জুলাই মাসটা অন্য রকম। বাদলা দিনের গুমোট কাটিয়ে দেয় ট্রাভেল ম্যাগাজিনগুলো। গোড়ায় ঘরোয়া আড্ডায় আলতো করে ভাসিয়ে দেওয়া হয় পছন্দসই নাম। তার পর নেট ঘাঁটা, তথ্য জড়ো করা, প্ল্যান ছকে ফেলা, ট্রাভেল এজেন্টকে ফোন কাজগুলো যেন পর পর লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে। পুজো-ভ্রমণ। কিন্তু এ বার যেন একটু অন্য রকম। সেই মহা উদ্দীপনা তেমন চোখে পড়ছে কি? বিশেষ করে বর্ষাশেষের তকতকে নিকোনো আকাশের টানে যাঁরা বার বার পাহাড়ের দিকে ছুটে যান, তাঁদের অনীহাটা যেন চোখে লাগছে বড়! দু’তিন জন প্রবল হিমালয়-প্রেমী, ফি-বছর পাহাড় চষে ফেলা বন্ধুদের জিগ্যেস করে রীতিমত ঝাঁঝালো সুরের ধাক্কা খেতে হল, ‘পাহাড়? এত কাণ্ডের পরেও?’ উত্তরাখণ্ড বিপর্যস্ত, ভয়ঙ্কর ক্ষতি হিমাচলেও। পায়ের তলায় সর্ষেওয়ালা তাই এখন বেজায় মুষড়ে পড়েছেন।
কথাটা মনে হতেই একটা স্বস্তি পেলাম। হ্যাঁ, হাজার হাজার অসহায় মানুষের সর্বনাশ এবং নরকযন্ত্রণার কথা প্রতি দিন শোনার পরেও। স্বস্তি, কারণ মনে হল, মানুষের মনে এই ভয়টা ঢোকা খুব খুব জরুরি ছিল। বিশেষ করে তাঁদের মধ্যে, যাঁরা হাতে চাট্টি টাকা আর পকেটে খানকতক রিজার্ভেশন-এর স্লিপ পুরে সপাট থাপ্পড় মারেন প্রকৃতির রাজ্যের নিয়মকানুনকে। হিসেব কষলে দেখা যাবে, এঁদের সংখ্যা বিপুল। এঁরাই যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ হন, তা হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। প্রকৃতির তাণ্ডব যদি এঁদের বেড়ানো বানচাল করে দেয়, কিংবা অন্তত একটু লাগাম পরায়, তা হলে পর্যটন ব্যবসার সাময়িক ক্ষতি হতে পারে, কিন্তু পর্যটন কেন্দ্রগুলো অন্তত বেঁচে যাবে ভরা মরসুমে প্রতি দিন একটু একটু করে কুৎসিত হয়ে ওঠার হাত থেকে। |
এমন ভাবনাটা নিশ্চিত ভাবেই আসত না, যদি না চার পাশে তাকিয়ে দেখতাম অধিকাংশ পর্যটকই তাঁদের ‘সেন্স’ নামক বস্তুটিকে বাড়িতে তালাচাবি দিয়ে তবেই ট্রেনে-প্লেনে ওঠেন। আমাদের ঘরের পাশের জায়গাগুলোর কথাই ধরা যাক। পর্যটন মরসুমে ডুয়ার্সের রিসর্ট-এ ঠাঁই পাওয়া দায়। কিন্তু জঙ্গলের নিয়ম মানেন ক’জন? জোরে কথা না বলা, উজ্জ্বল রঙের পোশাক না পরা, জঙ্গল-লাগোয়া অঞ্চলে পথেঘাটে প্লাস্টিক-জাতীয় জিনিস না-ফেলা এই সাধারণ ক’টি কথা বার বার মনে করিয়ে দেওয়া। কিন্তু, কোনওটিই ঠিকঠাক মানা হয় না। ঘন জঙ্গুলে পথ, যে কোনও মুহূর্তে দেখা দিতে পারে বনের বাসিন্দারা। অথচ জিপের মধ্যে তুমুল তর্ক চলছে বাংলার রাজনীতি, ক্রিকেট নিয়ে। অবাধে গায়ে চড়ছে ফ্লুরোসেন্ট জামা। হলুদ পাতার নড়া দেখে ‘বাঘ বাঘ’ বলে ফালতু রসিকতা আর তুমুল চিৎকারের মাঝে পড়ে হরিণছানার দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়ে পালানো দেখে ভেবেছি, আমাদের তো কোনও অধিকারই নেই ওদের রাজ্যে হানা দেওয়ার। ওরা ওদের জগতে নিয়মমাফিক চলে-ফেরে। আমরা দিন কয়েকের জন্য উড়ে এসে, জুড়ে বসে খামখা কেন আমাদের বেনিয়মটাকে ঠেসে ঢুকিয়ে দেব ওদের বাসায়?
