একই যৌগের ওষুধ। কিন্তু কোনওটির দাম আট টাকা তো কোনওটির ৮০ টাকা। এই অসামঞ্জস্য দূর করতে এ বার ওষুধের দাম বেঁধে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। অগস্টের মধ্যেই প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত দাম কমতে চলেছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ওষুধের। এর মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক, হার্টের অসুখ এবং ক্যানসারের ওষুধও রয়েছে। যদিও ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলোর বড় অংশের মতে, এর ফলে মুড়ি-মিছরির তফাৎ থাকবে না। ধাক্কা খাবে গবেষণাও।
ইতিমধ্যেই ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলিকে বাজার থেকে তাদের পুরনো দামের ওষুধ ধীরে ধীরে তুলে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। চূড়ান্ত বিজ্ঞপ্তি জারির এক মাস পরেও যদি কোনও সংস্থা আগের দামে ওষুধ বিক্রি করে তা হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ড্রাগ কন্ট্রোল। ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটির চেয়ারম্যান সি পি শাহ বলেন, “অগস্টের মধ্যে নতুন দামেই সকলে ওষুধ পাবেন বলে আমরা আশাবাদী। ‘প্রয়োজনীয়’ বলে চিহ্নিত প্রায় সব ওষুধের দামই কমছে।”
‘ড্রাগ প্রাইসেস কন্ট্রোল অর্ডার, ২০১৩’ অনুযায়ী দফায় দফায় ওষুধগুলি সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি জারি করছে কেন্দ্রীয় সরকার। আপাতত ২৭২টি ওষুধের তালিকা তৈরি হয়েছে। পরের ধাপে হবে আরও ৭৬টি। একবার দাম নির্দিষ্ট করার এক বছরের মধ্যে কোনও সংস্থাই নতুন করে তাদের দাম বাড়াতে পারবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রের খবর, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ওষুধের দাম নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা করেছিল। সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রকে ওষুধের অনিয়ন্ত্রিত মূল্যে রাশ টানার কথা বলে। তার পরেই ‘বাজারভিত্তিক দর নিয়ন্ত্রণ’-এর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র। |
‘বাজারভিত্তিক দর নিয়ন্ত্রণ’ কী? স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রে খবর, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় একই যৌগ বা কম্পোজিশনের ওষুধ অপেক্ষাকৃত ছোট সংস্থা অনেক কম দামে বেচে। কিন্তু নামী সংস্থার একই ওষুধের দাম আকাশছোঁয়া। কেন্দ্র এ বার সমস্ত দাম খতিয়ে দেখে একটা গড় দাম নির্দিষ্ট করে দেবে। এতে যে সংস্থার ওষুধের দাম কম, তাদের বাড়ানোর কোনও উপায় থাকবে না। কিন্তু যাদের দাম বেশি, তাদের দাম অনেকটাই কমে যাবে।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রের খবর, ক্যানসারের বিভিন্ন ওষুধে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত দাম কমতে চলেছে। অ্যান্টিবায়োটিকে ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত দাম কমছে এবং হার্টের অসুখের ওষুধের দাম কমছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। যক্ষ্মার ওষুধে কমছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। যার মানে, বাজারচলতি যে অ্যান্টিবায়োটিকের তিনটি ওষুধের একটি পাতার দাম এখন ৯৯ টাকা, সেটি কমে হবে হচ্ছে ৫৯ টাকা। হার্টের অসুখের যে ওষুধের এক পাতার দাম ৮০ টাকা, তার দাম হবে ৪৫ টাকা। ক্যানসারের কেমোথেরাপির যে ওষুধের একটি কোর্সের দাম ২৫ হাজার টাকা, তা কমে হওয়ার কথা ১৬ হাজার টাকা।
