বুদ্ধগয়ায় বিস্ফোরণ, আহত ২ সন্ন্যাসী
ভোরের আলো তখনও ভাল করে ফোটেনি। সকাল তখন সাড়ে পাঁচটা। একের পর এক বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল বুদ্ধগয়ার মহাবোধি মন্দির চত্বর। বারুদের দাগ পড়ল মন্দির চত্বরে বুদ্ধদেবের ৮০ ফুট উঁচু মূর্তিতেও। বুদ্ধদেব যেখানে বোধি (জ্ঞান) লাভ করেছিলেন, সেই বোধিবৃক্ষের সামনে বোমার আঘাতে গুরুতর জখম হলেন দুই বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। শান্তিকামী সন্ন্যাসীদের উপাসনাগৃহে লাগল রক্তের ছোঁয়া।
সব মিলিয়ে আধ ঘণ্টা। তার মধ্যেই বৌদ্ধদের পবিত্রতম তীর্থস্থানগুলির অন্যতম বুদ্ধগয়া জুড়ে তীব্র আতঙ্কের ছায়া। বুদ্ধগয়ায় জঙ্গি হানার খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল দেশে-বিদেশে। তড়িঘড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। বুদ্ধমন্দির ঘুরে দেখার পর তিনি বলেন, “এনআইএ তদন্ত করবে। মন্দিরে নিরাপত্তার সমস্ত ব্যবস্থা ছিল। তা-ও কী ভাবে এই ঘটনা ঘটল, তা দেখা হচ্ছে।” এ দিনের পরে বুদ্ধগয়ার নিরাপত্তার দায়িত্ব সিআইএসএফ-এর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য কেন্দ্রকে তিনি অনুরোধ করবেন বলেও জানিয়েছেন নীতীশ।
বিস্ফোরণের পরে। রবিবার বুদ্ধগয়ার মহাবোধি মন্দিরে।
সন্ধ্যাতেই দিল্লি থেকে এনআইএ-র পাঁচ সদস্যের দল বুদ্ধগয়া পৌঁছয়। ডিআইজি (স্পেশাল ব্র্যাঞ্চ) পরশনাথ জানিয়েছেন, ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরু করে দিয়েছেন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ইতিমধ্যেই এক জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাজ্য পুলিশের ডিজি অভয়ানন্দ।
বিস্ফোরণের অল্প ক্ষণের মধ্যেই মন্দির চত্বরের দখল নেয় বিশাল পুলিশ বাহিনী। তদন্তে নেমে পুলিশের বক্তব্য, বিস্ফোরকগুলি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন না হওয়ায় মন্দির বা বুদ্ধদেবের মূর্তির কোনও ক্ষতি হয়নি। প্রাণহানিও ঘটেনি। গোটা বিশ্বের নজর টানতেই এই বৌদ্ধ তীর্থস্থানে হামলার ছক করা হয়েছিল বলে অনুমান গোয়েন্দাদের। রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইন-শৃঙ্খলা) এস কে ভরদ্বাজের কথায়, “মহাবোধি মন্দিরে জঙ্গি হামলা হতে পারে, ৬-৭ মাস আগে এমন সতর্কবার্তা আমরা পেয়েছিলাম। তার জেরে মন্দিরে নিরাপত্তা কঠোর করা হয়েছিল। মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত বাহিনী। কিন্তু তার পরেও এমন ঘটনা কী ভাবে ঘটল, খুঁজে বার করা দরকার।” মহাবোধি মন্দিরে দর্শনার্থীদের প্রবেশ আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, বুদ্ধগয়ায় বিস্ফোরণের পরে পটনার মহাবীর মন্দিরের নিরাপত্তাও বাড়ানো হয়েছে। ইতিমধ্যেই কেন্দ্র বিভিন্ন রাজ্যকে সতর্ক করেছে। দেশের একাধিক মন্দির ও ধর্মস্থানের নিরাপত্তা আঁটোসাঁটো করা হয়েছে।
আহত বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। রবিবার বুদ্ধগয়ায়।
ঠিক কী হয়েছিল এ দিন সকালে?
ঘড়িতে তখন ভোর সাড়ে ৫টা। কিছু ক্ষণ আগেই বোধিবৃক্ষের সামনে থেকে ধ্যান করে উঠেছেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী শীলা রক্ষিত। বছর চল্লিশের ওই সন্ন্যাসীর কথায়, “আচমকা প্রচণ্ড জোরে কিছু ফাটার শব্দ হল। বোধিবৃক্ষের আশপাশ কালো ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম জেনারেটরে কিছু সমস্যা হয়েছে। পোড়া বারুদের গন্ধ পেলাম হঠাৎ। সেই সঙ্গেই পরপর আরও বিস্ফোরণ। বুঝলাম, বড় অঘটন ঘটেছে।”
