ইসলামি অ-ধৈর্যের এই রূপ অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য। যেখানেই রাজনৈতিক
ইসলামের প্রতিপত্তি, সর্বত্রই গণতন্ত্রের প্রতি অনাস্থা বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি করে দিল মিশর।
সেমন্তী ঘোষ |
এই সে দিন যা হয়ে গেল মিশরে, সেটা ঠিক কী? ‘ক্যু’ অর্থাত্ সামরিক অভ্যুত্থান? না কি, ব্রিটেন যেমন বলছে, সামরিক ‘হস্তক্ষেপ’ (intervention)? না কি, শুক্রবার কায়রোর প্রধান ‘লিবারেল’ সংবাদপত্র আল তাহরির-এর প্রথম পাতার শিরোনাম যেমন বলল, ‘বিপ্লব’ (‘‘ইট’স আ রেভলিউশন.. নট আ ক্যু, মিস্টার ওবামা”)? না কি, প্রগতিশীল মিশরীয় ঔপন্যাসিক আহদাফ সুয়েফ যেমন আর একটু সযত্ন নামকরণের চেষ্টা করছেন: ‘ক্ষমতাহরণ’ (deposal)?
নামে কি কিছু আসে যায়? যায়। প্রেসিডেন্ট ওবামা জানেন, ‘ক্যু’-কে সত্যিই ‘ক্যু’ বলার কত সমস্যা। একে তো যে প্রেসিডেন্ট মুর্সিকে গত বছরের জুনে মিশরের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পর ওবামারা অত্যন্ত অখুশি-মনে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, এ বছরের জুনে তহরির স্কোয়্যারের উত্তাল বিদ্রোহের চোটে সেই মুর্সিকেই তাঁদের ঢোঁক গিলে সমর্থন করতে হল, বলতে হল, না, নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে সহিংস বিক্ষোভ একদম সমর্থনীয় নয়। আবার তার পর এখন, সেই জনতারই পক্ষ নিয়ে মিশরের সেনাবাহিনী যে-ই প্রেসিডেন্টকে সরিয়ে সমস্ত ক্ষমতা হাতে নিয়ে নিল, আরও বড় ঝামেলায় পড়লেন তাঁরা। যা ঘটল তা তো আক্ষরিক ভাবেই সামরিক অভ্যুত্থান, গণতন্ত্রের নিশ্চয়ই সর্বনাশ হল এতে, কিন্তু অভ্যুত্থান-কে অভ্যুত্থান তাঁরা প্রাণে ধরে বলতে পারলেন না। মার্কিন আইন অনুসারে, যে সামরিক বাহিনী ‘অভ্যুত্থান’ করে, তার সঙ্গে আমেরিকা কোনও সম্পর্ক রাখতে পারে না, টাকা পাঠানো তো দূরস্থান! এ দিকে, পাকিস্তানের পরই মিশরের সেনাবাহিনীর জন্যই যে সবচেয়ে বেশি ডলার দেয় ওয়াশিংটন! সেই পঞ্চাশের দশকে প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার মিশরকে আমেরিকার ‘ক্লায়েন্ট স্টেট’ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন যুগ পাল্টালেও সেই মার্কিন নীতি যে আজও পাল্টায়নি, মার্কিন স্বার্থেই! |
সেনা-পরিত্রাতার জন্য নাগরিক সংবর্ধনা। কায়রো, ৩ জুলাই, ২০১৩। ছবি: এ এফ পি। |
এ দিকে, গত সপ্তাহের কায়রোর ছবিগুলিই বলে দিচ্ছে, সাঁজোয়া ট্যাঙ্কের বিজয়-প্রবেশ দেখে বিদ্রোহী জনতা কী প্রবল উল্লাসে ফেটে পড়ছিল, ছুটে গিয়ে সেনাদের ফটাফট চুমু খাচ্ছিল! স্বাভাবিক। প্রেসিডেন্ট মুর্সি যে ভাবে মুসলিম ব্রাদারহুডের একচ্ছত্র প্রতাপ প্রতিষ্ঠা করছিলেন, যে ভাবে ইসলামি আইন জারি করছিলেন, যে ভাবে প্রেসিডেন্টের পদটিকে সব রকম নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করে সর্বক্ষমতাময় করে তুলছিলেন: তাতে এক বছরের মধ্যেই দেশে বারুদ জমে স্তূপ। ইসলামিকরণ-বিরোধী, গণতন্ত্রকামী মানুষ মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন, যে ভাবেই হোক হেস্তনেস্ত চাই, স্বৈরাচারী মুবারকের বদলে স্বৈরাচারী মুর্সিকে চাই না। ফলে পরিত্রাতার ভূমিকায় সেনাকে পেয়ে তাঁদের আনন্দের সীমা নেই।
দেখেশুনে কেবল পশ্চিমি দেশগুলির মাথা গুলিয়ে একশা: তারা কি তবে গণতন্ত্রের ধ্বজা ধরে ইসলামি দলেরই পক্ষ নেবে আর বলবে এটা ‘অভ্যুত্থান’, না কি ‘লিবারেল’ বিদ্রোহীদের পক্ষ নিয়ে সেনাকেই সমর্থন করবে, আর বলবে, না, এটা ‘অভ্যুত্থান’ নয়? সুতরাং, আফ্রিকান ইউনিয়ন যদিও একে ‘ক্যু’ বলে দিয়েছে পর দিনই, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখনও বলতে পারেনি!
