অকালবর্ষণে হিমাচলেরও ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু উত্তরাখণ্ডের মতো তাণ্ডব হয়নি। ধ্বংসের মাত্রাও
কিছু অংশে সীমাবদ্ধ। স্থানীয় মানুষের মতে,
এর একটা কারণ হল, হিমাচলিরা প্রকৃতিকে মান্য করেন।
শহুরে মানুষ অনেক সময়েই যে আচরণকে ভুল করে ভাবেন কুসংস্কার।
রুনা বসু |
অন্য বারের মতোই শিমলায় বর্ষা এল, খুব কিছু বেশি নয়। ১৬ জুন কৃষ্ণা এসেছে চণ্ডীগড় থেকে, মায়ের কাছে। ওর বাপের আর শ্বশুরবাড়ি কিন্নর জেলার আসরাং আর আগ-পা গ্রামে। এই অঞ্চলের উচ্চতা ১০,০০০ ফুট থেকে ১৩,০০০ ফুট প্রায়। গরমের ছুটিতে স্বামী ছেলেমেয়েকে নিয়ে গিয়েছে গ্রামের জমিজমার খবর নিতে। কৃষ্ণা রয়ে গেছে শিমলায় মায়ের কাছে।
স্বামী ফোনে জানায়, এবারে বেশ ভাল ফলন হয়েছে। গাছের ফল তৈরি, বাজারের জন্যে। প্রতি বছর এই সময় এই অঞ্চলের যারা বাইরে কাজ করেন, চলে আসেন গ্রামে। এক এক মরশুমে ঘরে আসে কয়েক লক্ষ টাকা। সারা বছরের রোগ-ভোগ, বিয়ে-শাদি, দান ও অন্য আনন্দ-অনুষ্ঠানের খরচ মেটানোর জন্য যথেষ্ট। গ্রামবাসীদের শ্বাস ফেলার সময় হয় না এখন।
খবর থেকে বোঝার উপায় নেই উপরে কী হতে পারে। দু’দিন আগে ওর বোনের ফোন আসে মুরাং থেকে, প্রায় তিন ফুট বরফ পড়ছে। পাশেই এক গোর্খা বাবা ও ছেলে ছাদ চাপা পড়ে মারা গেছে, মাকে অজ্ঞান পাওয়া গেছে; বাঁচবে কিনা জানা নেই। বাড়ি ঘর ভেঙেছে। গ্রাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে, অন্যের খবর পাওয়া মুশকিল। ওর স্বামী পাটোয়ারি, সবার জমির হিসাব রাখেন। আজ সাত দিন বাইরে, সরকারি ত্রাণ শিবিরে ডিউটি পড়েছে; বাড়ি ফেরেননি, খবরও নেই। কৃষ্ণার দুশ্চিন্তা বাড়ছে। কিন্নরের সদর শহর রিকংপিও-এ খবর নিয়ে জানা গেল গ্রামে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। দূরদর্শন থেকে জানা গেল, ওই অঞ্চলের জাঙ্গি, তক্তো, লিপ্পা বা অন্য ছোট ছোট গ্রামের হাল খুব খারাপ। ত্রাণ পর্যন্ত পাঠানো যাচ্ছে না। |
রাস্তার বরফ সরাচ্ছে সরকারি বুলডোজার। পাঙ্গি ভ্যালি, চাম্বা, ১৩ জুন। ছবি: পিটিআই। |
এবার প্রথম বৃষ্টির পর কালকা থেকে শিমলায় আসার পথে প্রায় সারা রাস্তা ধরে বড় বড় পাথর পড়েছে। বর্ষাকালে তা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এ সময়ে তিন ফুট বরফ পড়া; ভাল লক্ষণ নয়। বাড়িতে বাড়িতে আলোচনা, খবরে খবরে দুশ্চিন্তা উদ্বেগ জমা হতে থাকে, বাদলের কালো মেঘের মতো।
কৃষ্ণার দাদা বিদ্যাসাগর নেগি হিমাচল বিশ্ববিদ্যালয়ের বৌদ্ধ দর্শনের অধ্যাপক। বললেন, ১৫ বছর আগেও ওখানে ১১-১২ ফুট বরফ পড়ত। এই অঞ্চল ‘রেন জোন’-এর বাইরে। বরফ গলতে গলতে জুন মাস। মেষপালকের দল পাহাড়ের মাথায় পৌঁছে যেত এখন। তখন তেতি নদীর ধারে নেওল জমিতে হাল পড়ে গেছে। এর পর হাল পড়ত কিমসারিং-এ, রাংসারিং-এ; খেত তৈরি হয়ে যেত। বরফ এই পাহাড়ের জন্যে সব সময় ভাল।
