|
|
|
|
|
|
ইভলিন ত্রুইলো: হাইতি |
প্রাগৈতিহাসিক
|
ওরা এসেছিল একসঙ্গে। হলুদ-সবুজ পাখার দুটো প্রজাপতি, ছোপ ছোপ গা, তিরতির কাঁপা। পুকুরপাড়ের জবা গাছে ইতিউতি উড়ে বসছিল ওরা, আর ছেলেটা অবাক হয়ে দেখছিল ওদের ফুরফুরে লাবণ্য।
ছবি আঁকতে হাত নিশপিশ করছিল ওর। দেরাজের পিছনে, বন্ধুদের টিটকিরি-ভরা মুখ আর বাবার গা-জ্বালানো কথার আড়ালে লুকিয়ে রাখা তুলিগুলো হাতে তুলে নিতে মন চাইছিল। বাবার তো একটাই ইচ্ছে, বংশের ঐতিহ্য মেনে কনিষ্ঠ বংশধরটিও শপিং সেন্টারের ছবি আঁকছে, তা দেখা।
ও ভাবছিল কী আঁকবে, কী কী রং দেবে, কম্পোজিশনের কোন কোন উপাদান ওর ক্যানভাসকে জীবন্ত করে তুলবে। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ছবি-আঁকার সব জিনিস সামনে ছড়িয়ে বসতে, হয়তো তাতে নিজেকে একটু কম হতাশ, কম বিচ্ছিরি, কম একা লাগবে। তিন মাস কেটে গেছে ও হাতে তুলি ছোঁয়ায়নি।
হ্যাঁ। সময় হয়েছে নিজের স্বপ্নকে ছোঁওয়ার, সবার আপ্রাণ মন জোগানো বন্ধ করবার। কিন্তু এখন প্রথমে কিচেনে গিয়ে কয়েকটা চিজ বিস্কুট খাওয়া দরকার, জোসেট যেগুলো টেবিলের ওপর রেখে দেয়। |
|
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
*** |
মেয়েটার আবার খিদে পাচ্ছিল। কোন সকালে কয়েক টুকরো পাঁউরুটি পেটে পড়েছে, দুপুরের খাওয়া অব্দি ওতে থাকা যায়? পাঁউরুটির টুকরোগুলো যথেষ্ট বড়ই ছিল, ওপরে পিনাট মাখনের পুরু আস্তরণও। রাঁধুনি যে কফি বা চিনিও টিপে টিপে দিয়েছে, তাও না। তবু, ওর সব সময়ই নিজেকে ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছিল। কারণটা পরিষ্কার। খাবারের জন্য ও অন্যের ওপর নির্ভরশীল, আর বাড়ির কর্তা ও বাচ্চারা না খাওয়া অব্দি চাকরবাকরদের অপেক্ষা করতেই হয়। নিয়মই এই। নালিশ করলেও কিছুই পালটাবে না। তা ছাড়া, ওর মাইনেও যথেষ্ট, হপ্তায় একটা ডে অফ আছে, সন্ধেয় গা এলানোর জন্য একটা রুম, ফি-গ্রীষ্মে দু’হপ্তা ছুটি।
ওর মনিবরা ভালমানুষ। ওদের যে এত কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, ক্যারিবিয়ান মার্কেটে ওরা যা খরচা করে তাতে যে ওর গোটা মাসমাইনে হয়ে যাবে, তা নিয়ে ও কখনও গজগজ করত না, কিন্তু এ দিকে পেটও ভরত না। খাবার নিয়ে ভাবতে না চাইলেও ওর মনে পড়ত ভাত আর স্মোক্ড হেরিং-এর সুগন্ধ, ইয়াম ভাজা আর মশলাদার সসে সেদ্ধ হওয়া শাকসবজির দৃশ্য। ছোটবেলায় খাবারের জন্য ভাইবোনদের সঙ্গে মারামারি করতে হয়েছে। পাঁচ পাঁচটা বাচ্চা, সঙ্গে আরও দুটো তুতো। বড়রা বাছাই টুকরোগুলো ছোঁ মেরে নিতে তক্কে তক্কে থাকত। আর ছোট্ট ও, কান্না-কান্না চোখে, নাক টানতে টানতে, আধা-ভর্তি প্লেটেই সন্তুষ্ট থাকত।
