|
|
|
|
সিবিআই, আইবি-র ঝগড়া প্রধানমন্ত্রীর দরবারে |
অনমিত্র সেনগুপ্ত • নয়াদিল্লি |
ইশরাত জহান মামলাকে ঘিরে দুই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই ও আইবি-র দ্বৈরথ এ বার গড়াল প্রধানমন্ত্রীর দরবারে। নিজেদের চার্জশিটে সিবিআই যে ভাবে ওই ঘটনায় আইবি-অফিসারদের নিশানা করেছে, তার প্রতিকার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে চিঠি দিল আইবি। দুই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে তিক্ততা যে ভাবে বাড়ছে, তা দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে, এমন আশঙ্কায় দু’পক্ষের দ্বন্দ্ব মেটাতে সক্রিয় হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীও। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে দ্রুত আলোচনায় বসতে চলেছেন তিনি।
গত বুধবার গুজরাতের অতিরিক্ত মুখ্য ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে চার্জশিট পেশ করে সিবিআই জানিয়ে দেয়, ২০০৪ সালে এক ভুয়ো সংঘর্ষেই হত্যা করা হয়েছিল ১৯ বছরের কলেজ ছাত্রী ইশরাত জহানকে। চার্জশিটে সিবিআই অভিযোগ করে, ওই ভুয়ো সংঘর্ষের পিছনে আইবি অফিসারদেরও ভূমিকা রয়েছে। সিবিআই ওই চার্জশিট পেশ করার পর দুই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে তিক্ততা চরমে ওঠে। আগামী মাসে ওই মামলায় দ্বিতীয় চার্জশিট জমা দেবে সিবিআই। সেখানে বেশ কয়েক জন আইবি অফিসারের নাম উঠতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন খোদ সিবিআই প্রধান রঞ্জিত সিন্হা। তিনি বলেছেন, “আইবি যদি বাঁচতে চায়, তা হলে তারা সঠিক জায়গায় আবেদন করুক।” সিবিআই প্রধানের এই মন্তব্যের পরেই সক্রিয় হন আইবি কর্তারা। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হন। |
|
সাংবাদিক বৈঠকে ইশরাতের মা ও বোন। ছবি: পিটিআই |
প্রধানমন্ত্রী সক্রিয় হলেও বিষয়টি নিয়ে যে ভাবে তাদের মুখ পুড়েছে, তাতে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ আইবি-কর্তারা। ইতিমধ্যেই ইশরাত মামলা নিয়ে ময়দানে নেমেছে সিপিএম-সহ একাধিক বাম দল। আজ সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাট-সহ একাধিক মানবাধিকার সংগঠন ও বেশ কয়েক জন বিশিষ্ট মহিলা নেত্রী ইশরাত মামলা নিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করেন। সেখানে ইশরাতের পরিবারের তরফে আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভার সরাসরি আইবি অফিসার রাজেন্দ্র কুমারের দিকে আঙুল তোলেন। তিনি বলেন, “চার্জশিটে রাজেন্দ্র কুমার নামে এক আইবি অফিসারকে ভুয়ো সংঘর্ষের জন্য দায়ী করেছে সিবিআই।” তিনি অবশ্য একই সঙ্গে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধেও অভিযোগের আঙুল তোলেন। বৃন্দা গ্রোভারের অভিযোগ, “কার নির্দেশে ওই হত্যা করা হয়েছে, চার্জশিটে তার সরাসরি উল্লেখ নেই। কিন্তু তদন্ত ইঙ্গিত দিচ্ছে, ওই ঘটনার জন্য দায়ী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। আমরা এই ঘটনার শেষ দেখতে চাইছি। ফলে আগামী দিনে কোনও ভাবেই লড়াই থেকে পিছিয়ে আসব না।” আইবি-কর্তারা অবশ্য এখন রাজনীতির কচকচানির থেকে নিজেদের ভাবমূর্তি বাঁচাতেই মরিয়া। আজ ইশরাতের আইনজীবী যে ভাবে সিবিআইয়ের চার্জশিটে থাকা আইবি অফিসারের নাম করে অভিযোগ করেছেন, তাতে প্রকাশ্যেই ক্ষোভ জানিয়েছেন আইবি-কর্তারা। তাঁদের বক্তব্য, ইশরাত মামলায় সিবিআই জেনে-বুঝে তাদের অফিসারদের নাম ঢুকিয়েছে। সিবিআই যে ওই মামলায় আইবি অফিসারদের নাম রাখতে চাইছে, সে কথা সদ্য প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব আর কে সিংহ-কে জানানো হয়েছিল। তিনি সিবিআইয়ের সিদ্ধান্তের কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে স্পষ্ট জানিয়ে দেন,
