নজরে পশ্চিম মেদিনীপুর
বরাদ্দ টাকা পড়ে, লোধাদের রাত কাটে ছিটেবেড়ার ঘরে
ভোট আসে। ভোট যায়। তারপর?
পঞ্চায়েতের আসনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে তুমুল লড়াই, তা জনজীবন কার্যত বিপর্যস্ত করে ফেলে। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে নির্বাচন, সেই এলাকার উন্নয়ন কতটা কী হচ্ছে, এলাকার গরিব, প্রান্তবাসী মানুষের জন্য স্থানীয় প্রশাসন কী করছে, সে কথাটা থেকে যায় সবার চোখ-কানের আড়ালে। অথচ পঞ্চায়েত ব্যবস্থার উদ্দেশ্যই ছিল গ্রামের মানুষের কাছাকাছি প্রশাসনকে নিয়ে আসা। গ্রামের নাগরিকের চাহিদা যাতে তাঁরাই মেটাতে পারেন, ধরাছোঁয়ার বাইরে কোনও সাংসদ-বিধায়কের উপর নির্ভর করতে না হয়, তাই তো পঞ্চায়েত।
এক একটা গ্রাম পঞ্চায়েত দুই থেকে পাঁচ কোটি টাকা খরচ করতে পারে প্রতি বছর। ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত চাইলে করতে পারে না, উন্নয়নের এমন কাজ কার্যত নেই। দলে-দলে বিরোধিতায় উন্নয়ন যদি আটকায়, তা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গেরই সামিল।
পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা কেমন কাজ করছে, তা আন্দাজ করতে গেলে তার উচ্চতম স্তর, জেলা পরিষদের ছবিটা দেখা চলে। পশ্চিম মেদিনীপুরে সে ছবি দেখলে দুটো কথা স্পষ্ট হচ্ছে। এক, প্রশাসনিক নিয়ম মেনে কাজ করায় বহু ত্রুটি রয়ে যাচ্ছে। আর দুই, উন্নয়নের কাজে বরাদ্দ টাকা খরচে বড়সড় খামতি থাকছে।
প্রশাসনিক গলদটা সব চাইতে বেশি নজরদারির কাজের ত্রুটিতে। ভিজিল্যান্স অ্যান্ড মনিটরিং কমিটি (যার শীর্ষে থাকেন জেলার এক সাংসদ), এবং জেলা কাউন্সিল (যার শীর্ষে থাকেন জেলা পরিষদের বিরোধী নেতা), এ দুটির সদস্যরাই গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে যে কোনও স্তরের প্রশাসনের খাতাপত্র পরীক্ষা করতে পারেন। পশ্চিম মেদিনীপুরে ভিজিল্যান্স কমিটির মিটিং গোড়ার কয়েক বছর হয়েছে মাত্র একটা করে, গত বছর তা-ও হয়নি। কাউন্সিলের মিটিং-ও হয়নি গত বছর। এ থেকে স্পষ্ট যে, টাকাপয়সা ব্যয়ের উপর নজরদারির যে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, তা কাজ করেনি। আলোচনার মাধ্যমে পরিকল্পনা গ্রহণের ব্যবস্থাও যে প্রায় অকেজো, তা বোঝা যায় জেনারেল বডি আর জেলা সংসদের বৈঠকের সংখ্যা থেকে।

এত বছর ধরে পঞ্চায়েতের কাজ দেখলাম। কিন্তু হতাশ। রাস্তার কাজ, পানীয় জল, বিদ্যুৎ সংযোগে শ্লথ গতি। ১০০ দিনের প্রকল্পে কিছু কাজ হয়েছে, কিন্তু সার্বিক উন্নয়ন হয়নি। কাজে সন্তুষ্ট নই। সামান্য বিতর্কে রাস্তার কাজ বন্ধ হয়ে থেকেছে। মৃৎশিল্পীদের জন্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা রয়েছে কি না, কী ভাবে তা পেতে পারিএই ধরনের কথা কারও মুখে থেকে শুনিনি। ট্রেড লাইসেন্স ফি-র কাঠামো নতুন করে খতিয়ে দেখা জরুরি। ফি কম হলে
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও ট্রেড-লাইসেন্স করতে উৎসাহিত হবেন। পঞ্চায়েতের আয় বাড়বে।