সত্যি বলতে কী, নামবিভ্রাটে কেবল কূটনীতি আর রাজনীতিই হাঁসফাঁস করছে না, সংকটটা আসলে আরও অনেক গভীর। মিশরীয় আর্মড ফোর্স এ বার যে ভাবে মোক্ষম মুহূর্তে বিদ্রোহী জনতার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে সাধারণ বুদ্ধিতেও এর ব্যাখ্যা মুশকিল। মনে রাখতে হবে, ঠিক যে সময় তহরির স্কোয়্যারের জনসমাবেশের উপর প্রশাসনিক হিংসা জমাট আকারে নেমে আসতে শুরু করছে, তখনই মঞ্চে প্রবেশ করেছে সেনা, তার আগে নয়। কে বলতে পারে, এমন সময়ে সেনা প্রবেশ না করলে হয়তো সরকারি দমনে মৃত্যুর বন্যা বইত, ঠিক যেমন ঘটছে সিরিয়ায়। হয়তো গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দেশ উজাড় হয়ে যেত, যেমন হচ্ছে সোমালিয়ায়। একটা বিষয় স্পষ্ট। ২০১১-র ফেব্রুয়ারিতে হোসনি মুবারকের পতনের পর যখন সুপ্রিম কাউন্সিল অব আর্মড ফোর্সেস (Scaf) সংঘর্ষ-দমনে নেমেছিল, তাদের স্বেচ্ছাচার দেশে-বিদেশে নিন্দার ঝড় তোলে। এ বার তারা আর সে ভুল করেনি। যাতে স্বেচ্ছাচারের অভিযোগ না ওঠে, বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে সংযোগ রেখে চলেছে, প্রধান বিরোধী দলনেতা মহম্মদ এলবারাদেই-এর সঙ্গেও। খবর ছিল অনেক দিন, মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আর্মির দখল নিতে চাইছে, শত্রুদেশ ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করছে, কায়রো ও তেহরানের গোপন তথ্য আদানপ্রদান বাড়ছে ইত্যাদি। তবু তাড়াহুড়ো করেননি জেনারেল আবদুল ফতা আল-সিসি, অপেক্ষা করেছেন যথার্থ মুহূর্তটির জন্য। প্রথম থেকেই তাঁর আশ্বাস, এই ‘হস্তক্ষেপ’ সাময়িক। পশ্চিমি সরকারগুলির কাছেও প্রবোধ পৌঁছেছে যে, মিশরে অতঃপর অসামরিক সরকারই গঠিত হবে। মিশরীয় লিবারেলরা এ সব আশ্বাসে বিশ্বাস রাখছেন। এবং দাবি করছেন, ক্যু নয়, এটা বিদ্রোহের জয়!
মিশর কেন, কোনও দেশেই হয়তো এখন নতুন করে সেনাশাসন জারি হওয়া কঠিন, আন্তর্জাতিক বাজার নামক চাপের সামনে আজ পুরনো সেনা-রাষ্ট্রগুলিই (মায়ানমার) চেহারা পাল্টাতে বাধ্য হচ্ছে, সেকুলার সামরিক শাসনকে সরিয়ে রক্ষণশীল ইসলামি নেতারা ক্ষমতাসীন হচ্ছেন (তুরস্ক), ফলে মিশর রাষ্ট্রটি সম্পূর্ণত সেনার অধীন হয়ে যাবে, সেই ভয় হয়তো সত্যিই নেই। কিন্তু মুশকিল হল, যদি-বা সেনা সরে গিয়ে সত্যিই মিশরে আবার নির্বাচন হয়, নতুন নেতা আসেন, ‘বিদ্রোহের জয়’ হয়, মূল কথাটা কী দাঁড়াচ্ছে? দাঁড়াচ্ছে এই: মিশরে যে গণতন্ত্র প্রথম বারের জন্য এসেছিল, তার অকালমৃত্যু হল। এক বছরের মধ্যেই গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচিত শাসককে সেনা এসে সরিয়ে দেওয়ার অর্থ গণতন্ত্রের অপঘাত মৃত্যুই বটে। আবার নির্বাচন হলে আবারও অপঘাত সম্ভব। আরও এক বার প্রমাণ হল, আরব জমিতে গণতন্ত্র বাঁচে না।
এবং অনেকে বলবেন, আরও এক বার প্রমাণ হল, ইসলাম আর গণতন্ত্রও এক সঙ্গে বাঁচে না, তাই ইসলাম বাঁচাতে হলে একমাত্র পথ, গণতন্ত্র পরিত্যাগ। বলবেন, পশ্চিমি দেশগুলির এত যে বিভ্রান্তি,‘ক্যু’-কে ‘ক্যু’ বলতে এত দ্বিধা, সে তো এই জন্যই যে ক্যু-টা ঘটেছে ইসলামি গোষ্ঠীর শাসকের বিরুদ্ধে! ইসলামির বিরুদ্ধে হলে সেটা ভাল ‘ক্যু’, আর ইসলামির পক্ষে হলে মন্দ ‘ক্যু’ এটাই তো সহজ হিসেব? এরকমই তো হয়েছে আগেও কত বার: ১৯৫৪ সালে মিশরে, যখন ইসলামি গোষ্ঠীর প্রতিপত্তি চেঁটে ফেলে কর্নেল গামাল আবদেল নাসের ক্ষমতা হাতে নেন। কিংবা ১৯৯১ সালে, প্রতিবেশী দেশ আলজিরিয়ায়, যখন ইসলামি পার্টি এফ আই এস নির্বাচনে জিতলেও সেকুলার মিলিটারি তাদের প্রেসিডেন্টকে জোর করে সরিয়ে দেয়, পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়। এরই ‘রিপ্লে’ আজ মিশরে।