কোনও ভাবেই আইবি অফিসারদের নাম ওই চার্জশিটে রাখা যাবে না। আইবি-র এক কর্তার দাবি, সিবিআই তখন জানিয়ে দেয়, পরামর্শ শোনা তাদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। আইবি-র দাবি, এ ধরনের অন্তর্কলহে দুই বাহিনীর মধ্যে শুধু তথ্য বিনিময় নয়, ঐক্যেও চিড় ধরায়। কারণ দু’বাহিনীই দেশের স্বার্থে কাজ করে।
প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে সে কথাই জানিয়ে আইবি-কর্তারা বলেছেন, এর ফলে গোটা বাহিনীর মনোবল নষ্ট হচ্ছে। সংস্থার বক্তব্য, পৃথিবীর কোনও দেশে গোয়েন্দা বাহিনী নিজেদের মধ্যে এ ভাবে একে অন্যের দিকে আঙুল তোলে না। ২০০৫ সালে লন্ডন মেট্রোতেও ভুল তথ্য বিনিময়ের কারণে ব্রাজিলের এক নাগরিককে জঙ্গি সন্দেহে হত্যা করেছিল ব্রিটিশ পুলিশ। ওই ঘটনা নিয়ে হইচই হলেও কোনও পক্ষই সরাসরি পুলিশকে এ ভাবে দায়ী করেনি। যদিও স্রেফ সন্দেহের বশে কাউকে হত্যা করার যুক্তি উড়িয়ে দিচ্ছেন মানবাধিকার কর্মীরা। আজ সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির থাকা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা উমা চক্রবর্তী বলেন, “সরকার এখন ভুয়ো সংঘর্ষের পরিবর্তে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে ‘কন্ট্রোল্ড কিলিং’-র তত্ত্ব খাড়া করতে চাইছে! এতে দেশবাসীর সুরক্ষা বিপন্ন।” দুই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর এই আকচা-আকচির মধ্যেই নিজেদের বাঁচার পথ খুঁজতে মরিয়া ইশরাত প্রশ্নে তুমুল অস্বস্তিতে থাকা বিজেপি।
দলের মুখপাত্র মীনাক্ষি লেখি এ দিন বলেন, “সিবিআইকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত করার জন্য সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা জমা দিয়েছে কেন্দ্র। কিন্তু সেই দাবি যে আসলে সোনার পাথরবাটি, তা ওই চার্জশিট থেকেই স্পষ্ট। দল মনে করে, কংগ্রেসের চাপেই সিবিআই গুজরাত সরকারকে বদনাম করার জন্য ওই ধরনের চার্জশিট আদালতে জমা দিয়েছে।”
বিজেপির যা-ই বলুক, ইশরাত প্রশ্নে দল হিসেবে বিজেপিকে তো বটেই, আগামী লোকসভা নির্বাচনে তাদের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদীকেও নিশানা করতে ছাড়ছে না সিপিএম-সহ বামদলগুলি। আজ বৃন্দা কারাট যেমন সাংবাদিক বৈঠক করেছেন, তেমনই পথে নেমে মোদী প্রশাসনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে সিপিআই ও সিপিআই (এমএল)-এর মহিলা সংগঠনও।
বৃন্দা কারাট এ দিন বলেন, “যে নরেন্দ্র মোদীর প্রশাসনের উদাহরণ তুলে ভোটে নামছে বিজেপি, সেই প্রশাসনের প্রকৃত স্বরূপ কী, তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে পড়েছে। গুজরাতের পুলিশ ঠান্ডা মাথায়, পরিকল্পনামাফিক হত্যা করেছে ইশরাতকে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ওই রাজ্যে নিশানা করা হচ্ছে।”
ভুয়ো সংঘর্ষ প্রশ্নে বাম নেতৃত্ব আজ যে ভাবে নরেন্দ্র মোদীর ভূমিকা নিয়ে সরব হয়েছেন, তাতে আখেরে কংগ্রেসেরই সুবিধা হবে বলে মনে করছেন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অনেকে। তাঁদের বক্তব্য, বিজেপি যাতে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সিবিআইকে ব্যবহারের অভিযোগ তুলতে না পারে, সে জন্য সরাসরি মোদীর নাম চার্জশিটে রাখা হয়নি। এবং ওই চার্জশিট জমা পড়ার পর থেকেই গুজরাত প্রশাসনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। মোদী বিরোধিতার প্রশ্নে কংগ্রেস ও বামেরা যে এক পথের যাত্রী, সেই বার্তাও আজ বৃন্দারা দিতে সক্ষম হয়েছেন বলে মনে করছেন তাঁরা। |
পুরনো খবর: বিহারের মেয়ে ইশরাত, কেন্দ্রের পাশে জেডিইউ |
|
|
|
|
|