জেলায় জেলায় একই ছবি
তেভাগার শহিদ বেদি কাঁটাগাছের ঝোপে ঘেরা
হরের রাস্তায় বেরিয়েছে একটি রাজনৈতিক দলের মিছিল। হাতে দলীয় পতাকা আর প্রতিপক্ষ দলের মুণ্ডপাত করা প্ল্যাকার্ড। গলার শিরা ফুলিয়ে ছেলে-বুড়ো মুহূর্মুহূ স্লোগান তুলছেন, ‘শহিদের রক্ত/ হবে নাকো ব্যর্থ’। মিছিলে থাকা বছর কুড়ি-বাইশের এক তরুণের কাছে শহিদদের নাম জানতে চাইতেই লজ্জা পেয়ে গেল ছেলেটি। কিছুক্ষণ পরে বলল, “আমি না ঠিক জানি না!”
পরে ওই রাজনৈতিক দলেরই এক প্রবীণ নেতা বলেছিলেন, “এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। রাজনীতিতে নেমে ক’জনই বা দলের শহিদদের নাম মনে রাখে?” এটাই বাস্তব। পাড়ায় পাড়ায় তৈরি হওয়া কোনও এককালে তৈরি হওয়া লাল কিংবা তেরঙ্গা শহিদ বেদিগুলিও তাই আজ অবহেলায় পড়ে। কোথাও ধুলো-ময়লায় ঢাকা, কোথাও বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকেছে শহিদ বেদি। কোথাও বেদিগুলি ব্যবহার করা হয় দোকানের পসরা সাজাতে, আবার কোথাও আড্ডা দেওয়ার জন্য। অধিকাংশ শহিদ বেদিই আজ কাপড় শুকোনোর জায়গা। কোনও কোনও এলাকায় অবশ্য বছরে একবার শহিদবেদি ঝাড়পোঁচ করে মাল্যদান জাতীয় কর্মসূচি নেওয়া হয়। বাকি সময় তা পড়ে থাকে অযত্নে।
তেভাগা আন্দোলনে উত্তাল হয়েছিল উত্তর চব্বিশ পরগনার সন্দেশখালি ২ ব্লকের এক নম্বর বেড়মজুর গ্রাম।

অযত্নে। মেদিনীপুর শহরের পঞ্চুরচক গ্রামে। সৌমেশ্বর মণ্ডলের তোলা ছবি।
জমিদারের লাঠি, গুলিতে রতিরাম সর্দার, রবিরাম সর্দার, চামু বিশাল, পারুল সর্দার, বাতাসি সর্দার-সহ ওই গ্রামের অনেকে শহিদের মৃত্যুবরণ করেছিলেন। বেড়মজুরের কাছারি বাড়ির ফেরিঘাটে যাওয়ার রাস্তার পাশে তৈরি হয়েছিল তেভাগা আন্দোলনের শহিদ বেদি। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেই বেদির আশেপাশে এখন শুধুই কাঁটাগাছের জঙ্গল। ভেঙে গিয়েছে বেদিও। পাশেই রয়েছে তেভাগা আন্দোলনের স্মৃতিতে তৈরি লম্বা স্তম্ভ। সেটির অবস্থাও শোচনীয়। ভেঙে গিয়েছে সিমেন্ট রডে ঢালাই করা স্তম্ভের মাথায় থাকা কাস্তেও।
তেভাগা আন্দোলনকে আজও নানা সময়ে হাতিয়ার করে বাম দলগুলি। অথচ সেই আন্দোলনের স্মৃতিতে তৈরি শহিদ বেদি সংস্কারের উদ্যোগ দেখা যায়নি তাদের তরফে। তেভাগা আন্দোলনে শহিদ পরিবারগুলির কেউই আর ওই গ্রামে থাকে না। স্থানীয় ‘দুলদুলি সুন্দরবন ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক, পেশায় শিক্ষক কালিকানন্দ মণ্ডল বলেন, “শহিদ বেদিগুলির সংস্কার প্রয়োজন। আত্মত্যাগী মানুষের ইতিহাস এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জানা দরকার।’’
১৯৬৭ সালের খাদ্য আন্দোলনে শহিদ হন সুনীল পোদ্দার, সমর ঘোষ ও বংশীবাগ সাঁধুখা। নবদ্বীপের পোড়া মা তলায় রয়েছে তাঁদের শহিদ বেদি। কিন্তু সে বেদি এখন বিজ্ঞাপনে ঢাকা। চারপাশের হোর্ডিং ও সাইনবোর্ডের গুঁতোয় দেখাই যায় না পাঁচ ফুটের ওই শহিদবেদিকে। নবদ্বীপ শহরে এর পরেও খুন হয়েছেন একাধিক রাজনৈতিক কর্মী। রানাঘাটে তেমনই এক নিহত সিপিএম কর্মীর বাড়ির কাছে তৈরি হওয়া শহিদ বেদি ভেঙে গিয়েছে রাস্তা তৈরির সময়। ওই কর্মীর রাজনৈতিক দল নতুন করে বেদি তৈরি করেনি।

সন্দেশখালি ২ ব্লকের এক নম্বর বেড়মজুর গ্রামে। নির্মল বসুর তোলা ছবি।
সিপিএম নেতা তথা প্রাক্তন মন্ত্রী মোহন্ত চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এটা ঠিক উদাসীনতা নয়। অনেক সময়ই সরকারি জায়গায় শহিদ বেদি হওয়ায়া তার দেখভাল দলের তরফে করা হয়ে ওঠে না। তবে, শহিদের মৃত্যু বা জন্মদিবসে বেদি পরিষ্কার করে অনুষ্ঠান করি।” বর্তমান সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিমত, “শহিদ বেদি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের। কিছু ক্ষেত্রে অবহেলার ঘটনা ঘটছে। শহিদ বেদির পবিত্রতা রক্ষায় সচেতন সব দলেরই সচেতন হওয়া উচিত।”
সচেতন হতে ঠিক কত সময় লাগা উচিত? প্রশ্ন মেদিনীপুর শহরের বাসিন্দাদের। নব্বইয়ের দশকে ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে এই শহরের কলেজ মোড়ে তৈরি হয় ইন্দিরা ও রাজীব গাঁধীর মূর্তি। আপাতদৃষ্টিতে বেশ পরিষ্কার রয়েছে ওই দু’টি বেদি। কিন্তু, সামনে গেলে দেখা যাবে ইন্দিরার মূর্তির নীচে লেখা রয়েছে রাজীব গাঁধী। আর রাজীবের মূর্তির তলায় লেখা তাঁর মায়ের নাম। এক দশকের বেশি সময় পরেও শোধরানো হয়নি এই ভুল।
কেন এই অবহেলা, উদাসীনতা?
নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, “সাধারণভাবে শহিদ বেদি তৈরির সময় কাজ করে আবেগ। সময়ের সঙ্গে সেই আবেগ যত কমে আসে, বাড়ে ঔদাসীন্য।” প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের মতে, “এই অবহেলা মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফল। আমরা ব্যস্ততায় অতীত সহজেই ভুলে যাই।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.