পুলিনবিহারী পড়্যা: প্রাক্তন
প্রধান শিক্ষক (ডেবরা)
মনিকা পাল: মৃৎশিল্পী
(খড়্গপুর গ্রামীণ)
সুব্রত মহাপাত্র: ব্যবসায়ী
(গড়বেতা)
ফলে বরাদ্দ খরচ করতে যে সমস্যা হবে, তা আর আশ্চর্য কী। যে রাজ্যে আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে, সেখানে দারিদ্র দূরীকরণের জন্য বেশ কিছু প্রকল্পের টাকা এসে পড়েই থেকেছে। পরিকাঠামো উন্নয়নে কিংবা জীবিকা তৈরিতে খরচ হয়নি এক টাকাও। বিশেষত স্বজলধারা প্রকল্পে যে প্রায় বরাদ্দের প্রায় কিছুই খরচ হয়নি, সেটা জেলার মানুষদের আরও তীব্র আঘাত করছে। কারণ, জঙ্গলমহলের জেলা পশ্চিম মেদিনীপুরে অন্যতম সমস্যা পানীয় জল। কিছু গ্রামে নলকূপ তৈরি করা হলেও সংরক্ষণের অভাবে বেশির ভাগই অকেজো হয়ে গিয়েছে। গ্রীষ্মে জলস্তর নেমে গেলে বেশ কিছু নলকূপ থেকে জল ওঠে না। নলবাহিত জল সরবরাহের প্রকল্প রূপায়িত হয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি গ্রামে। মাঝি মাডওয়া জুয়ান গাঁওতার সাধারণ সম্পাদক প্রবীর মুর্মুর কথায়, “আমাদের জেলায় বহু আদিবাসী মানুষের বসবাস। মানুষ জমির পাট্টা পাচ্ছেন না, পানীয় জল নেই।
কী কষ্টে যে দিন কাটাতে হয় তা গ্রামের মানুষই বোঝেন।”
ইন্দিরা আবাসে গরিব মানুষদের বাড়ি তৈরি করে দেওয়ার ক্ষেত্রেও জেলা পরিষদ উদ্যোগী হয়নি বলে অভিযোগ। এমনকী লোধাদের বাড়ি তৈরির প্রকল্পেও কাজ হয়নি। গরিব লোধা পরিবারের সদস্যরা ভাঙাচোরা ছিটেবেড়ার বাড়িতে রাত কাটাচ্ছেন, আর সরকারি তহবিলে পড়ে আছে ‘লোধাদের উন্নয়ন ও সংরক্ষণ প্রকল্প’-এর টাকা। স্বভাবতই ক্ষুব্ধ লোধা-শবর কল্যাণ সমিতির সম্পাদক বলাই নায়েক। তিনি বলেন, “আগেও সরকার গরিব লোধাদের জন্য কিছু করেনি। নতুন সরকারেরও সে ব্যাপারে কোনও উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। স্মারকলিপি, বিক্ষোভ, অবস্থান করা হয়েছে। তবু গরিবরা বাড়ি পান না।”
কৃষি প্রধান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় আর একটি সমস্যা সেচ। চাষিরা নিজেদের উদ্যোগে সেচের জন্য গভীর ও অগভীর নলকূপ তৈরি করেছেন। কিন্তু বিদ্যুৎ সেংযাগ সমস্যা তৈরি করেছে সেখানেও। চন্দ্রকোনার চাষি বলরাম পাত্র বলেন, “বৃষ্টি কম হলে বর্ষাতে পর্যন্ত সেচ দিতে হয়। অন্য মরশুমে সেচ ছাড়া চাষের কোনও গতি নেই। তা নির্ভর করে গভীর নলকূপের উপরেই। কিন্তু বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকলে কী করে জল উঠবে? যেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ আছে, সেখানেও লো ভোল্টেজ, লোডশেডিং বড় সমস্যা। সরকারি উদ্যোগে সেচ ব্যবস্থা হচ্ছে না, চাষিরা উদ্যোগী হয়ে করার পরেও যদি সুযোগ না থাকে তাহলে চাষের ভবিষ্যৎ দিনের পর দিন খারাপই হতে থাকবে।”

দুয়ারে ভোট, মিলল না বহু হিসাবই
রিপোর্ট কার্ড
নজরে তিন জেলা পরিষদ (প্রথম দফার ভোট: ১১ জুলাই)
২০১২-১৩ সালের হিসেব বাঁকুড়া পুরুলিয়া পশ্চিম মেদিনীপুর
জেনারেল বডির কতগুলি বৈঠক হয়েছে ?
