|
|
|
|
মাসির বাড়ি নিশ্চিহ্ন, গ্রামে ‘অতিথি’ জগন্নাথ |
অমিত কর মহাপাত্র • দাঁতন |
কালের গর্ভে ভেঙে গিয়েছে মাসির বাড়ি। তাই প্রতি বছরই গ্রামেরই কোনও না কোনও বাড়িতে আতিথ্য নেন জগন্নাথ। তিনশো বছরের পুরনো জয়পুরার রথের সঙ্গে যেন আত্মার বন্ধন দাঁতনবাসীর। রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে ভেঙে যায় সাম্প্রদায়িকতার বাধা। সব ধর্মের মানুষ মেতে ওঠেন উৎসবে। রথযাত্রা ও উল্টোরথের দিন মন্দিরকে কেন্দ্র করে জগন্নাথ রোড বরাবর বসে যায় মেলা। সংলগ্ন ওড়িশা থেকেও মেলায় আসেন লোকজন। রথযাত্রার সময়ে জগন্নাথ ও বলরামের মূর্তিতে পরানো হয় পেতলের হাত। ঐতিহ্য মেনে মেলায় বিক্রি হয় রথাকৃতি সন্দেশ।
দাঁতনের বাসিন্দা আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক বঙ্কিমচন্দ্র মাইতির বক্তব্য, বারোশো থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত কাঁসাই নদী থেকে বাংলার এই সীমান্তখণ্ড ওড়িশার গঙ্গ ও সূর্য বংশের রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। উৎকলীয় রাজা ও তাদের সামন্তবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় জগন্নাথ ধর্ম রাজধর্মরূপে সীমান্তখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দাঁতন বাজারে জগন্নাথ রোডের ধারে (বর্তমানে ওড়িশা ট্রাঙ্ক রোড) জগন্নাথ মন্দির ওই সময়েই নির্মিত হয়। ওড়িশা শিখররীতির এই মন্দিরটির গর্ভগৃহ ও নাটমন্দির ল্যাটেরাইট শিলায় তৈরি। |
|
মন্দিরের বিগ্রহ |
পুরাকীর্তি বিশেষজ্ঞ তারাপদ সাঁতরার মতে, মিথুন মূর্তির অলঙ্করণ যুক্ত এই মন্দিরটি আঠারো শতকের প্রথম দিকে নির্মিত বলে অনুমান। মন্দিরটির মালিকানা বর্তমানে স্থানীয় পণ্ডা পরিবারের। পরিবারের দুই শরিক রবীন্দ্রনাথ ও হরিশঙ্কর পণ্ডা জানান, পারিবারিক দলিল অনুযায়ী তিনশো বছরেরও আগে পলাশিয়াগড়ের এক সামন্তশাসক ‘মহাপাত্র’ পরিবার মন্দির নির্মাণ ও উৎসবের সূচনা করেন। মন্দিরের মালিকানা বদল হয়েছে অনেকবার। মালিকানা মহাপাত্রদের পর পাহাড়ীদের হাত হয়ে বর্তমানে পণ্ডা বংশের হাতে রয়েছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উৎসব জৌলুস হারিয়েছে অনেকটাই। কমেছে রথের উচ্চতাও। কিন্তু তিন শতক পার করে দেবমূর্তি আজও অপরিবর্তিত। স্থানীয় বাসিন্দা শেখ নিজামুদ্দিন, হুমায়ন খান, আওলাদ হোসেনরা বলেন, “বংশ পরম্পরায় আমরা জগন্নাথদেবের রথযাত্রায় যোগ দিই। মনের ইচ্ছা পূরণের জন্য মানতও করি।”
দাঁতনের ইতিহাস গবেষক অতনুনন্দন মাইতি, বিশ্বজিৎ ঘোষরা জানান, জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ কাব্যে চৈতন্যদেবের দাঁতন হয়ে পুরী যাওয়ার কথার উল্লেখ আছে। স্থানীয়দের বিশ্বাস, বর্তমান মন্দিরের কাছেই চৈতন্যদেব ও তাঁর সঙ্গীরা বিশ্রাম নিয়েছিলেন ও বিদ্যাধর দিঘির জল পান করেছিলেন। রথযাত্রার মেলায় পুণ্যার্থীরা আজও সেই দিঘির জল মাথায় নেন। জয়পুরা মৌজার ওই দু’টি স্থানে পরে পুণ্যক্ষেত্র হিসেবে সৌধ গড়ার কথা ভাবা হয়েছিল। সেই ভাবনাই পূর্ণতা পায় মন্দির নির্মাণের মধ্য দিয়ে। |
|
জয়পুরার মন্দির। |
মন্দির থেকে পাঁচশো মিটার দূরে ওই দিঘির পাড়ে নির্মিত মাসির বাড়িটি বর্তমানে নিশ্চিহ্ন। জয়পুরার বাসিন্দা সুধাংশু দাস বলেন, “ওই মাসির বাড়িতেই প্রথম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সূচনা হয়। মাসির বাড়ি ভেঙে যাওয়ার পর থেকে গ্রামবাসীরা জগন্নাথদেবকে রথ উৎসবের ন’দিন নিজের বাড়িতে আতিথ্য দেন। গ্রামের এক-একটি বাড়ি প্রতি বছর হয়ে ওঠে জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি।”
গ্রামবাসী অতনু পাল, চণ্ডীচরণ দাসরা বলেন, “গ্রামের সকলেই জগন্নাথদেবকে আতিথ্য দেওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে।” এ বছর কার্তিক পাল, উমা পালের বাড়ি হবে জগন্নাথে মাসির বাড়ি। স্নান পূর্ণিমার দিন জগন্নাথকে নিমন্ত্রণও করে এসেছেন তারা। |
— নিজস্ব চিত্র। |
|
|
|
|
|