অযোধ্যা পাহাড়ের উপরে গ্রাম, গ্রামের নাম পুনিয়াশাসন। সাকুল্যে আড়াইশো মানুষের বাস। জন্ম থেকেই এ গাঁয়ের শিশুরা জেনে যায়, জলাভাব তাঁদের সঙ্গী। গৌর মুর্মু, ভাদো মুর্মুদের কথায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটা নলকূপ আছে বটে তাতে জল পড়ে না। কখনও সারিয়ে দিয়ে গেলে ক’দিন জল পড়ে, তারপর সেই অবস্থা। আর পানীয় জল? গৌরদের কথায়, গাঁয়ের বাইরে কয়েকটা দাঁড়ি (ছোট জলা) আছে। সেখান থেকে জল নিয়ে আসতে হয়।
একই ছবি পাহাড়ের উপরে জিলিংসেরেং গ্রামেও। এই গ্রামের বাসিন্দা বাহামণি মুর্মু, বুধনি পাহাড়িয়াদের কথায়, গাঁয়ের বাইরে লকুরি খাড়ু নামে একটা ঝোরা রয়েছে। বর্ষাকালে তাতে কিছুদিন জল পাওয়া যায়। অন্য সময়ে দূরের বিরুগাড়া নদী থেকে খাবার জল নিয়ে আসতে হয়।
এতো গেল অযোধ্যা পাহাড় এলাকার কথা। পুঞ্চা ব্লকের কংসাবতী তীরের গ্রাম জামবাদের বাসিন্দা বিশ্বজিত মাহাতোর কথায়, আমাদের গ্রাম থেকে তো কংসাবতী নদী এত কাছে, অথচ এই এলাকার গ্রামগুলির মেয়ে-বউদের নদী থেকে জল আনতে হয়। পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই গ্রামে।
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলার ৭২ শতাংশ এলাকাই নলবাহিত পানীয় জল সরবরাহের আওতার বাইরে রয়েছে। জেলায় মোট মৌজার সংখ্যা ২৬৮৩। তার মধ্যে এখনও নলবাহিত পানীয় জল সরবরাহের পরিকাঠামো নেই ২১৬৬টি মৌজায়। পাশাপাশি নয়টি সেনসাস টাউন এলাকার মধ্যে তিনটিতে নলবাহিত পানীয় জল সরবরাহের পরিকাঠামো নেই। |
এই সমস্যা সামলাতে কতটা উদ্যোগী ছিল পুরুলিয়ার পঞ্চায়েত ব্যবস্থা? দেখা যাচ্ছে, জেলা পরিষদের যে স্থায়ী কমিটি পানীয় জলের দায়িত্বে, সেই ‘জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ কমিটি’ ২০১২-১৩ সালে মাত্র চারটি বৈঠক করেছে। অর্থাৎ মাসে একটি বৈঠকের জায়গায়, তিন মাসে একটি বৈঠক হয়েছে।
অনুন্নত জেলা পুরুলিয়া। সেখানে কেন জেলা পরিষদের উন্নয়নের উদ্যোগের এমন দশা? বিদায়ী সভাধিপতি বিলাসীবালা সহিস বলেন, তৃণমূল সরকার ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে পুরুলিয়া জেলা পরিষদকে কাজ করতে দেওয়া হয়নি। “জেলার অধিকাংশ উন্নয়ন-সংক্রান্ত বৈঠকে আমি ডাকও পাইনি। এই সময়টা নামেই জেলা পরিষদ চলছিল।” বিরোধী নেতা কংগ্রেসের উত্তম বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য অভিযোগ করেছেন, সভাধিপতি তাঁর এলাকার প্রতি পক্ষপাত করছেন। সার্বিক স্বাস্থ্য বিধানের কাজের অগ্রগতিতেও তিনি অসন্তুষ্ট। জঙ্গলমহল-সহ জেলার অন্যান্য এলাকাতেও আরেকটি সমস্যা রাস্তা। বছর দেড়েক আগে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ মাওবাদী অধ্যুষিত এই জেলায় বৈঠক করতে এসে দেখেছিলেন দীর্ঘ এলাকায় রাস্তা নেই। |
মানুষের কিছু চাহিদা অব্যশ্যই পূরণ হয়েছে। কিন্তু পানীয় জল,
রাস্তাঘাটের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অবহেলিত।
জঙ্গলমহলের বড় অংশে আজও উন্নয়নের আলো সে ভাবে পৌঁছয়নি।
এখনও মাইলের পর মাইল হেঁটে জ্বালানি সংগ্রহ করতে হয়।
সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়
মানবাধিকার কর্মী, আদ্রা |
সাতটা পঞ্চায়েত নির্বাচন পেরিয়েছি। গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকার ন্যূনতম চাহিদা এখনও পূরণ হয়নি।
মানুষের মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সংস্কৃতির একটা ভূমিকা রয়েছে।
কিন্তু সেখানেও রাজনীতি প্রবেশ করেছে।
কিরীটী মাহাতো
ঝুমুর শিল্পী, পাড়া |
পঞ্চায়েত এখানে বাজার গড়েছে, ভাল কথা। কিন্তু, সেখানেই দায়িত্ব শেষ হয় না।
ওই বাজারে পঞ্চায়েত বছরভর নজরদারি চালায় না। ফলে, বাজারের হাল নরক হয়ে উঠছে।
বর্ষায় চলাফেরা করাই দায়। ব্যবসা মার খায়।
মিহির কর, সভাপতি,
কাশীপুর বাজার সমিতি |
|
প্রশাসনকে বলেছিলেন, উন্নয়নের লক্ষ্যে যে যে রাস্তা গড়া দরকার অবিলম্বে সেই রাস্তাগুলি গড়ার প্রকল্প পাঠাতে। জেলা পরিষদ ২০১২ সালে ১৪৪টি রাস্তা গড়তে চেয়ে প্রকল্প পাঠায়। যেখানে পুরুলিয়া জেলা পরিষদ বছরে গড়ে ১৫টি রাস্তা তৈরি করত সেখানে একলপ্তে অনুমোদন মিলে যায় ১৪৪টি রাস্তার। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা প্রকল্পে ২৬০ কোটি টাকাও বরাদ্দ করে কেন্দ্রীয় সরকার। জেলা পরিষদ সূত্রের খবর, দু’বার টেন্ডার ডাকার পরে এখনও অবধি মাত্র ৬০টি রাস্তার ক্ষেত্রে ঠিকাদার মিলেছে।
রাস্তা তৈরিতে কতটা উদ্যোগী জেলা পরিষদ? তাদেরই নথিপত্রে দেখা যাচ্ছে, গত বছরে মাত্র পাঁচটি বৈঠক করেছে পূর্ত ও পরিবহণ কমিটি। কত রাস্তা সারানো দরকার, জেলা পরিষদের কাছে নেই সে তথ্যও।
সব চাইতে যা উদ্বেগজনক, তা হল খরচের বিষয়ে নজরদারিতে নিয়মানুবর্তিতার অভাব। ভিজিল্যান্স অ্যান্ড মনিটরিং কমিটি, যার সব খাতাপত্র দেখার কথা, তার বৈঠক হয়েছে অনিয়মিত। আর শেষ বার অডিট রিপোর্ট পেশ করা হয়েছিল ২০০৯-১০ সালের সাধারণ সভায়। এমন অনিয়মই যেখানে নিয়ম, সেখানে উন্নয়নের কাজে গতি আশা করাই দায়। |