|
|
|
|
ভোট প্রচারেও কমিশনকে দুষলেন মমতা
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
আদালত-পর্ব শেষ। তবু বজায় রইল রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে শাসকদলের টক্কর।
পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে শনিবার নির্বাচন কমিশনের ডাকা সর্বদল বৈঠকে গেল না শাসকদল তৃণমূল। শুধু তা-ই নয়, সেই দিনই দক্ষিণ বারাসতের সভায় কমিশনকে নিশানা করে বদলার ডাক দিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
বিরোধী থাকাকালীন বহু বার সর্বদল বৈঠক বয়কট করেছে তৃণমূল। শাসক হয়েও এ দিন পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনল তারা। এর আগে কিন্তু পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে কমিশনের ডাকা বৈঠকে যোগ দিয়েছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়রা। তা হলে এ দিন কেন গেলেন না তাঁরা? জবাবটা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই, দক্ষিণ ২৪ পরগনার নির্বাচনী সভায়। বলেছেন, “রমজান মাসের মধ্যে ভোট করছে। এমনকী, জুম্মাবারেও ভোটের দিন রেখেছে। রমজানে ভোট করবেন না, এ কথা আগেই বলেছিলাম। বলেছিলাম বৃষ্টিতে সমস্যা হতে পারে। পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। আমাদের কথা কেউ শোনেনি। এক বার আলোচনা পর্যন্ত করেনি। সর্বদল বৈঠকে কেন যাবে তৃণমূল?” এর পাশাপাশি তিনি বলেন, “রমজানে ভোট নিয়ে (কমিশন) এক বারও জিজ্ঞাসা করেনি। গায়ের জোরে যা ইচ্ছে করছে। এর বদলা নেব। মানুষকে বলব বদলা নিতে গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে।”
নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক সংস্থার ডাকা ভোট সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে শাসকদল হিসেবে তৃণমূলের যোগ না দেওয়া কতটা গুরুতর? এই ঘটনাকে উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন কমিশনের সচিব তাপস রায়। তিনি আরও বলেন, “বৈঠকে থাকলে ওই দলের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়টি কমিশন জানতে পারত।” এর বেশি কোনও মন্তব্য করতে চাননি তিনি। |
দক্ষিণ বারাসতের নির্বাচনী সভায় মুখ্যমন্ত্রী। শনিবার। ছবি: দেবাশিস রায় |
তৃণমূলের অভিযোগ, এত দ্রুত বৈঠক ডাকা হয়েছে যে, তাদের পক্ষে হাজির থাকা সম্ভব হয়নি। কমিশন সূত্রে জানা গিয়েছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ফ্যাক্স এবং ই-মেল মারফত আমন্ত্রণ জানানো হয় সব ক’টি দলকে। বার্তাবাহকের হাত দিয়ে চিঠিও পাঠানো হয়। তাপসবাবু এ দিন বলেন, “এ বার ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে দ্রুত বৈঠক ডাকতে হয়েছে। তবে অন্য সময়েও রাজনৈতিক দলগুলিকে সাধারণ ভাবে ২-৩ দিন আগেই চিঠি পাঠানো হয়ে থাকে। সেই হিসেবে খুব বেশি দেরি হয়নি। একই দিনে চিঠি পেয়ে তো কংগ্রেস, বিজেপি এবং বামফ্রন্টের প্রতিনিধিরা বৈঠকে হাজির ছিলেন।” তৃণমূল কি জানিয়েছিল, তারা বৈঠকে যোগ দিতে পারবে না? তাপসবাবু বলেন, “সর্বদল বৈঠক শেষ হওয়ার পরে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা একটি চিঠি পেয়েছি। তাতে তিনি লিখেছেন, সর্বদল বৈঠক দ্রুততার সঙ্গে ডাকা হয়েছে। তাই তাঁদের পক্ষে বৈঠকে হাজির থাকা সম্ভব হয়নি।”
