মাস দু’য়েক আগে উচ্চ শিক্ষার্থে ছুটিতে গিয়েছেন একমাত্র চিকিত্সক। দীর্ঘদিন ধরে শূন্য হয়ে পড়ে রয়েছে নার্সের একটি পদও। ফার্মাসিস্ট সপ্তাহে তিন দিন ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দায়িত্ব পালন করতে হয়। এর ফলে চরম অব্যবস্থার মধ্যে চলছে ময়ূরেশ্বর থানার ঢেকা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। চিকিত্সা করাতে এলাকার বাসিন্দাদের তাই ছুটতে হচ্ছে দূর-দূরান্তে। এলাকার স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকেও না থাকায় ক্ষোভ বাড়ছে স্থানীয় জনমানসে।
স্বাস্থ্য দফতর ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বছর ৩০ আগে স্থানীয় হাইস্কুলের দান করা প্রায় তিন বিঘা জমিতে গড়ে ওঠে ঢেকা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। পরবর্তীকালে বিশ্বব্যাঙ্কের অর্থানুকুল্যে তৈরি হয় বিশাল ভবন। শয্যা-সহ এসে পৌঁছয় আনুসঙ্গিক সরঞ্জামও। কিন্তু তা এলাকাবাসীদের কোনও কাজেই লাগেনি বলে অভিযোগ। বর্তমানে বিশ্বব্যাঙ্কের টাকায় নির্মিত ভবনটি কার্যত সাপের বাসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়ার কারণে যন্ত্রপাতির অবস্থাও তথৈবচ। শুধুমাত্র চালু রয়েছে পুরনো বহির্বিভাগের ভবনটি। কিন্তু সেখানেও পরিষেবা মেলে না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বাসিন্দারা। প্রয়োজনীয় ওষুধ পাওয়া তো দূরের কথা চিকিত্সক ও কর্মীর অভাবে বেহাল হয়ে পড়েছে স্বাস্থ্য পরিষেবা। |
ব্লক স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য বরাদ্দ রয়েছেন এক জন করে চিকিত্সক, ফার্মাসিস্ট, দু’জন নার্স, এক জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী ও একজন ঝাড়ুদার। কিন্তু উচ্চ শিক্ষার্থে চলতি বছরের ২ মে থেকে ছুটিতে রয়েছেন একমাত্র চিকিত্সক শুভব্রত মজুমদার। ৫ বছর ধরে শূন্য রয়েছে একজন নার্সের পদও। ফার্মাসিস্ট শঙ্কর সোরেনকে সপ্তাহে তিন দিন সংশ্লিষ্ট ষাটপলশা ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ‘ডিউটি’ সামলাতে যেতে হয়। এর ফলে কার্যত জোড়াতালি দিয়ে চলে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্র। স্বাভাবিক ভাবে এলাকার বাসিন্দারা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপরে ভরসা হারিয়ে ফেলেছেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্র সূত্রে খবর, চিকিত্সক থাকাকালীন দৈনিক গড়ে ৭০-৮০ জন চিকিত্সা করাতে আসতেন। বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩০-৪০ জনে। রামকৃষ্ণপুরের গৌর বাগদি, তিলডাঙার সুনীল পালরা বলেন, “কী হবে শুধু শুধু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে। চিকিত্সক না থাকায় স্বাস্থ্যকর্মীরা তো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একই ওষুধ ধরিয়ে দেন। মাঝখান থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়া আসার হয়রানি এবং সময়টাই নষ্ট হয়।” ফার্মাসিস্ট শঙ্কর সোরেনের কথায়, “কী করব! আমাদের পক্ষে যে-টুকু করা সম্ভব সে-টুকু পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষোভের কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।” ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক রামকৃষ্ণ কর্মকার বলেন, “সত্যিই চিকিত্সকের অভাবে সমস্যা হচ্ছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। নার্স ও ফার্মাসিস্টের অভাব রয়েছে। ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনও ফার্মাসিস্ট নেই। তাই ঢেকা এবং হটিনগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে দু’জন ফার্মাসিস্টকে এনে সপ্তাহে তিন করে কাজ চালাতে হচ্ছে। দেখি অন্য কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে এক জন চিকিত্সককে সপ্তাহে তিন দিন হলেও সাময়িক ভাবে ওখানে পাঠানো যায় কি না।” |
অথচ এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপরে সংশ্লিষ্ট ঢেকা পঞ্চায়েতের ৪২টি গ্রামই নয়, লাগোয়া কলেশ্বর পঞ্চায়েত-সহ মুর্শিদাবাদের বেশ কিছু মানুষ নির্ভরশীল। কিন্তু পরিষেবা না পাওয়ায় তাঁদের ২৫-৩০ কিলোমিটার দূরে কান্দি কিংবা সাঁইথিয়ায় ছুটতে হচ্ছে। মুর্শিদাবাদের মাঝিয়াড়ার জীতেন ঘোষ, গিধিলার ক্ষীরময় মণ্ডলরা বলেন, “সে ক্ষেত্রে আমাদের যাতায়াতের জন্য অনর্থক ৫০০-৭০০ টাকা গুনতে হচ্ছে। অথচ এমন ছিল না স্বাস্থ্যকেন্দ্রের হাল। এক সময় ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকেই জ্বর-জ্বালার পাশাপাশি মিলত ডায়েরিয়া, কীটনাশক খাওয়া এমনকী প্রসূতিরদের চিকিত্সাও।” ঢেকার রমাপতি মণ্ডল, বজরহাটের কাশেমআলি খাঁ বলেন, “সে সময় স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বরে গেলেই কেমন একটা হাসপাতাল সুলভ পরিষেবা চোখে পড়ত। দিনে তো বটেই, প্রয়োজনে রাতের বেলায়ও গলায় ‘স্টেথো’ ঝুলিয়ে ডাক্তারবাবুকে কোয়ার্টার থেকে আউটডোরে যেতে দেখা যেত। সাদা পোশাক পরা নার্সরাও যেতেন হাই হিল জুতো খটখটিয়ে। উপস্থিতি ও আন্তরিকতায় তাঁরা পূরণ করে দিতেন পরিকাঠামোর অভাব জনিত সমস্যা। একে একে সে সব দিন কোথায় যেন হারিয়ে গেল!”
লোকপাড়ার অনাথবন্ধু কোলে, কুলিয়াড়ার তমরেশ ভট্টাচার্যরা ক্ষোভ, “গ্রামের মানুষ ভাল রকমই জানেন প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বড় কিছু চিকিত্সা পরিষেবা পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কীটনাশক খাওয়া, পেটের রোগ বিশেষ করে বর্ষায় ডায়েরিয়ায় গ্রামাঞ্চলে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। এলাকার স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে এই পরিষেবাটুকু পাওয়া না গেলে শুধু শুধু স্বাস্থ্যকেন্দ্র রেখেই বা কী লাভ!” সমস্যার কথা মেনে নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ঢেকা পঞ্চায়েতের বিদায়ী প্রধান কল্যাণী দাসও। তিনি বলেন, “স্বাস্থ্যকেন্দ্রের হাল ফেরানোর জন্য ব্লক এবং জেলা স্বাস্থ্য দফতরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেও কোনও লাভ হয়নি। তাই এলাকার মানুষকে স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে।” জেলা মুখ্যস্বাস্থ্য আধিকারিক কার্তিকচন্দ্র মণ্ডল বলেন, “শুধু ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নয়। এই মুহূর্তে জেলায় বেশ কিছু চিকিত্সকের ঘাটতি রয়েছে। ঘাটতি রয়েছে নার্স ও ফার্মাসিস্টেরও। শূন্য পদ পূরণের জন্য রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের কাছে আর্জি জানানো হয়েছে। বরাদ্দ হলেই ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের শূন্য পদগুলি পূরণের ব্যবস্থা করা হবে।” |