তবে লক্ষণীয়, আলজিরিয়ায় সমস্ত ইসলামি পার্টিগুলিকে সে দিন ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ চলে যেতে হয়, আর তার ফলে পরবর্তী এক দশকের সন্ত্রাসে দেড় লক্ষেরও বেশি আলজিরীয়ের মৃত্যু ঘটে। ইতিমধ্যেই কায়রো কিংবা লাক্সরের পাল্টা মুর্সি-পন্থী মিছিল বলতে শুরু করেছে আর্মি যে ভাবে মুর্সি-সহ তিনশো জন মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাকে গ্রেফতার করে সংগঠনকে পিষে মারার চেষ্টা করছে, তাতে তাঁরা আবার ফুঁসে উঠবেন, বোমা-পিস্তলের পথ ধরে। গণতন্ত্র এমনিতেই ইসলাম-বিরুদ্ধ, তাও তাঁরা চেষ্টা করেছিলেন। এ বার নিপাত যাক গণতন্ত্র, সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসের পথেই শরিয়তের প্রতিষ্ঠা হোক। ঘাট হয়েছে, আর নির্বাচন নয়! কেবল মিশরে কেন? ইসলামি অ-ধৈর্যের এই রূপ অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য। সিরিয়ায়। তুরস্কে। ইরানে। ইরাকে। এমনকী পাকিস্তানেও। যেখানেই রাজনৈতিক ইসলামের প্রতিপত্তি, সর্বত্রই গণতন্ত্রের প্রতি অনাস্থা বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি করে দিল মিশরের ঘটনা। ২০১২ সালের মিশরকে ২০১৩ সালের মিশরই যেন ভুল প্রমাণ করে দিল। বলে দিল, সে বারের ‘মুক্ত’ নির্বাচন একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। অমন আর হয় না, হবে না।
ট্র্যাজেডি ছাড়া আর কী! ট্র্যাজেডি, অবশ্যই। এই এক ধাক্কায় পশ্চিম এশিয়া ও আরব দেশগুলিতে গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা যতটা পিছিয়ে গেল, সেটা বিরাট দুর্ভাগ্য।
তবে একটা কথা। হতাশার পরিমাণটা কিন্তু নির্ভর করে আশার পরিমাণের উপরও। সে দিক দিয়ে এই হতাশাকে খুব বড় হতাশা বলতে পারছি না। গণতন্ত্রের আশা-ভরসাও যে এ ক্ষেত্রে খুব বেশি ছিল না! যতই নির্বাচন হোক, যতই তা ‘ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার’ হোক, কেবল নির্বাচন দিয়েই তো গণতন্ত্র হয় না। সত্যিই গণতন্ত্রে পৌঁছতে গেলে নির্বাচিত নেতাকে গণতান্ত্রিক পথে শাসনও করতে হয়, জিতে আসার পর স্বেচ্ছাচার করলে চলে না। তবে তেমন গণতন্ত্র মিশর কেন, আজ পর্যন্ত এই অঞ্চলের একটি দেশও দেখাতে পারেনি। তুরস্কেও ডাহা ফেল করেছেন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান। তাই, প্রেসিডেন্ট মুর্সি যা করছিলেন, সেটাই বহাল থাকলে গণতন্ত্রের মঙ্গলশাঁখ বাজত, আর সেনা এসে দখল করল বলেই সব শেষ হয়ে গেল, এত বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলা মুশকিল! ইংরেজি একটা কথা আছে, ‘উইন-উইন সিচুয়েশন’: তার অনুসরণে বলা যায় পশ্চিম এশিয়া ও আরব বিশ্বের গণতন্ত্রের অবস্থা একেবারেই ‘লুজ-লুজ’, যে দিকেই যাও, পরাজয়! তবে হ্যাঁ, কেবল নির্বাচনটুকুই কম কী, এই সেনা-অভ্যুত্থান (নাকি সেনা-হস্তক্ষেপ?) না ঘটলে সেটার পথ প্রশস্ত হত মিশরে, এইটুকু বিলাপ নিশ্চয়ই করাই যায়! |