মহম্মদ মুরসির পতনের তিন দিনের মাথায় মিশরের অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হলেন মহম্মদ এলবারাদেই। সেনার নিয়োগ করা অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আদলি মনসুর খুব একটা পরিচিত মুখ নন। তাই নতুন সংবিধান রচনা ও পরবর্তী সরকার না আসা পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রাক্তন প্রধান এলবারাদেইকে বহির্বিশ্বের কাছে মিশরের মুখ হিসেবে বেছে নেওয়া হল।
পিরামিডের দেশ অবশ্য রক্তাক্ত হয়েই চলেছে। যাকে বলা হচ্ছে, সরাসরি দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ দুই মিশর। মুরসির পক্ষে বিপক্ষে যাঁরা সংঘর্ষে লিপ্ত, তাঁদের লক্ষ্য কিন্তু অভিন্ন। গণতন্ত্র। কিন্তু দেশের ক্ষমতার কেন্দ্রে রয়েছে সেই সেনাবাহিনীই। ফলে তিন দফায় প্রেসিডেন্ট বদলের পরেও শান্তি অধরা দেশটির। এই অবস্থায় অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী পদে শান্তিতে নোবেলজয়ী এলবারাদেইয়ের নিয়োগ, পরিস্থিতিতে কিছুটা বদল আনতে পারে কি না, তারই প্রত্যাশায় রয়েছে মিশর। এবং গোটা বিশ্বও।
শুক্রবার সন্ধ্যা। কায়রোর রাজপথ। দু’দিনও হয়নি, সেনার হস্তক্ষেপে গদিচ্যুত হয়েছেন মহম্মদ মুরসি। উৎসবের মেজাজে সেনা পথে নামতেই মুখোমুখি হল প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট-সমর্থকদের। নিমেষে হাতাহাতি। ছোট একটা স্ফুলিঙ্গ ভয়াবহ আগুনের চেহারা নিতে সময় নিল না। মুরসির সমর্থক ও তাঁর বিরোধীদের সংঘর্ষে গোটা দেশে নিহত হলেন অন্তত ৩৬ জন। আহতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে।
সেই পুরনো চেহারায় মিশর। মনে করিয়ে দিচ্ছে টালমাটাল মুবারক জমানার শেষ দিক। কায়রোর রাস্তায় এক দল লোক ছুটছে। হাতে লাঠিসোঁটা, পাথর, পেট্রোল বোমা। স্থানীয় খবরের চ্যানেলের স্ক্রিন তখন ভেঙে তিন টুকরো একই সঙ্গে ভেসে উঠছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ছবি। কায়রোয় সশস্ত্র মুরসি-সমর্থকরা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে সংবাদমাধ্যমের অফিসের দিকে। ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে, মধ্যরাত্রি। ঘুম নেই মিশরের চোখে। |
সেনা আসায় উল্লাস মুরসি-বিরোধীদের। তাহরির স্কোয়ারে। ছবি: এএফপি |
সেনাবাহিনীর ঘেরাটোপে মিডিয়া অফিস। তবে সে দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে এগিয়ে চলল বিক্ষোভকারী দলটা। তাতে রয়েছেন মুরসির মুসলিম ব্রাদারহুডের কর্মীরা। তেমনই রয়েছেন সদ্য ক্ষমতাচ্যুত মুরসি জমানার মন্ত্রী-আমলারা। হঠাৎই গদি খুইয়ে দিশাহারা হয়ে উঠেছেন। বিরোধীর ভূমিকায় মেনে নিতে পারছেন না নিজেদের। আলি মহম্মদ সেরাগ মিশরের বিদ্যুৎ মন্ত্রকের আমলা। বললেন, “দেশটা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে।”
মুবারকের একনায়কতন্ত্র থেকে বেরিয়ে এসে গণতন্ত্র পেয়েও কেন এমন হল মিশরের? কেনই বা দু’ভাগ হল দেশ? জবাব দিচ্ছেন মিশরবাসীই।
