুয়া রায় চৌধুরী, সন্ধ্যা রায়দের মতো নায়িকাদের শাড়ি বিক্রি করতেন, এটাও অনেকে জানেন।
কিন্তু আজ মনে হয়, বাবার ব্যাপারে যা শুনি, সেটা তো আমার মায়ের পারস্পেক্টিভ। বাপির পারস্পেক্টিভটা কি কোনও দিন শুনেছি? আজ বুঝি কোনও কোনও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে রাখতে দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। মনে হয় সব ছেড়েছুড়ে পালিয়ে যাই। বাপির হয়তো সে রকমই দমবন্ধ লাগত, তাই চলে গিয়েছিলেন আমাদের ছেড়ে। কিন্তু কেন ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, সেটা তো কোনও দিন সে ভাবে জানার চেষ্টা করিনি।
আজ অর্পিতা প্রায়ই একটা কথা বলে। ও বলে বাপির পারস্পেক্টিভটা আমার শোনা উচিত ছিল, তা হলে হয়তো আরও চিনতে পারতাম বাপিকে। আরও জানতে পারতাম বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে। |
|
বিয়েতে বাবার সঙ্গে প্রসেনজিৎ-অর্পিতা। |
বুঝতে পারতাম এ বার ঝগড়া করবে ওরা
চেষ্টা যে করিনি বাপির পারস্পেকটিভ শোনার তা কিন্তু নয়। আমার বোন মাকুর (পল্লবী চট্টোপাধ্যায়) বিয়ের আগে একটা ছোট চেষ্টা করেছিলাম বাপির কাছ থেকে জানতে কেন বাপি আমাদের ভাসিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল। সেই সময় আমার বয়সও খুব কম। একদম টিন-এজার। বাপির ওপর একটা স্বাভাবিক রাগ, অভিমান থেকেই প্রশ্নগুলো করেছিলাম। কিন্তু সেই রকম কোনও এক্সপ্ল্যানেশন পাইনি। পরে বুঝেছিলাম বাপি শুধু চলে যেতে চেয়েছিল, হয়তো আমাদের আর ফেস করতে চায়নি বাপি।
এটা বুঝেছিলাম বাপি তাঁর অন্য ফ্যামিলি নিয়ে খুব সুখে আছে। আর সত্যি তো, দাম্পত্য জীবনে রোজ ঝামেলা নিয়ে বেঁচে থাকা কী কষ্টকর সেটা তো আমি জানি। মনে আছে বাপি আর মায়ের ঝগড়া হলে তারা আমাদের বলত, “যাও অন্য ঘরে চলে যাও।” বুঝতে পারতাম আবার ঝগড়া করবে ওরা। দিনের পর দিন এগুলো দেখেছি।
তাই পরে যখন বুঝলাম বাপি সুখে আছে, তখন মনকে বোঝালাম। কিন্তু স্বাভাবিক একটা রাগ-দুঃখ কি অত সহজে চলে যায়?
এতটা ইগো আমার রাখা উচিত হয়নি
অনেক কথাই আজকে মনে পড়ছে। মায়ের শ্রাদ্ধ হল, বাবা কিন্তু এল না। মাকুর বিয়ে হল, কিন্তু কোথায় বাপি? একবারও এল না। ভীষণ রাগ হয়েছিল তখন। তাই যখন আমার ছেলে মিশুক হল, আমি নিজের ইগোর জন্য আর বাপিকে বলিনি। ওটা আমার অনেক দিনের রাগ বলতে পারেন। আমার জেদ বলতে পারেন।
ইচ্ছে করেনি বাপিকে ডাকতে বা বলতে। তবে আজকে বুঝি আমি ভুল করেছিলাম। এত ইগো আমার রাখা উচিত হয়নি। আমার বাপিকে বলা উচিত ছিল। মাঝখানে অর্পিতার সঙ্গে বিয়ের সময় বাপি ছিল। আশীর্বাদও করল। সব কিছু নর্মাল হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আমার এই ইগোর জন্য সব আবার ওলোটপালোট হয়ে গেল। এটা আমার ভুল। আমি আজকে আপনাদের সামনেই সেটা অ্যাডমিট করছি।