পেটটা আবারও খিদেয় মুচড়ে উঠল। ডিনারের জন্য, রাস্তার কোণে মাছভাজাওয়ালাটার জন্য, জানুয়ারি-সন্ধের আদা-চা’র জন্য অপেক্ষা আর পোষাচ্ছিল না। বরং রাস্তার ওপারে পড়শি-বাড়িতে যাওয়া যাক। জোসেট, ওদের রাঁধুনি, রান্নাঘরে গরম কফি, চিজ বিস্কুট, জ্যাম রেখে দেয় বাচ্চাদের জন্য। হ্যাঁ, এখনই সময় ওর সঙ্গে একটু গ্যাঁজানোর। |
*** |
ডাইনিংয়ের দেওয়ালগুলো কেন যে চোখের সামনে দুলছে, ছেলেটা বুঝতে পারছিল না। হলঘর আর কিচেনের মধ্যিখানটায় দাঁড়িয়ে ও দেখল, ছবিগুলো সব ধড়াধ্ধড় মেঝেতে পড়ছে, একটা গোটা দেওয়াল ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। কোথাও একটা আশ্রয় নিতে হবে, ভাবতে ভাবতেই কত সময় যে চলে গেল! কোথায় যাওয়া যায়? রান্নাঘর থেকে আওয়াজ আসছিল, চেঁচামেচি, কান-ফাটানো। ও দৌড়ল, যে দিকে দৌড়তে ওর ইন্দ্রিয় ওকে বলছিল, পৃথিবীর আর সব মানুষরা যেখানে আছে, যে পৃথিবীতে সব জিনিসপত্র রহস্যময় যত নিয়মে চলে, মানুষের কথা মোটে শোনে না।
রান্নাঘরে মেয়েটা কফির কাপ সবে মুখে তুলছিল, যখন গোটা বাড়িটা এমন কাঁপতে শুরু করল যে ওর হাত থেকে কাপটা উড়ে গেল, আগুন-গরম তরল ওর পায়ে ঝাপটে পড়ল। যন্ত্রণাটা অনুভব করবার সময়ও ওর হাতে ছিল না। ওর ডান দিকে জোসেট বিড়বিড়িয়ে উঠল, ‘ঈশ্বর মহান’, আর পরক্ষণেই বিশাল কাঠের আলমারিটা হুড়মুড়িয়ে ওর ওপর ভেঙে পড়ল।
ছেলেটা, আর মেয়েটাও, খিড়কির দরজার দিকে ছুটল। মেয়েটাই কাছাকাছি ছিল, কিন্তু ছেলেটা বয়সে ছোট আর চটপটেও, তাই ওরা একসঙ্গেই পৌঁছল। ভাঙা দেওয়াল, ইট, কাঠ, ইতালি থেকে ইভেত্ দিদার আনা বাসনকোসন, বাঁ পাটি জুতো ওটা এখানে এল কী করে? হাজারটা জিনিস পায়ে আটকাচ্ছিল। কী ভাগ্যি ছোট ভাইটা বাড়িতে নেই, কিন্তু ও-ই বা কী অবস্থায় আছে? ভেবে কাজ নেই। একটা পুরু ধুলোর অন্ধকার চারপাশে ঢেকে। ‘বেরোতেই হবে এখান থেকে’, ভেবে ছেলেটা হাত বাড়াল, আর কোনও মেয়ের শ্বাস-নেওয়া, জীবন্ত এক জোড়া বুক ওর হাত ছুঁল। ঝাঁঝালো, ঘেমো বগলের গন্ধ আর কাপড় কাচার লেবু-ডিটারজেন্টের ঘ্রাণ একসঙ্গে নাকে এল। এ জোসেট নয়, আলমারির তলা থেকে বেরিয়ে থাকা জোসেটের ভাঙা পা ও দেখেছে। কিন্তু এ-ও চেনা, পাড়ারই কেউ। হ্যাঁ, রাস্তার ওপারের বাড়িটায় কাজ করে। আচ্ছা, মা কোথায়? মা তো এক্সারসাইজ করছিল। তিন তলাটা কি এখনও আছে? ভেবে কাজ নেই। ও আবারও ওর পাশের নারীশরীরটা ছুঁল, অনেক ক্ষণ ধরে ছুঁল, যাতে বোঝা যায় ও সত্যি বেঁচে আছে কি না। মেয়েটা এক ধাক্কায় হাতটা সরিয়ে দিল, ওর গলা দিয়ে যত না যন্ত্রণার তার থেকেও বেশি বিরক্তির একটা আওয়াজ বেরোল।
