কৃষকদের হাতে অর্থ বা চাষের উপকরণ তুলে দিয়ে রাজ্যে সবুজ বিপ্লবের গতি ত্বরান্বিত করতে চেয়েছিল পরিবর্তনের সরকার। সেই নীতিতে আপত্তি তুলে দিল্লি ওই খাতে রাজ্যের বরাদ্দ অর্ধেক করে দিয়েছে!
পূর্ব ভারতের সাত রাজ্যে কৃষিতে সবুজ বিপ্লব আনার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সরকার তিন বছর আগে প্রকল্পটি চালু করেছে। মূল উদ্দেশ্য: রাজ্যগুলোয় এমন ভাবে কৃষি-ব্যবস্থার সংস্কার করা, যার ফল হবে সুদূরপ্রসারী। অথচ পশ্চিমবঙ্গ সেই আসল লক্ষ্য অর্জনের দিকে গুরুত্ব দেয়নি বলে কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রকের অভিযোগ। মন্ত্রকের বক্তব্য: প্রকল্প রূপায়ণের যে প্রস্তাব রাজ্য জমা দিয়েছে, তাতে চাষিদের হাতে সরাসরি কিছু অর্থ বা কৃষি-সরঞ্জাম পৌঁছে দেওয়ার কথাও রয়েছে। কিন্তু দিল্লি মনে করছে, এতে চটজলদি
কিছু সুবিধা মিললেও কৃষি-পরিকাঠামোর সার্বিক উন্নতি অসম্ভব। তাই মন্ত্রক রাজ্যকে জানিয়ে দিয়েছে, সবুজ বিপ্লব প্রকল্পের টাকায় কৃষকদের হাতে অর্থ বা উপকরণ তুলে দেওয়া যাবে না। রাজ্য বরং নিজেদের পরিকল্পনা বরাদ্দের টাকায় ওই কাজ করুক।
শুধু তা-ই নয়, গত ৩০ মে কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রকের শস্য শাখার অধিকর্তা রিনা সাহা রাজ্যের কৃষি-অধিকর্তা পরিতোষ ভট্টাচার্যকে চিঠি লিখে বলেছেন, নীতি-নির্দেশিকা (গাইডলাইন) পুরোপুরি না-মেনে প্রকল্প-প্রস্তাব পাঠানোর দরুণ সবুজ বিপ্লব খাতে রাজ্যের বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হবে। মন্ত্রকের যুক্তি: রাজ্যের পাঠানো প্রকল্পে যে সব কাজের কথা বলা হয়েছে, তার প্রায় অর্ধেক গাইডলাইন মেনে প্রস্তুত হয়নি। তাই বরাদ্দও ছেঁটে অর্ধেক করে দেওয়া হচ্ছে। মহাকরণের খবর: চলতি অর্থবর্ষে সবুজ বিপ্লব প্রকল্প খাতে কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের দাবি ছিল তিনশো কোটি টাকা। মন্ত্রক জানিয়েছে, বড়জোর মিলবে দেড়শো কোটির কিছু বেশি। বরাদ্দ ছাঁটাইয়ের সঙ্গে সাজুয্য রেখে রাজ্যকে নতুন ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ পাঠাতে বলেছে দিল্লি।
রাজ্য ঠিক কী করতে চেয়েছিল, যার জেরে বরাদ্দে এ হেন কোপ?
কৃষি দফতরের খবর: দিল্লিতে পাঠানো প্রস্তাবে যে সব কাজের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে ফসফরাস ও পটাশ সার কিনতে চাষিদের ভর্তুকি, উচ্চ ফলনশীল বীজ কিনতে বাড়তি অর্থ প্রদান, বোরো ধান ও গম চাষের আংশিক খরচ বহন, চাষিদের কোদাল-বেলচা কেনার টাকা দেওয়া, জল সংরক্ষণ, বৃষ্টির জল ধরে রাখা ইত্যাদি। চাষবাস সংক্রান্ত প্রচারের স্বার্থে কৃষিমেলা বা বই প্রকাশের পরিকল্পনাও ঠাঁই পেয়েছিল সবুজ বিপ্লবের প্রকল্প-প্রস্তাবে। উপরন্তু ধান-চাল সংগ্রহের কাজে প্রকল্পের টাকা ব্যবহারের কথা ছিল। কেন্দ্র সবই নাকচ করে দিয়েছে।
এমন সব প্রস্তাব পাঠানোই বা হল কেন?
রাজ্যের কৃষি-সচিব সুব্রত বিশ্বাস এতে অস্বাভাবিক কিছু দেখছেন না। বরং বলছেন, “এটা হতেই পারে। আপাতত আমরা কেন্দ্রীয় বরাদ্দ মেনে খরচ করব। আরও টাকা লাগলে আরও চেয়ে নেওয়া হবে। উদ্বেগের কিছু নেই।” কৃষিমন্ত্রী মলয় ঘটক বলেন, “প্রথম দফায় যা চেয়েছি তা না পেলেও কাজ করলে পরে আবার টাকা পাব বলেই আমাদের বিশ্বাস।” কেৃষি-আধিকারিকদের একাংশ অবশ্য সচিবের সঙ্গে সহমত নন। তাঁদের যুক্তি, ২০১১-১২ অর্থবর্ষে সবুজ বিপ্লব প্রকল্পটি চালু হওয়ার পরে প্রথম বার সাত রাজ্যের জন্য কেন্দ্র বরাদ্দ করেছিল চারশো কোটি টাকা, যার ৭২ কোটি পেয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ। ২০১২-১৩ সালে কেন্দ্রীয় বাজেটে সাত রাজ্যের মোট বরাদ্দ ছিল হাজার কোটি। রাজ্যের বরাদ্দও বেড়ে দাঁড়ায় ২৬৯ কোটিতে। আর সেই হিসেবে চলতি অর্থবর্ষের জন্য কেন্দ্রের কাছে তিনশো কোটি টাকার প্রকল্প-প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়েছিল। “এখন দেখা যাচ্ছে, তার অর্ধেকই দিতে দিল্লি নারাজ! “একে স্বাভাবিক ঘটনা বলব কী করে?” মন্তব্য এক কর্তার।
সবুজ বিপ্লব প্রসঙ্গে রাজ্যের বিরুদ্ধে কেন্দ্রের অন্য অভিযোগও আছে। যেমন, গত বার মঞ্জুর হওয়া কিছু প্রকল্পের অর্থ অন্য খাতে খরচ। সেই ঐতিহ্য এ বারেও অব্যাহত রয়েছে বলে ইঙ্গিত মিলেছে।
কী রকম?
দফতর-সূত্রের খবর: সম্প্রতি পশ্চিম মেদিনীপুরে হড়পা বানে ছ’টি ব্লকের হাজার কুড়ি চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। রাজ্য সরকার স্থির করেছে, ক্ষতিগ্রস্ত জমির জন্য হেক্টরপিছু ছ’হাজার টাকা হারে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, যা কিনা সরাসরি চলে যাবে চাষিদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। নিয়ম অনুযায়ী, ওই অর্থ আসার কথা বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের তহবিল থেকে। কিন্তু ‘দ্রুত বণ্টনের’ তাগিদে সবুজ বিপ্লব প্রকল্পেরই তহবিল ভেঙে ৯ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। “দিল্লির কড়া অবস্থানের পিছনে এ সবেরও ভূমিকা থাকলে আশ্চর্য কী?” মন্তব্য রাজ্যের এক কৃষি-কর্তার। |