এখানেই ‘পরিচয়’য়ের গল্পটা আমায় হন্ট করে। ছবিতে আমার ‘মেয়ে’র সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি বুঝতে পারি আমি কোথায় ভুল করেছি। অনুশোচনাও হয়। কোথাও আমার সিনেমা আর জীবনটা মিলে যায়। না হলে কে আর সংসারে অশান্তি চায় বলুন। যে যাই বলুক, নো বডি ওয়ান্টস আ ব্রোকেন ফ্যামিলি। এটা জীবনের খুব বড় সত্য।
হয়তো অনেকেই আমার এই আজকের কথাগুলোর সঙ্গে রিলেট করতে পারবেন।
সৎ থাকলে তৃতীয় মানুষকে স্বীকৃতি দেওয়াই উচিত
আজকে আর একটা সমস্যার কথাও চারিদিকে শুনি আর দেখি। তা হল ম্যারেড লাইফে তৃতীয় একটা মানুষের উপস্থিতি। সেটা আজকের দিনে নারীও হতে পারে, পুরুষও।
এ রকম কোনও পরিস্থিতিতে আমার একটাই কথা বলার। যদি তৃতীয় সেই মানুষটার সঙ্গে সম্পর্কটার মূল্য দেন, যদি সৎ থাকেন, যদি রেসপেক্ট করেন তাঁকে, তাহলে আপনি বিবাহিত হলেও তৃতীয় সেই মানুষটির উপস্থিতিটা আপনার স্বীকার করা উচিত।
সেটাকে অস্বীকার করলে সেই সম্পর্ককে ছোট করা হয়। আর আমি কোনও দিন সেটা করিনি।
আমার যখনই কাউকে ভাল লেগেছে, আমি নিজে গিয়ে তাঁকে বলেছি। পাবলিক লাইফে আছি বলে, কোনও দিন লুকিয়ে কিছু করিনি। এই অনেস্টিটা আমার আগেও ছিল, শেষ দিন পর্যন্ত থাকবে। |
|
দেবশ্রীর সঙ্গে |
হ্যাপি কাপলের অভিনয়টা চালিয়ে যাবেন না
এবং রিলেট করতে পারবেন বলেই আর একটা কথা বলি। আজকে আমার কাছে অনেকে রিলেশনশিপের অ্যাডভাইসের জন্য আসে।
আমি হয়তো ঠিক ব্যক্তি নই রিলেশনশিপ নিয়ে অ্যাডভাইস দেওয়ার। কিন্তু তাও কিছু রিয়্যালাইজেশন আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই।
এটা বলতে চাই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে যদি একবার চিড় ধরে, তা হলে জানেন, সেটা রিপেয়ার করা বড্ড মুশকিল। এইটুকুই বলব, যে সম্পর্ক সমাজের জন্য বহন করে চলতে হয় সেই সম্পর্ক নিয়ে চলার কোনও মানে হয় না। তার থেকে ভাল নিজেদের মধ্যে কথা বলুন। সুস্থ ভাবে কী করে আলাদা হওয়া যায় তা নিয়ে আলোচনা করুন।
ন্যাস্টি হয়ে, গালাগালি দিয়ে, কুৎসা রটিয়ে কোনও লাভ হয় না। কেউ তো বিয়ে ভেঙে যাওয়ার জন্য বিয়ে করে না। তা হলে ছাড়াছাড়ির সময় এই অসভ্যতা কেন? এটাই আমার অ্যাডভাইস।
কিন্তু শেষমেশ একটা কথা না বলে পারছি না। আমাদের সমাজে অনেক মানুষ দেখি। কারও নাম করছি না, যারা শুধু কনভেনিয়েন্সের জন্য, সমাজের জন্য, হ্যাপি কাপলের অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছেন। আই ফিল ভেরি স্যাড হোয়েন আই সি দেম। খুব দুঃখ হয়।
কোনও পার্টিতে, কোনও বিয়েবাড়িতে এরকম কাপলদের দেখলে বুঝতে পারবেন কী অসম্ভব অ্যাক্টিং তাঁরা করে চলেছেন শুধু হ্যাপি ফ্যামিলির ছবিটা বজায় রাখার জন্য। হয়তো তাঁরা জানেন না, তাঁরা নিজেরাই নিজেদেরকে কতটা ঠকাচ্ছেন।
একটু ভেবে দেখবেন প্লিজ। |
|
|
|
|
|