কালযাং স্পিতিতে এক স্কুলে পড়ায়। ও খবর পেয়েছে, গ্রামের বেসরকারি আবাসিক স্কুলের ছাদ ফুটো হয়ে জলে ঘর ভরে গেছে, বাচ্চাদের বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা হচ্ছে। আজও বেশির ভাগ বাড়ি পাথর-মাটি দিয়ে তৈরি, ঠান্ডা আটকায়। মাটির ঢালাই ছাদে বরফ পড়লে রোদ ওঠার আগেই উঠে বেলচা দিয়ে বরফ ফেলতে হয়। কিন্তু বৃষ্টি হলে তার উপায় থাকে না। ছাদ ফুটো হয়ে যায়। এবারই প্রায় দশ বছর পর জানুয়ারির প্রথম তুষারপাতে পাঁচ ফুট বরফ পড়ে, মরশুমের শেষে তা ১২ ফুট। সবাই খুশি, ফলন ভাল হবে। কিন্তু বৃষ্টি আর অকালের বরফ রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। মান্ডি ও সাংলায় বাদল ফেটেছে, রিব্বা, পু-র রাস্তা বন্ধ। কালযাং একটা পরীক্ষা দিতে এসেছে, রাস্তা ঠিক না হলে, যেতে হবে মানালি হয়ে, চার-পাঁচ দিনের রাস্তা। আজও কিন্নরের জাঙ্গি, লিপ্পাতে ত্রাণ পৌঁছায়নি। আকাশপথে কিছু যাত্রীকে রামপুরে নিয়ে আসা হচ্ছে। কৃষ্ণারও রাতের ঘুম উড়ে গেছে। ঘরের কাজ করছে ভুলে থাকার জন্যে। মা বোন বৌদ্ধ পুঁথি পাঠ করছেন।
হিমাচলে যা হয়েছে, তা ছাড়াও আরও বেশি উদ্বেগ উত্তরাখণ্ডের জন্য। অলকানন্দা নদীর তাণ্ডবে মনে পড়ে ২০০০ সালের শতদ্রুর ভয়ঙ্কর রূপ। রামপুরের পশ্চিম পারের বেশ কিছু বাড়ি ভেসে গিয়েছিল সেবার, মানুষ, পশু সব। পার্বত্য সংস্কৃতি রাজনৈতিক ভূগোল মানে না। বিপন্নরা সবাই এক। উত্তরাখণ্ড বা হিমাচল, গুজরাত বা পশ্চিমবাংলার সঙ্কীর্ণ খোপে পোরার আধুনিকতা পাহাড়িদের অনায়ত্ত।
সাত দিন পর ফোন এল কৃষ্ণার স্বামীর কাছ থেকে, ওরা ভাল আছে কিন্তু বাগিচা আর নেই। মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। অঞ্চলটাই ওলটপালট হয়ে গেছে। পায়ে চলার রাস্তাটাও নেই। সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে না, কে-ই বা দেখবে? প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে এসে তবে ফোন করা যায়।
সুরজ, টেলিফোন দপ্তর থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে গ্রামে খেতের কাজ করছেন। বললেন, বাগিচা তো গেছে, আর ওই গাছে ফল হবে কিনাও সন্দেহ। নতুন চারা লাগাতে অনেক টাকা লাগবে, বছর দু-তিন লাগবে ফল ধরতে। এর পর মটরের সময়, পুরো বর্ষা বাকি। আবার বরফ, বৃষ্টি একসঙ্গে হলে চাষই হবে না। এটা গরমের সময়, সবাই ভেড়-বকরি চড়াতে গেছে পাহাড়ের মাথায়। বরফ চাপা পড়ে সোহনলালজির ১৫০, তাঁর বোনের ৫০ ভেড়া মারা গেছে। বাকিদের কথা জানা নেই। আর আগের মতো কারওর ঘরে দানা জমা থাকে না যে ফলন না হলেও খাবার পাওয়া যাবে। গ্রামদেবতার ভাণ্ডারও শূন্য।