আসলে কোথাও ঘুরতে গেলেও ন্যূনতম একটা পড়াশোনা করতে হয়, কিছুটা হলেও জানতে হয় সেখানকার রীতিনীতি, স্থানীয় সংস্কৃতি, আবেগ। কিন্তু তার জন্য সেই দুষ্প্রাপ্য ধৈর্যের প্রয়োজন, যেটা আস্তে আস্তে অভিধান থেকে লোপ পেতে বসেছে। তাই সাধারণ পর্যটকদের কাছে বেড়ানো আর ফুর্তি লোটার মধ্যে বিশেষ তফাত নেই। এই ধরনের মানুষরা কিন্তু ভিন গ্রহের কেউ নন, বরং আমার-আপনার আশেপাশেই থাকেন। এঁরা তাঁরা, যাঁরা পাড়ার কুকুরটিকে বিনা কারণে সজোরে লাথি কষান, মাছ চুরির অপরাধে ফুটন্ত গরম জল ঢেলে দেন বেড়ালের গায়ে, রাস্তার ধারের ফুলের ডাল মুচড়ে ভেঙে রাখেন। এঁরা তাঁরাও, যাঁদের কাছে বে-লাইনে ঢোকাটাই আইন, অন্যকে মাড়িয়ে, ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজের অভীষ্টটুকু আদায় করে নেওয়াই ধর্ম। এই ফাঁপা মন আর চোখ দিয়ে এঁরা করবেন প্রকৃতির রাজ্যের নিয়মকানুনের তোয়াক্কা? শহরের গণ্ডি ছাড়ালে এঁরা আরও বেপরোয়া, আরও দুর্বিনীত। ফলে, দিঘার কংক্রিটের ধাপে দাঁড়িয়ে ভরা জোয়ারে উদ্দাম স্নান (পাশেই কিন্তু বড় বড় করে লেখা সরকারি সতর্কবাণী) দেখেও আজকাল আশ্চর্য লাগে না। অবাক হই না ফি-বছর অ্যালকোহল-পেটে সমুদ্রে স্নান করতে নামা মানুষের তলিয়ে যাওয়ার খবরে। এত প্রচার সত্ত্বেও ঐতিহাসিক স্থাপত্যের গায়ে ‘আই লাভ...’ মার্কা ডায়লগবাজি বন্ধ হয়েছে কি? তবু তো পাহাড় ধস নামিয়ে কিছু দিন ভয় দেখাতে পারে, সুনামির আতঙ্ক সমুদ্রসৈকতে যথেচ্ছাচার সাময়িক ভাবে আটকাতে পারে। কিন্তু বাকি জায়গাগুলো?
