|
|
|
|
|
|
|
জাস্ট যাচ্ছি |
শুভময় মিত্র |
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে সময়মতো। যথারীতি খবরের কাগজ পড়ছে কেউ কেউ। আমার উলটো দিকের লোকটার হাতের কাগজের হেডলাইনগুলো পড়ে নিলাম, ট্রেনে মাওবাদী হামলার খবর আছে। ছোট ছবি বেরিয়েছে রক্তাক্ত দেহের। কোথায় ঘটেছে জিজ্ঞেস করিনি। এক বার চাওয়ালা গিয়েছিল, খেয়েছি। একটা ছোট হাতব্যাগ ছাড়া আমার কাছে কিচ্ছু নেই। ঝিমুনি এসে গিয়েছিল।
এখন ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে। অনেক ক্ষণ হয়ে গেছে। এটা অবশ্য ভাল ট্রেন নয়। অনেক সময় বোর্ডে এর নামও ওঠে না। দরজার কাছের সিটগুলো ফাঁকা। কারণ জল থইথই করছে। ছোট বাচ্চা উঠেছিল একটা। মুখে খড়ির মতো রং মাখা। বিকট লিপস্টিক লাগিয়েছে, অদ্ভুত ছেঁড়া অথচ রঙিন জামা। লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে গান গেয়ে, টিভিতে, যাত্রায় যেমন হয়, ঘুরে ঘুরে পয়সার জন্য ঘ্যানঘ্যান করেছে। কেউ দেয়নি বিশেষ। নিরুত্তাপ মুখে একটা সিটে বসে পড়েছে। বাজে ট্রেন। আলতু-ফালতু লোক। ট্রেন চলছে না বলে কেউ আপত্তি করছে না তেমন। কেউ কেউ পাশের জমিতে নেমে পড়েছে।
একটা গোলমালের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে সামনের দিকে। লোকজন চিৎকার করছে। তাই অনেকে নামছে ট্রেন থেকে। দেখতে যাচ্ছে কী হয়েছে। আমি দু-এক জনকে জিজ্ঞেস করলাম। হিন্দি বলতে পারি না ভাল। উত্তর না দিয়ে সকলেই অকুস্থলের দিকেই এগোল। এক জন বলল, ‘ইঞ্জিন খারাপ হয়ে গেছে। নতুন ইঞ্জিন না এলে ট্রেন যাবে না।’ লোক নামছে টুপটুপ করে। আকাশে কালো মেঘ করে আছে। একটা রোদ্দুর আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। যাচ্ছে যেখানে গোলমাল হচ্ছে সেই দিকে। নামলাম আমি। |
|
ছবি: শুভময় মিত্র |
জঙ্গলের মধ্যেই গাছ থেকে গাছে নাইলনের দড়ি লাগানো, কাপড় শুকোচ্ছে বেশ কয়েকটা। তার পর থোকা থোকা বেগুনি ফুলের ঝোপ, তার পরেই দেখা যাচ্ছে অনেক লোককে। গ্রামের লোকই হবে। মেয়েরাও আছে। ভিড়ে আমিও মাথা গলালাম। ভাষা বুঝি না। তবে গলা শুনে বুঝতে পারছি এক দিকে রাগ, অন্য দিকে পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে অনেকের। বেশির ভাগ লোক অবশ্য বলছে না বিশেষ কিছু। কিন্তু প্রত্যেকেই নিজের জায়গাটা ঠিক করে নিচ্ছে, যাতে ঘটনাটা দেখতে সুবিধে হয়। আমিও তাই করলাম। জোয়ানদের সরাতে সাহস হল না। এক জন বেঁকে যাওয়া বুড়োকে একটু ঠেললাম। সেও