আধ ঘণ্টার মধ্যে পরপর ন’টি বিস্ফোরণ। পুলিশ সূত্রের খবর, বোধিবৃক্ষের সামনে প্রথম বিস্ফোরণে তিব্বতের তেনজি দোরজে এবং মায়ানমারের ভীলা সাগা নামে দু’জন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী গুরুতর জখম হন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পরের বিস্ফোরণ হয় বুদ্ধের মূল মন্দির থেকে ১০-১৫ ফুট দূরে রত্নগিরিতে। যে কাঠামোর উপরে ভক্তরা বুদ্ধদেবের উদ্দেশে মোমবাতি জ্বালান সেই কাঠামোটি কেঁপে ওঠে। বিস্ফোরণের সেই শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই একের পর এক বোমা ফাটে মূল মন্দিরের সামনে, কর্মাপা মন্দিরে, মন্দির চত্বরে থাকা যাত্রীবিহীন একটি বাসে, মূল মন্দিরের কাছের ফাঁকা মাঠে। এর পরেই বুদ্ধমূর্তিতে পরপর দু’টি বিস্ফোরণ হয়। বুদ্ধমূর্তির পায়ের নীচে পদ্মের ফাঁকে তিনটি বোমা লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত একটি ফাটেনি। পুলিশ জানায়, দুপুরের দিকে মন্দিরের কাছে একটি হোটেলের পাশ থেকে আরও একটি তাজা বোমা উদ্ধার করা হয়।
মহাবোধি মন্দিরের কাছে চলছে তদন্ত।
বুদ্ধদেবের বোধি অর্জনের প্রাণকেন্দ্র বুদ্ধগয়া আন্তর্জাতিক তীর্থস্থান। চিন, জাপান, শ্রীলঙ্কা-সহ প্রায় সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকেই সারা বছর এখানে ভিড় জমান ভক্তরা। ইউনেস্কো-র ‘হেরিটেজ’ হিসেবে চিহ্নিত শান্তির ওই মন্দিরে জঙ্গি হামলা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, বুদ্ধগয়ার মন্দিরের বাইরে ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকেন রাজ্য পুলিশের ‘কাউন্টার ইনসারজেন্সি অ্যান্টি-টেররিজম স্কোয়াড’-এর ১৩ জন জওয়ান। মন্দিরের ভিতরে নজরদারিতে মোতায়েন থাকেন বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মীরা। সকলের চোখ এড়িয়ে এত বিস্ফোরক মন্দির চত্বরে কী ভাবে ঢুকল, তা নিয়েও ধন্দ তৈরি হয়েছে।
মহাবোধি মন্দিরে বিস্ফোরণের নিন্দা করেছেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপক্ষে। একাধিক ধর্মীয় সংগঠন ও দেশের তরফেও এই আক্রমণে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। মহাবোধি মন্দিরে জঙ্গি হামলা নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনীতিও। বিজেপি আগাগোড়াই নীতীশকে নিশানা করেছে। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘটনার নিন্দা করার পাশাপাশি নীতীশকেও আক্রমণ করেছেন। জঙ্গিদের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি দিয়ে বিজেপি নেত্রী সুষমা স্বরাজ বলেছেন, আর একটা বামিয়ান হতে দেব না। নীতীশের ‘ব্যর্থতা’র দিকে আঙুল তুলে লালুপ্রসাদের আরজেডি আগামী কাল মগধ বন্ধের ডাক দিয়েছে। মহাবোধি মন্দিরের সন্ন্যাসীদের নজর অবশ্য এ সবে নেই। বিস্ফোরণে গুরুতর আহত দুই সন্ন্যাসী আপাতত বিপন্মুক্ত চিকিৎসকদের থেকে এই বার্তা পাওয়ার পরেই তাঁরা মন্দির চত্বর পবিত্র করার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। সন্ন্যাসীরা জানিয়েছেন, সকলের শান্তি ও মুক্তির জন্য তাঁরা দ্রুত প্রার্থনা শুরু করে দিতে চান। আতঙ্ক কাটিয়ে শান্তির মন্দির খুব দ্রুত পুরনো চেহারায় ফিরবে বলেই আশাবাদী তাঁরা।

ছবি: পিটিআই

এই সংক্রান্ত খবর...


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.