প্রশাসন প্রশ্রয় না দিলে কিন্তু পর্যটকদের এত ঔদ্ধত্য সম্ভব হত না। লক্ষ্মীলাভের আশায় তাঁদের যাত্রাপথকে আয়াসে মুড়ে রাখার কত না তোড়জোড়। মনোরম ভ্যালিতে আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার বন্দোবস্ত হয়েছে। বিনিময়ে পর্যটকরা উপত্যকায় ফুল ফুটিয়েছেন রাশি রাশি প্লাস্টিকের কাপ আর ভাঙাচোরা ভাঁড় দিয়ে। জঙ্গলের বুক চিরে গাড়ি চলার পথ বানানো হয়েছে, বিনিময়ে মিলেছে চিকন সবুজ ঝোপের ফাঁকে আটকে থাকা ছেঁড়া চিপ্স-এর প্যাকেট। ডুয়ার্সের জঙ্গলে স্থানীয় এক জিপচালক এক বার দুঃখ করছিলেন, ফেলে দেওয়া চকচকে প্যাকেটগুলো কী ভয়ংকর ক্ষতি করছে জঙ্গলের প্রাণীদের।
আজকাল আর সে ভাবে টুরিস্ট স্পটে অফ সিজন কোথায়? বেড়াতে গিয়ে বর্ষা, গরম, বরফ সবই আমাদের ভীষণ ভাল্লাগে। তাই সারা বছর দাপাদাপির বিরাম নেই। আরও স্বাচ্ছন্দ্য কী ভাবে দেওয়া যায়, সেই চিন্তায় ব্যস্ত থেকেছে সরকার। বিদ্যুতের অভাব? নদী আটকে একের পর এক বানানো হোক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। হাঁটতে কষ্ট? এক্কেবারে চুড়ো অবধি ঠেলে দেওয়া হোক গাড়ির রাস্তাকে। এত আয়াসে অভ্যস্ত হতে হতে তাঁরা ভুলতে বসেছেন যার কাছে দিনকয়েকের বিশ্রাম নিতে এসেছেন, সেই পাহাড়, সাগরকে মান্য করার কথা। কষ্ট নেই, তাই প্রকৃতির দাক্ষিণ্যের মর্ম আর কে বোঝে! এই ভয়ংকর বিপর্যয়ের পর মনে হচ্ছে, কিছু জায়গাকে ‘নেই রাজ্য’ বানিয়ে রাখাটা উচিত ছিল। আনতাবড়ি ভিড়টা কিছু কমত।
প্রশাসন দায়ী, সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরাও কি দায়ী নই? আমরা কি চাইনি এমন জায়গা থেকে সমুদ্রের শোভা দেখতে, যেখানে সমুদ্রের জল এসে খেলা করতে পারে হোটেল চত্বরে? অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দ নিতে খাদের পাশের হোটেল বেছে নিইনি? কখনও ভেবেছি একটা জলোচ্ছ্বাস, একটা ভূমিকম্প কী পরিণতি আনতে পারে? বাইরে গিয়ে নিজের প্রাণের দায়িত্বটাই আমরা ঠিকঠাক নিতে পারি না, প্রকৃতির কথা ছেড়েই দিলাম। ছোট, অতি ছোট পাহাড়ি গ্রামের নাম শুনেছি, আর বুভুক্ষুর মতো ছুটে গিয়েছি সেখানে। বছর ঘুরতেই যথেচ্ছ গাছ মুড়িয়ে সেখানে তৈরি হয়েছে একের পর এক কংক্রিটের খাঁচা। আমরা প্রশ্রয় দিয়েছি বলেই অনিয়মটাই এখন নিয়ম হয়েছে টুরিস্ট স্পটে। আর আমাদের মতো ‘লক্ষ্মী’কে হাতছাড়া করতে কেউ চায়নি, না ব্যবসাদার, না সরকার।
উত্তরে পাহাড় আর দক্ষিণে সমুদ্রের মাঝে থাকা পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত বিজ্ঞানীরা। পরিবেশ রক্ষার দায়দায়িত্ব বিষয়ে বার বারই তাঁরা সতর্ক করে চলেছেন। কিন্তু তাতে আমাদের কী! আমরা ফি-ছুটিতে তোলপাড় করব সমুদ্র-পাহাড়।
আগামী পুজো-ভ্রমণ আপনাদের ভাল কাটুক!
|