আপত্তি না করে অন্য দিকে চলে গেল। দেখলাম, মাটিতে পড়ে আছে একটা লোক। অগোছালো ভাবে কিন্তু আষ্টেপৃষ্ঠে দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছে তাকে, একটা মরা উপড়ে যাওয়া বড় গাছের গুঁড়ির সঙ্গে। বোঝাই যাচ্ছে চরম ধোলাই দেওয়া হচ্ছে। মুখটা মাটির সঙ্গে মিশে আছে। রক্ত পড়ছে লাল মাটিতে। মাথাতেও চোট রয়েছে। ময়লা জামা-প্যান্ট ছিঁড়ে গেছে। ডান পা-টা হাঁটু থেকে অস্বাভাবিক ভাবে ব্যাঁকা। মনে হল কাঁপছে থরথর করে। নিজেদের মধ্যে হল্লা করা লোকজনদের এক জন হঠাৎ কথা থামিয়ে সজোরে লাথি মারল পড়ে থাকা লোকটার পেটে। সে কোনও শব্দ করল না।
দেখে মনে হল, চোর, ধরা পড়েছে। শাস্তি হচ্ছে। গ্রামের ব্যাপার, থানা-পুলিশের বালাই নেই বোধ হয়। এক জন লোক, আমার পিছনেই ছিল, হাসিমুখে আমাকে হিন্দিতে বলল, ‘থানা তো আর হোটেল নয়, যে ধরে নিয়ে গিয়ে রেখে দেবে। দু’দিন পরে ছেড়ে দেবে। তখন আবার এ সব করবে।’ অর্থাৎ এখানকার পাপের শাস্তি, এখানেই হোক। যার ক্ষতি হয়েছে সে বা তারাই দিক, বিবেচনা করে। তা ছাড়া সকলেই আছে। অন্যায্য কিছু তো হবার ব্যাপার নেই, শিক্ষাটা ভাল করেই দেওয়া দরকার। কারণ বেশির ভাগ সময়ে শাস্তি দেবার সুযোগই পাওয়া যায় না। দোষী পালিয়ে যায়।
স্থানীয় লোক আর ট্রেনের লোকের তফাত সহজেই বুঝতে পারছিলাম। ট্রেনের লোকরা মাঝে মাঝেই মুখ ঘুরিয়ে নজর রাখছিল ইঞ্জিনের আসার ব্যাপারে। হর্ন দেবে নিশ্চয়ই। এরা সকলেই দর্শক, কথাবার্তা বলছে না বিশেষ। যারা অপরাধীকে পাকড়েছে এবং মারছে এবং এখন তুমুল চিৎকার করছে গলা ফাটিয়ে, তারা আমাদের নিয়ে চিন্তিত নয়। ভেসে আসা কথা আর অঙ্গভঙ্গি দেখে আন্দাজ করলাম, চুরি নয়, গোলমালটা মেয়ে সংক্রান্ত। শরীরের ভাষা সব সময়ই ইন্টারেস্টিং, কত কী বোঝা যায়!
রোদ এসে পড়ল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে। নিশ্চয়ই বৃষ্টি হয়েছে, পাতার ওপরের ধুলো ধুয়ে গেছে আগেই। এ বারে রোদ পড়ে ঝলমল করে উঠল। আরও লাল হয়ে উঠল ঝুরো মাটি। মনে হল একটা বাষ্প উঠছে মাটি থেকে, কেমন যেন ভিজে ভিজে অথচ উজ্জ্বল পরিস্থিতি। তার মাঝখানে পড়ে আছে একটা জ্যান্ত মানুষ, বাঁধা পড়েছে মরা গাছের সঙ্গে। মানুষের ব্যাকড্রপ ঘিরে আছে তাকে। তাকে কেন্দ্র করে যা কিছু, উত্তেজনা, উন্মাদনা মিশে যাচ্ছে সবুজ, সবীজ, বনজ অন্ধকারে। কালচে আকাশ-ফাটা রোদের সার্চলাইটটা স্থির হয়েই আছে। ওই আলোতে থেমে যেতে বাধ্য হওয়া আমি বিপুল আগ্রহে বুঝতে চাইছি থমকে থাকা আর একটা মানুষের পাপের ইতিবৃত্ত।