নেগিজি বললেন, মানুষের আগে ধর্মে মন ছিল। বাড়ি বা খেত-খামার বসানোর আগে গ্রামের বড়দের ও গ্রামদেবতার অনুমতি নিত, গ্লেসিয়ার-এর রাস্তা ছাড় দিত। আজ তা হয় না। পাহাড়ে টানেল বানিয়ে মাটির নীচের জল বার করলে মাটি থাকবে কোথায়! এ পাহাড় পাথরের নয়, মাটির; বৃষ্টি হলে ধুয়ে বেরিয়ে যাবে।
সুরজ বললেন, অর্থের প্রয়োজন সবার। কিন্তু অতীতকে উপেক্ষা করে আর কত দিন চলবে? আমরা শিক্ষিত হলেও ভগবানকে মানি। গ্রামের দেবতারা যান স্বর্গে আমাদের জন্যে ফসলের ভাগ আনতে। আমরা সেই সময় দিনের শুরু আর শেষে আঙিনায় গোবর লেপে, ঘরে গোমূত্র ছিটিয়ে শুদ্ধ রাখি বসতভিটে। গোলা ভরে যাবে মরশুমের শেষে, এই আশায়।
আধুনিক ‘উন্নয়নবাদী’দের কাছে সুরজ, নেগিদের কথা নিছক অশিক্ষিতের কুসংস্কার। উত্তরাখণ্ডের বিধ্বংসে বিচলিত হয়ে কৃষ্ণা ও তার মায়ের পুঁথি পাঠ অন্ধবিশ্বাসের অনুশীলন। কিন্তু সহস্র বছরের লোক পরম্পরায় গড়ে ওঠা জীবন-জীবিকার অভিজ্ঞতাকে অশিক্ষিত প্রথাসর্বস্বতা বলে অবজ্ঞা করার মধ্যে ‘স্মার্টনেস’ থাকতে পারে, কিন্তু বুদ্ধিমত্তার পরিচয় যে নেই, তা দেখা গেল উত্তরাখণ্ডের তথাকথিত প্রাকৃতিক ধ্বংসরোষে। কথা হল উত্তরাখণ্ডের গরুড়াবাজের রামলালজির সঙ্গে। তিনি এক সময় যোশীমঠে কাজ করতেন। পরিবেশ বিষয়ে অসামান্য জ্ঞান। বললেন, উত্তরাখণ্ডের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। জঙ্গল থাকলে কী হবে, কৃষির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কমলে, দুর্ভোগ বাড়বেই। ওঁদেরই গ্রামের কিছু মানুষ টাকার প্রয়োজনে জঙ্গলের অংশ বেচে দিচ্ছে বাইরের লোককে। উনি কিছু বন্ধুদের আবেদন জানিয়েছেন, একসঙ্গে কিছু করতে চান, গ্রাম ও কৃষি বাঁচানোর জন্য। কৃষিই তো ধরে রাখে পরম্পরা, বাঁচিয়ে রাখে সভ্যতা। হিমাচলে ধ্বংসের মাত্রা কিছু এলাকাতে সীমাবদ্ধ ও কম। তার একটা কারণ সুরজ, নেগি, রামলালজির মতে, হিমাচল এখনও উত্তরাখণ্ডের তুলনায় অনেক বেশি কৃষি সংস্কৃতির সঙ্গে সংগতি রেখে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০১১ জনগণনার তথ্য মিলিয়ে দেখা গেল, হিমাচলে কৃষিনির্ভরতা যেখানে ৬৮%, উত্তরাখণ্ডে তা মাত্র ৪৪%। হয়তো এর সঙ্গে যোগ আছে রাজ-পরম্পরায় প্রান্তের উপর কেন্দ্রের দখলদারির: পঞ্চপাণ্ডবের পঞ্চমন্দির দিয়ে যার শুরু, তা আজ উত্তরাখণ্ডবাসীদেরই সমতলবাসীর সেবাদাসে পরিণত করেছে। হিমাচলবাসীদের উপর হিড়িম্বার প্রভাব হয়তো এখানে বৈপরীত্যটা তৈরি করেছে।
প্রকৃতির রোষ নয়, মানুষের অমানুষী আধিপত্যই এ বিধ্বংসের জন্মদাতা। পাহাড়িদের কুসংস্কার আসলে এই আধিপত্যের বিপক্ষে এক লোক পরম্পরা, যা থেকে সভ্যতা অনেক কিছু শিখতে পারে। |
হিমাচল প্রদেশে প্রতীচী ট্রাস্টের কাজের সঙ্গে যুক্ত |