পার্থবাবু অবশ্য বলেন, “কমিশনের অসৌজন্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে তাঁদের বৈঠকে আমরা যোগ দিয়ে সিলমোহর লাগাতে চাইনি। তাই কমিশনকে চিঠি দিয়ে আমাদের আপত্তির কারণ ও কেন বৈঠকে যাচ্ছি না, তা জানিয়ে দিয়েছি।” তৃণমূলের আর এক শীর্ষ নেতা এ দিন জানান, প্রথম দফা ভোটগ্রহণের শেষ লগ্নে প্রচার তুঙ্গে। এখন বৈঠকে হাজিরা দিয়ে তাঁরা সময় নষ্ট করতে চাননি। তাঁর বক্তব্য, “বৈঠকে উপস্থিত থাকার চেয়ে মানুষের কাছে গিয়ে শান্তিতে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের আবেদন জানানোটা আমাদের কাছে জরুরি বলে মনে হয়েছে।”
তৃণমূলের জন্য এ দিনের বৈঠক শুরুর আগে মিনিট পনেরো অপেক্ষা করে কমিশন। পরে কমিশন সূত্রে এ কথা জানানো হয়। অন্য দিকে, বিরোধীরা এই ঘটনাকে নজিরবিহীন বলেই ব্যাখ্যা করেছেন। বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ তো সরাসরি বলেছেন, “এটা একটা নজিরবিহীন ঘটনা। কমিশনকে ওদের অমান্য করার এই চেষ্টা দেখে ভোট কতটা নিরপেক্ষ হবে, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিচ্ছে।” সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু এতটা স্পষ্ট না হলেও জানিয়েছেন, কোনও শাসকদল এ ভাবে সর্বদল বৈঠক করছে, তা তিনি অতীতে দেখেননি। তাঁর কটাক্ষ, “বিরোধী থাকার সময়ে তৃণমূল সর্বদল বৈঠক বয়কট করত। কিন্তু সরকারে থাকলে বিরোধীদের মতো আচরণ করা যায় না, সেটা তৃণমূল শেখেনি!” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “অহঙ্কারের বশবর্তী হয়ে কমিশনের মতো সাংবিধানিক সংস্থাকে সম্মান করছে না তৃণমূল।”
ঘটনাচক্রে এ দিন সর্বদল বৈঠকে যে বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা হয়, তার মধ্যে প্রার্থী ও ভোটারদের নিরাপত্তার দিকটিই মূল। এবং যে ক্ষেত্রে বিরোধীদের আঙুল শাসকদলের দিকেই। বিভিন্ন অঞ্চলে যে বাইক বাহিনী ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেই প্রসঙ্গ তোলেন বিরোধীরা। তাদের নিয়ন্ত্রণের দাবিও করেন। কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাইক-বাহিনী নিয়ন্ত্রণের সব রকম ব্যবস্থা নেবে তারা। এই দিন মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, ডিজির সঙ্গে বৈঠকে মোটরবাইক-বাহিনীর প্রসঙ্গটি তুলে তাদের নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনকে ব্যবস্থাও নিতে বলেন মীরা।
এ দিন জনসভায় ভোট নিয়েও যাবতীয় সমস্যার জন্য কমিশনকেই কাঠগড়ায় তোলেন মমতা। রমজানে ভোট করা নিয়ে কমিশন প্রশাসনের সঙ্গে কোনও আলোচনা করেনি, এই অভিযোগ এনে তিনি বলেন, “এর বদলা নেব। মানুষকে বলব বদলা নিতে গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে।” |
মানস ভুঁইয়া |
বিমান বসু |
মীরা পাণ্ডে |
|