দেশের রুগ্ন অর্থনীতি, বেকারত্ব এবং ধর্মান্ধ সরকার। দেশের ধর্মনিরপেক্ষ, তুলনায় শিক্ষিত মানুষ চেয়েছিলেন বস্তাপচা ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে এসে এক আধুনিক-মনস্ক শাসক। জুটল এমন এক সরকার, যা সমাজের প্রতি পদক্ষেপে জড়িয়ে ফেলল ধর্মকে। এমন এক সেনেট গঠন করল, যার পিছনে রয়েছে দেশের ১০ শতাংশ ভোট। সে সঙ্গে সংখ্যালঘুদের উপর লাগাতার নিপীড়ন।
বিক্ষোভের বীজ বুনেছিলেন মুরসি নিজেই। ঘোষণা করেছিলেন, তিনি সংবিধানের ঊর্ধ্বে। সেই শুরু। ৩০ জুন গদিতে তাঁর এক বছর পূর্ণ হল। আর সে দিনই প্রথম মিশরবাসী ভেঙে পড়ল রাজপথে। মুরসি-বিরোধীদের দাবি, প্রকৃত গণতন্ত্র চান তাঁরা।
ক্রমশ সেই বিক্ষোভ বিধ্বংসী চেহারা নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত সেনার হস্তক্ষেপ চেয়েছেন মুরসি-বিরোধীরা। গণতন্ত্র ফেরানোর আশ্বাস দিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে ফিরে এসেছে সেনা। সরিয়েছে মুরসিকে। কিন্তু তাঁর সমর্থকদের দাবি, মুরসিকে সরিয়ে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে সেনা। ফলে, দু’পক্ষের সংঘর্ষ থামছে না।
পশ্চিম এশিয়ার বেশ কিছু ওয়েবসাইট জেহাদ ঘোষণা করেছে মিশরীয় সেনার বিরুদ্ধে। তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে আরব দেশগুলি। মিশরীয় সেনার পাশে নেই আমেরিকাও। শুধু মাত্র মিশরের পরিস্থিতিতে ‘চিন্তিত’ জানিয়েই ক্ষান্ত হয়েছেন ওবামা।
শুক্রবার মুসলিম ব্রাদারহুডের এক নেতা মহম্মদ বাদিকে বলতে শোনা গেল “এই লক্ষ লক্ষ মানুষ, কেউ ফিরে যাবে না, পথেই থাকবে, যত ক্ষণ না আমরা প্রেসিডেন্টকে ফিরিয়ে আনছি। আমাদের শান্তিপূর্ণ পথটা ওদের বুলেটের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।” মাইলখানেক দূরে সেনার সদর দফতর রিপাবলিকান গার্ড অফিসে তখন চাপা উত্তেজনা। শোনা যাচ্ছে, এখানেই গৃহবন্দি রয়েছেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট। ক্রমশ সে দিকেই এগোতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। হাতে মুরসির ছবি, প্ল্যাকার্ড। সেই সঙ্গে এক সুরে ভেসে আসছে একটা আওয়াজ, “সেনা শাসন নিপাত যাক...।” কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে শুরু করল সেনা। শূন্যে গুলি। তাতেও অবশ্য থামল না “সেনা শাসন নিপাত যাক।”
এক সময় জটলাটা আছড়ে পড়ল সদর দফতরে। রেহাই দিল না সেনা। প্রথমটা শূন্যে গুলি চালাল তারা। তবে নিমেষে বন্দুকের নলটা ঘুরে গেল মানুষের দিকে। ঝাঁঝরা করে দিল চার বিক্ষোভকারীর দেহ। জখম হলেন ডজন খানেক লোক।
তাহরির স্কোয়ারে তখন ধীরে ধীরে বাড়ছে ভিড়। তাল কাটল কিছু ক্ষণের মধ্যেই। সেখানেও সেনার গুলিতে মৃত্যু হল দু’জনের। আহত অনেকে। সব চেয়ে খারাপ অবস্থা আলেকজান্দ্রিয়ার। রাতভর দাঙ্গায় সেখানে নিহত হয়েছেন ১২ জন। ব্রাদারহুডের নেতৃত্বে ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অবশ্য নিজেদের অবস্থানে অনড়। জানিয়ে দিয়েছে, “যত দিন না সেনা শাসন উঠছে, তাদের সাংবিধানিক প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় ফিরছেন, আন্দোলন চলবেই।”
|