প্রচারে নদীর কথা তুলছেন না কেউই
ভোট আসে, ভোট যায়। নদী মরে যায় নিঃশব্দে।
কোথাও নদীর বুকে রমরমিয়ে চলছে চাষআবাদ। কোথাও তৈরি হচ্ছে বসত বাড়ি। আর মাটি মাফিয়াদের তান্ডব গা সওয়া হয়ে গিয়েছে সকলেরই। ভূতাত্ত্বিক কিছু কারণের পাশাপাশি মানুষের মাত্রা ছাড়া অত্যাচারে পদ্মার শাখানদী ভৈরব কিংবা জলঙ্গী ক্রমশ মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ছে। অভিযোগ, সবকিছু জেনেও প্রশাসন নির্বিকার।
নির্বাচনের আগে বিভিন্ন বিষয়ে নিয়েই সরব হন রাজনৈতিক দলগুলি। উঠে আসে নানা প্রসঙ্গ। কিন্তু নদী কেন কখনও ভোটের প্রচারে তেমন গুরুত্ব পায় না? জেলার বহু গ্রাম পঞ্চায়েতকেই ছুঁয়ে গিয়েছে জলঙ্গী, মাথাভাঙা কিংবা ভৈরব! এই নদীর উপরেই নির্ভর করে থাকেন বহু মানুষ! নদীর করুণ চেহারার কথাও জানেন সকলেই! অথচ প্রচারে সেই নদীর কথাই বেমালুম ভুলে গেল রাজনৈতিক দলগুলো? নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র মনে করেন, “সেটাই তো স্বাভাবিক। নদী তো আর ভোটার নয়! কিন্তু নদীর বুকে যাঁরা বাড়ি কিংবা চাষআবাদ করছেন তাঁরা তো ভোটার। ফলে নদী নিয়ে সরব হলে তো ভোট কমবে বই বাড়বে না।” কিন্তু সম্প্রতি উত্তরাখণ্ডের অভিজ্ঞতাই বুঝিয়ে দিয়েছে, নদী সম্পর্কে অসচেতনতার বা অবহেলার ফল কতটা মারাত্মক হতে পারে। নদী কী ভাবে ভাসিয়ে দিতে পারে জনপদ। ভরা আষাঢ়েও তাই যখন বেশিরভাগ নদীর বুকে জলের দেখা মেলে না, অনেক নদী পড়ে থাকে হাঁটু জলে, তখন বিপদের কথা আরও বেশি করে মনে হয়। ক্রমশ শুকিয়ে যাওয়া এই নদীগুলি পরে ভারী বর্ষার জল ধারণে অক্ষম হয়ে উঠবে। আর তাতেই ভাসতে পারে বাসভূমি।
কোথাও নদীতেই চলছে চাষ।
প্রায় চোখের সামনেই যার যেখানে যেমন ক্ষমতা, সে ভাবেই দখল হয়ে যাচ্ছে নদী। কোথাও নদীর উপরে মাটি ফেলে তৈরি হচ্ছে রাস্তা। কোথাও নদীতে বাঁধ দিয়ে চলছে মাছ চাষ। কোথাও অর্ধসমাপ্ত সেতুর নীচে নদীতে ডাঁই করে রাখা মাটি তোলার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে কোনও ঠিকাদারি সংস্থা। তেহট্ট মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকায় কোথাও কোথাও নদী এখন খেতি জমি! কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করেই মাঝ নদীতে এখন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক মানুষ সমান পাট। অভিযোগ, যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে তখন তাদের মদতেই নদী দখল করেছে কিছু মানুষ। নদীকেও ব্যবহার করা হচ্ছে ভোটের স্বার্থেই।
তাই ভোট প্রচারে বেরিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচারে উঠে আসছে স্থানীয় সমস্যার সাতকাহন, নদী থেকে যাচ্ছে ব্রাত্য। তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত বলছেন, “আমরা পরিবেশ বান্ধব উন্নয়ন চাই। পাশাপাশি কাউকে উত্‌খাত করাও আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা প্রচারে গুরুত্ব দিচ্ছি এটাই যে, কী ভাবে গত ৩৪ বছরে বাম জমানায় এই রাজ্য পিছিয়ে পড়েছে, আর আমাদের সরকারের আমলে মাত্র আড়াই বছরে রাজ্যের কি উন্নয়ন হয়েছে।” জেলা কংগ্রেসের সভাপতি শঙ্কর সিংহ বলেন, “এই সরকারের কাছ থেকে কোনও কিছুই আশা করা যায় না। নদী নিয়ে প্রচুর সমস্যা রয়েছে, কিন্তু এই সরকার কিছুই করছে না।” আর সিপিএমের জেলা সম্পাদক সুমিত দে বলছেন, “নদী নিয়ে সমস্যা রয়ে গিয়েছে। প্রশাসনেরও যেমন দেখা উচিত, আমাদেরও দায় থেকে যায়। আমাদের উচিত মানুষকে সচেতন করা। আমরা করছিও।”