সাংবিধানিক সংস্থার বিরুদ্ধে বদলা নেওয়ার এমন ডাকও বেনজির বলেই জানিয়েছে বিরোধী শিবির। কংগ্রেস, সিপিএম সকলেই মমতার কথাকে কটাক্ষ করেছে এই বলে যে, আগে তো উনি বলতেন বদলা নয় বদল চাই। এ বারে কি তাঁর স্লোগান বদলে গেল! এই প্রসঙ্গে মীরাদেবী কিছু বলতে চাননি। জানিয়েছেন, তিনি খোঁজ নিচ্ছেন। তবে মমতার এই মন্তব্যকে কমিশনের সচিব তাপস রায় দুর্ভাগ্যজনক বলে উল্লেখ করেছেন।
ভোটগণনার তারিখ নিয়েও নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করেন তৃণমূল নেত্রী। বলেন, “২৯ তারিখ গণনার দিন ঠিক করেছে। অথচ, ৩১ তারিখ আমাদের বাজেট পাশ করাতে হয়। মাঝে মাত্র এক দিন, ৩০ তারিখ।” তাঁর বক্তব্য, “কোনও কারণে যদি বিধানসভা মুলতবি হয়ে যায়, তা হলে বাজেট পেশ করতে পারব না। বাজেট পেশ না করলে কর্মীদের মাইনে দিতে পারব না। দেখেছেন আমাকে কী রকম ভাবে জ্বালাচ্ছে!” এর পরে সামগ্রিক ভাবে বিরোধীদের দুষে তাঁর মন্তব্য, “আমি সব দেখে নেব।”
মমতার মতো তাঁর দলের অন্য নেতারাও কমিশন এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডেকে নিশানা করেছেন। পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরের ঝাড়ুখামারে এক নির্বাচনী সভায় তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় যেমন বলেন, “আগের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেববাবুর সুপারিশে মীরা পাণ্ডে নিয়োগ হয়েছেন। তাঁরাই ওঁর মেয়াদ বাড়িয়ে গিয়েছেন। সেই কৃতজ্ঞতা বোধ মীরাদেবীর মধ্যে কাজ করছে বলে তিনি সিপিএমের প্রতিভূ হয়ে উঠেছেন।” একই রকমের সুর আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের গলাতেও। পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরার গোলগ্রামে এক জনসভায় তিনি বলেন, “রাজ্যের কোষাগারের টাকা ব্যবহার করে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধেই লড়াই করছে কমিশন।”
রমজান মাসে ভোটের জন্য মমতা যে ভাবে কমিশন ও বিরোধীদের উপরে দায় চাপিয়েছেন, তা উড়িয়ে দিয়েছেন বিমানবাবু। সুপ্রিম কোর্টে রাজের ৯ জন আইনজীবী রথযাত্রা ও ২১ জুলাইয়ের শহিদ দিবসের কথা উল্লেখ করলেও কেন রমজানের কথা উল্লেখ করেননি, সে প্রশ্ন তোলেন তিনি। বলেন, “রমজানে ভোটের জন্য আজ যে বিড়ম্বনা হচ্ছে, তার দায় রাজ্য সরকারের। আসলে তারা পঞ্চায়েত ভোট করতেই চায়নি।” সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা ভোটের দিন ঠিক করেছেন, এ কথা জানিয়ে বিমানবাবুর তির্যক মন্তব্য, “ভোটের দিন ঘোষণার আগে বিচারপতিরা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করলে ভাল করতেন!”
এই নিয়ে সর্বদল বৈঠকেও এ দিন আলোচনা হয়। বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে বর্ষা ও রমজানের কথা মাথায় রেখে ভোট দানের সময় সকাল ৬টা থেকে বিকাল ৪টা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কমিশনের সচিব পরে বলেন, “ভোটের সময় ঠিক করার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। সর্বদলীয় বৈঠকের প্রস্তাব কমিশন সরকারকে জানিয়ে দেবে।”
প্রশাসনের একাংশ মনে করছে, এই ভাবে সরকারের কোর্টে কমিশন বল ঠেলে দেওয়ায় টক্করটা জারিই রইল। |
|
|
|
|
|