ভিড়ের মধ্যে স্পষ্ট দুটো ভাগ বুঝতে পারছি। এক দলে মহিলা বেশি, তারা চাইছে আরও অত্যাচার, আরও শাস্তি। এক জন মহিলার কোলে শিশু, হট্টগোলে সে মহা খুশি, বার বার মায়ের গলার পুঁতির মালাটা টেনে মুখে পুরে দেবার চেষ্টা করছে। ছ’ইঞ্চি দূরের গলা থেকে যে চিৎকারটা বেরোচ্ছে, তুমুল ঝাঁকুনি হচ্ছে যে ধরে রাখা জড়ানো হাত থেকে, তা নিয়ে সে ব্যতিব্যস্ত নয়। লোকজনের কথা শুনে আন্দাজ করলাম, পড়ে আছে এরই স্বামী। স্ত্রী চাইছে ভয়ানক প্রতিশোধ, সমর্থনেরও অভাব নেই। কুড়ুলও দেখা গেছে এক জনের হাতে। এ বার সেটা চলে যাবে অপমানিতা স্ত্রীর কাছে। তার পর জঙ্গলের মধ্যে মানানসই ভয়ানক ঘটনাটা ঘটবে, সবার সামনে, সূর্যকে সাক্ষী রেখে। হাবভাব দেখে মনে হল জনতাও তাই চাইছে। ‘যে মেয়েকে নিয়ে দু’নম্বরি করল, তাকে দেকচি না তো।’ বললেন এক জন আমার দিকে তাকিয়ে, বাংলায়। ইনি আমার সামনে বসে আজ কাগজ পড়ছিলেন। ‘দোষ তো তারও কম নয়, বিবাহিত লোককে ফুসলোনোটাও তো ভাল কাজ নয় কী?’ কিছু বললাম না। কারণ সামনে আরও ভয়ানক ঘটনার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, জনতাও মানসিক ভাবে প্রস্তুত নতুন খুনের দৃশ্য দেখতে। ইজ্জত, বিশ্বাসের প্রশ্ন, উদাসীন থাকা যায় না।
বাচ্চাকে মাটিতে নামিয়ে দিল মেয়েটা। অমনি সে হামা দিতে শুরু করল। ঝরা পাতা, মরা ডালের পাশ দিয়ে। তার মৃতপ্রায় পাপী বাবা সেটা দেখতে পেল কি না বুঝতে পারলাম না। কাপড়টা কোমরে শক্ত করে বেঁধে নিল মেয়েটা। এত ক্ষণ যে চোখে আগুন ছুটছিল, এখন তা শান্ত, নির্বিকার। হাতে কুড়ুল এসে গেছে। দু’হাতে শক্ত করে ধরে আছে সেটা। নিস্পৃহ চোখের দৃষ্টি বিশ্বাসের অমর্যাদা করা রক্তাক্ত স্বামীর দিকে।
শঙ্খধ্বনি হল দূর দিগন্তে, পরপর দু’বার। তার পর আরও এক বার। এগিয়ে আসছে সেই আওয়াজ, ধীরে ধীরে।
তৃতীয় বার হর্নের আওয়াজ হতেই আন্দোলিত হয়ে উঠল জনতা। আবার একটা মিলিত শব্দ, তার মধ্যে থেকে আচমকা বেরিয়ে এল আর একটি মেয়ে। একশো বছরের অশ্বত্থের ঝুরির মতো তার মাথায় চুলের জটা। শরীরের জড়ানো কাপড় আর দেহের হাড়ের মধ্যে অন্য কিছু নেই। ওই শরীর নিয়ে মেয়েটা ঝাঁপিয়ে পড়ল নিথর দেহটার ওপর, যেন জড়াতে চাইল দু’হাত দিয়ে। মাথা ঠুকতে লাগল মাটিতে। কুড়ুল হাতে মানুষটা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল শূন্য চোখে। আর এক বার হর্ন বাজতেই ককিয়ে কেঁদে উঠল বাচ্চাটা। |
|
|
|
|
|