ছেলেটাকে চিনতে ওর সময় লাগেনি। জিরজিরে দুবলা একটা, খেই-হারানো, ভ্যাবলা। এই কবরের অন্ধকারে ওকে প্রায় দেখাই যাচ্ছিল না। দেওয়াল, জানলা, পরদা সব অদৃশ্য। সূর্যটাই বা কোথায়? ও ওর পাঁচ-বছুরে ছেলেটার কথা ভাবল, সতেরো বছর বয়সে ও যেটাকে পেটে ধরেছিল। ও কি বেঁচে আছে? ওর খিদের বোধ ভোঁতা হয়ে গেছিল, ভেতরটা ঘুলিয়ে উঠছিল। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে বুঝল, শরীরের ওপরটাই নড়ানো যাচ্ছে শুধু।
ঠিক কত সময়ে যে ছেলেটার চোখদুটো এই অন্ধকার সইয়ে নিয়ে চারপাশটা আন্দাজ করতে, ধ্বংসস্তুপ ঠেলে সরিয়ে শরীরটাকে একটু সুবিধাজনক অবস্থায় নিয়ে এসে মেয়েটার শরীরটাকে ঠাহর করতে পেরেছিল, ও জানে না। ঠিক করেছিল পশ্চিম দিকটায় যাবে, খিড়কির দরজা ওদিকেই। কিন্তু দেওয়াল ভেঙে পড়ে ওদের সোজা দাঁড়াতে দিচ্ছিল না, হামাগুড়ি দিয়ে ওদের সব সাফ করতে হচ্ছিল: কাঠের দেরাজ, চিনেমাটির ঢাকনার টুকরো, ভাঙা কাচ। তেষ্টায় ছেলেটার মাথাটা আউলে যাচ্ছিল, কিচেন বলে জায়গাটার দেওয়ালে ও একটু হেলান দিল। মেয়েটা দুর্বোধ্য কিছু একটা আওড়াতে আওড়াতে কাজ সারছিল। এক সময় স্পষ্ট গলায় বলে উঠল, ‘আমাদের কিছু খাবার খুঁজে পেতেই হবে!’
আবার দুজনে কাজে লাগল। মাঝে মধ্যে বোধবুদ্ধিহীন একটা জড়তা পেয়ে বসছিল দুজনকে। তন্ন তন্ন ঢুঁড়ে মেয়েটা কিছু চিজ বিস্কুট, সোডার ক্যান, ফ্রুট জুস উদ্ধার করে আনল। মেয়েটার চিবোনোর শব্দ শোনা যাচ্ছিল, ওর চোয়ালের খটখটানিতে একটা উচ্ছ্বাস। অনেক ক্ষণ কাজ করে ওরা মেঝেতে শুয়ে পড়ল। খুব স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই ছেলেটা মেয়েটার দিকে ফিরল। মেয়েটা ওর বুকটা আরও কাছে এগিয়ে এনে ছেলেটার গায়ে চেপে ধরল। গোল বুক দুটোর উষ্ণতায় ছেলেটা মুহূর্তের জন্য সব ক্লান্তি আর ভয় ভুলে গেল। একটু পরই, ঘুমিয়ে পড়ল দুজনে।
ছেলেটার যখন ঘুম ভাঙল, মেয়েটা দূরে সরে গেছে তখন। স্কার্টটা দু’পা ঘিরে লেপটানো, কুঁকড়ে থাকা শরীরটা যেন গোল, উজ্জ্বল একটা ছোপ। ছেলেটা নিজের কামনার তীব্রতায় নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছিল। একটা বাঁধ-না-মানা ইচ্ছে, স্কুলের সেই যে মেয়েটার সঙ্গে একবার শরীর মিলিয়েছিল, সে রকম পানসে, অনুভূতিহীন নয়।
ছেলেটা একটা হাত মেয়েটার একটা বুকে রাখল, আর অমনি দারুণ একটা কম্পন জেগে উঠল, আস্তে আস্তে ছড়িয়ে গেল ওর গোটা শরীরে। প্রজাপতির পাখা ঝাপটানোর মতোই নরম, হালকা সে কম্পন। মেয়েটাও অনায়াসে ওর শরীরের তলায় পিছলে এসে স্কার্টটাকে তুলে ধরল।
ভুমিকম্পের তিন তিনটে অনন্ত দিন পর, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে ওরা যখন বাইরের দুঃখ আর আতঙ্কের নরকে বেরিয়ে এল, কেউ লক্ষ করেনি যে ওরা দুজন দুজনের হাত ধরে ছিল। মেয়েটাই প্রথম হাত ছাড়িয়ে নেয়, তার পর হেঁটে যায় ছেলেটাকে ছেড়ে। এক বারও পিছনে না তাকিয়ে। |
(সংক্ষেপিত)
অনুবাদ: শিশির রায় |
|
|
|
|
|