আবার কোথাও নদী বুজিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে।
সুমিতবাবু স্বীকার করেন, “পঞ্চায়েতের প্রচারে এই বিষয়টিকে আরও গুরুত্ব দিয়ে বলা উচিত ছিল, কিন্তু আমরা তা করিনি। তবে এ বার থেকে করব। সে কথা আমাদের দলের সকলকে বলেওছি।”
সাধারণ মানুষেরও বক্তব্য, পঞ্চায়েত ভোটে যেহেতু একেবারে ঘর ও পাড়ার সমস্যাও নির্বাচনী প্রচারের বিষয় হয়ে ওঠে, তাই নদী সংক্রান্ত সমস্যাগুলিও প্রচারে উঠে আসতে পারত। মফস্‌সলের বিদ্বজ্জনেরাও সে কথাই মনে করেন। জলঙ্গি বাঁচাও কমিটির সম্পাদক প্রলয় ভট্টাচার্যের কথায়, “পঞ্চায়েত ভোটের মঞ্চ একটি ভাল প্রচারের জায়গা। সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলি যদি নদী নিয়ে সেই মঞ্চে কথা বলতেন, তা হলে সচেতনতা অনেক বাড়ত। সেই সঙ্গেই, প্রশাসনের নজরও পড়ত।” করিমপুর বইমেলা কমিটির সম্পাদক সন্দীপ ঘোষের কথায়, “প্রচারে এসে ননীকে দখলমুক্ত করা হবে বা তার সংস্কার করা হবে ধরনের প্রতিশ্রুতি দিলে রাজনৈতিক দলগুলির একটা দায়বদ্ধতাও তৈরি হয়। সেইটুকুও খুবই জরুরি।”

নদী বিশেষজ্ঞের মত

নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের আক্ষেপ রাজনীতিতে নদী বরাবরই ব্রাত্য। তিনি জানান, ভারতবর্ষ নদীমাতৃক দেশ। অথচ আমাদের দেশে কোনও নদী মন্ত্রী নেই আজও। নদীর বিষয়টা সেচ দফতরের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে দায় সারা হয়েছে। সেই অর্থে বলতে গেলে নদী কার্যত অভিভাবকহীন। এই দেশে নদীর উপরে যে ভাবে অত্যাচার করা হয়, পৃথিবীর কোনও সভ্য দেশে তা হয় না। কল্যাণবাবুর কথায়, “গত কয়েক শতাব্দীতে পদ্মার খাত ক্রমশ গভীর হওয়ায় শাখানদীগুলো বর্ষাকাল ছাড়া পদ্মা থেকে জল পায় না। এদিকে জলঙ্গির উত্‌সমুখও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। জলঙ্গি নদীর এখন ভরসা বলতে বৃষ্টি, ভৈরবের জল ও মাটির নীচের জল! শুধু জলঙ্গী একা নয়, একই ভাবে সংকটে রয়েছে ভৈরব, মাথাভাঙা, চূর্ণী, অঞ্জনাও। প্রতিনিয়ত অত্যাচারের ফলে নদীর বহমানতার পাশাপাশি দৃষিত হচ্ছে নদীর জল! অথচ বর্ষার সময় এই নদীগুলোই কিন্তু অতিরিক্ত জল বহন করে বন্যার হাত থেকে আমাদের বাঁচায়। নদী নিয়ে যদি আমরা এখনও সচেতন না হই, তাহলে ফল কিন্তু মারাত্মক হতে পারে।’’ তেহট্টের মহকুমাশাসক সুদীপ্ত ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘প্রশাসনের কড়া নজরদারিতে মাটি মাফিয়াদের অত্যাচার অনেকটাই কমে গিয়েছে! নদীর উপরে চাষআবাদ বা বাড়ি তৈরির বিষয়টিও প্রশাসনের নজরে এসেছে। অবিলম্বে সেই বিষয়ে ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। আর মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন এলাকায় সেমিনার করে নদী নিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার একটা পরিকল্পনাও করা হচ্ছে।’’ কিন্তু মানুষ চান, ভোটের বাজারে নদীর কথা উঠলে তা সংস্কারের জন্য বদ্ধ স্রোত কেটে যেত অনেকটা।
—নিজস্ব চিত্র।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.