তবে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ আসার পর থেকেই বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থার কর্তা এ ব্যাপারে তাঁদের অসন্তোষের কথা জানিয়ে আসছিলেন। এক সংস্থার আঞ্চলিক কর্তা বলেন, “এর ফলে গবেষণার দিকটি মারাত্মক ধাক্কা খাবে। মুড়ি-মিছরির এক দর হলে কোনও সংস্থাই আর উন্নত মানের ওষুধ তৈরির জন্য গবেষণায় আগ্রহী হবে না।” অন্য এক সংস্থার ভারতীয় শাখার প্রধানের কথায়, “এতে কিছু ছোট সংস্থা হয়তো সন্তুষ্ট হবে। কিন্তু বড় সংস্থাগুলিকে বাধ্য হয়ে মানের সঙ্গে আপস করতে হতে পারে।”
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক অবশ্য এই বক্তব্যকে বিশেষ আমল দিতে রাজি নয়। তাদের বক্তব্য, বিভিন্ন সংস্থা তাদের খুশি মতো দাম বাড়িয়ে চলায় চিকিৎসার ব্যাপারটা ক্রমশ কিছু মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছিল। সেই কারণেই সরকার বাধ্য হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, “এক-একটি ওষুধের পিছনে সংস্থাগুলির যে পরিমাণ লাভ থাকে, তা অকল্পনীয়। তাই দাম বেঁধে দেওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না।” এর আগে ইন্দিরা গাঁধীর আমলে ওষুধের গুরুত্ব অনুযায়ী দামের চার রকম শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছিল। প্রথম শ্রেণিতে ছিল, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওষুধগুলি। এই ওষুধগুলির ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচের উপরে ৭৫ শতাংশের বেশি লাভ রাখা যাবে না বলে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় শ্রেণির ওষুধগুলির ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচের সঙ্গে ১০০ শতাংশ লাভ থাকত, তৃতীয় ভাগে ২০০ শতাংশ লাভ এবং চতুর্থ ভাগে যথেচ্ছ লাভের সুযোগ থাকত। রাজীব গাঁধীর আমলে ওষুধের দাম ফের ঢেলে সাজা হয়। এ বার নিয়ন্ত্রিত এবং অনিয়ন্ত্রিত, এই দু’টি ভাগে ভাগ করা হয় সমস্ত ওষুধকে। ৭৪টি ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল সে বার। ১৯৯৫ সালে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে ফের একটি নির্দেশিকা জারি করে কেন্দ্রীয় সরকার। সেখানে ৭৫টি ওষুধের দাম বেঁধে দেওয়া হয়। ওষুধ বিক্রেতা সংস্থা বেঙ্গল কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক তুষার চক্রবর্তী বলেন, “ওই ওষুধগুলির মধ্যে ৪৮টি ওষুধ এখন পাওয়া যায় না। তা হলে দাম বেঁধে দিয়ে লাভটা কী হল? বরং রোগীদের ক্ষতি হচ্ছে। কারণ বহু ওষুধ তাঁরা পাচ্ছেন না।”
ওষুধের দাম সাধারণ মানুষের নাগালে আনতে পশ্চিমবঙ্গ-সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যের সরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান চালু হয়েছে। এ বার কেন্দ্রের নির্দেশ তাকেই আরও পোক্ত করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অন্য দিকে ওষুধের দাম নিয়ে আন্দোলন করছে যে সব স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, তাদের বক্তব্য, দাম কমানোর এই প্রয়াস আদতে ক্রেতার চোখে ধুলো দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। এমন একটি সংস্থার তরফে ফার্মাকোলজিস্ট স্বপন জানা বলেন, “ন্যায্য মূল্যের দোকানে যে ছাড়ের কথা বলা হয়, আদতে সেই ছাড়েই পাইকারি বাজারে ওষুধ পেতেন বহু মানুষ। ওষুধের গায়ে ‘ম্যাক্সিমাম রিটেল প্রাইস’ অনেক বেশিই লেখা থাকে। তা থেকে ছাড় দিয়েই বিক্রি হয়। এ ক্ষেত্রেও সেই দামেই পাওয়া যাবে। তার চেয়ে বাড়তি কোনও সুবিধা হবে না।” |