(নিয়ম বছরে ৪টি)
ভিজিল্যান্স অ্যান্ড মনিটরিং
কমিটির কতগুলি বৈঠক
(নিয়ম বছরে ৪টি)
বাজেট সময় মতো পেশ হয়েছে কি? হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ
জেলা সংসদের কতগুলি সভা হয়েছে?
(নিয়ম বছরে ২টি)
হয়নি হয়নি
জেলা পরিষদের দায়িত্বে কত রাস্তা আছে,
তার তালিকা আছে কি?
নেই আছে আছে
কত রাস্তা সারানো দরকার? তথ্য নেই তথ্য নেই ১৮%
অভিযোগ রেজিস্টার
নিয়মিত পর্যালোচনা হয়?
না না হ্যাঁ
অডিট রিপোর্ট সাধারণ
সভায় পেশ হয়েছে কি?
হ্যাঁ না হ্যাঁ
মোট বরাদ্দ টাকার কত শতাংশ খরচ হয়েছে?
২০১২-১৩ ৭১ ৬৮ ৬৯
২০১১-১২ ৬৪ ৬৩ ৭৭
২০১০-১১ ৮১ ৬৭ ৮১
কয়েকটি প্রধান প্রকল্পে যত খরচ হয়েছে
পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ ৩৫.৫৬ ৬২.০৭ ৫৯.৮০
স্বজলধারা ৬.৪০ ০.০১
ইন্দিরা আবাস যোজনা ৯৯.৫২ ৫১.৬৮ ৮৮.৫৩
পশ্চাৎপদ এলাকা উন্নয়ন
তহবিল (বিআরজিএফ)
৫৩.০৬ ৭২.২২ ৫৩.৮৩
কিছু প্রকল্প যাতে বড়সড় বরাদ্দের এক টাকাও গত অর্থবর্ষে খরচ হয়নি
বাঁকুড়া পুরুলিয়া পশ্চিম মেদিনীপুর
• খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও উদ্যান পালন (৪১ লক্ষ)
• পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিকে দেওয়ার জন্য
• উৎসাহ-অনুদান (২৭ লক্ষ)
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ (৮ লক্ষ),
রাজ্য হেরিটেজ কমিশন (৪ লক্ষ)
• মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র (১ লক্ষ)
• ক্যাম্পাস, স্টেডিয়াম ও খেলার মাঠ (২০ লক্ষ)
• প্রাথমিক স্কুলের পরিকাঠামো উন্নয়ন (২২ লক্ষ)
• ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প (৬ লক্ষ)
• প্রধানমন্ত্রী গ্রামোদয় যোজনা-প্রাথমিক
স্কুলের জন্য পানীয় জল
ও শৌচাগার (৭ লক্ষ)
• পশুপালন ও ডেয়ারি (১.২৪ কোটি),
• গ্রাম উন্নয়ন (১.১৫ কোটি),
• ইন্দিরা আবাসের জলপরীক্ষা (৭৫ লক্ষ)
• প্রধানমন্ত্রী গ্রামোদয় যোজনায় গ্রামীণ আবাস (৫৩ লক্ষ), রাজ্য
শিশুশিক্ষা মিশন (৩০ লক্ষ)
• জনশিক্ষা (২২ লক্ষ),
• খাদ্য ও সরবরাহ (১১ লক্ষ)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.