দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের সময় লিওনেল মেসির সঙ্গে একবার মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ হয়েছিল।
আর্জেন্তিনার অনুশীলন দেখতে গিয়েছিলাম। মেসির সঙ্গে কথা বলাটা কিছুটা কাকতালীয় ভাবে। আমার গায়ে ভারতীয় দলের ব্লেজার দেখেই মনে হয় ওদের দলের এক ক্ষমতাবান কর্তার ‘কৃপা’ হয়েছিল।
আমিও ফিফার লাইসেন্সওয়ালা কোচ বলায় উনি কিছুটা নরম হয়ে অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। মেসির মুখোমুখি হয়েছিলাম মিনিট খানেকের জন্য। মেসির সঙ্গে আমার ভাষার সেতু হয়েছিলেন উনিই।
মেসিকে প্রথম দেখাতেই প্রশ্ন করেছিলাম, “তুমি যে ভাবে টাচ লাইন ধরে দৌড়ও, কাট করে ভিতরে ঢুকে পড়ো, গোল করো, তাতে তুমি তো স্ট্রাইকারেও খেলতে পারো।” শুনে হেসেছিল ছেলেটা। বলেছিল, ‘‘এখন স্ট্রাইকারে খেললে মার্কারের কবলে পড়তে হয়। আমি যে জায়গাটায় খেলি, সেখানে মার্কিং করা কঠিন।”
মেসির ফ্ল্যাগ লাইন ধরে দৌড়োনোর সময় কেমন যেন একটা থপথপ আওয়াজ হয়। আমাদের এখানে বহু আগে মহম্মদ ফকরি এরকম দৌড়ত। বিদেশ বসুও দৌড়ত। তবে সেটা কর্নার ফ্ল্যাগ লক্ষ্য করে। ঠিক বিপক্ষ বক্সের মাথায় এসে কাট করে ভিতরে ঢুকতে পারত না। মেসি যেটা করে। ফকরি খানিকটা করত।
পেলে, মারাদোনা, লিওনেল মেসিরা প্রতিভা নিয়েই জন্মায়। ঘষা-মাজা করতে হয় না ওদের। কোচেদের কাজ থাকে শুধু টিমের লয়ে ওদের বেঁধে দেওয়া। পঙ্কজ মল্লিকের ওই অসাধারণ গলা কি আপনি আর শুনতে পাবেন? বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান? হবে না, হতে পারে না।
মেসি অনন্য প্রতিভা। ওর স্ট্রাইডটা দেখার মতো। না, নেইমার কখনও মেসি হতে পারবে না। চেষ্টা করলেও না। কিন্তু এটা বলে ব্রাজিলের ওই চমকে দেওয়া নতুন ছেলেটাকে আমি একটুও খাটো করতে চাই না। নেইমার জাত ফুটবলার সন্দেহ নেই। আমি বিশ্বাস করি, আর একটু ঘষা-মাজা করলে বা ঠিকমতো ব্যবহার করলে নেইমার ব্রাজিলের শুধু নয় বিশ্ব ফুটবলের নতুন আইকন হয়ে যাবে সামনের বিশ্বকাপে। কনফেডারেশন কাপ জয়ের পর ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা যেতেই পারে। পাঁচ ম্যাচে চার গোল, এরকম একটা টুর্নামেন্টে ইনিয়েস্তা-জাভিদের হারিয়ে গোল্ডেন বল জেতা নেইমারকে নিশ্চয়ই মানসিকভাবে উদ্বুব্ধ করবে। |
নেইমারের সবথেকে বড় গুণ, ওর গোল করার প্রবণতা বা ইচ্ছে। বর্তমান বিশ্ব ফুটবলে স্ট্রাইকারদের তুলনায় মাঝমাঠের ফুটবলাররা বেশি সফল হচ্ছে। স্ট্রাইকারে খেললে মার্কড হওয়ার ভয় থাকে, নীচে নেমে খেললে সেটা হয় না। এতে খেলাটা আরও সুন্দর হচ্ছে। নেইমার আসলে স্ট্রাইকার। বক্সের আশেপাশে ভয়ঙ্কর। শটে প্রচণ্ড জোর। যেখান থেকে সুযোগ পাবে গোলে মারবে। কনফেড কাপের ফাইনালের দুর্দান্ত গোলটা সেটা আরও একবার প্রমাণ করেছে। স্কোলারি নিশ্চয়ই সে জন্য ওকে একটু নীচের দিকে খেলাচ্ছে। শটের প্রচণ্ড জোরের সঙ্গে নেইমারের গতির কথাটাও বলব। যেটা গোলের আগে ওকে সাহায্য করছে। সবচেয়ে বড় কথা ছেলেটা টিম ম্যান। কনফেড কাপে ব্রাজিলের বেশির ভাগ গোলের পিছনেই তো ওর অবদান। নিজে করেছে, অন্যকে নিয়ে করিয়েছে। এখনও পর্যন্ত দেখে মনে হচ্ছে স্ট্রাইকারদের যে স্বার্থপরতা দেখা যায় তার উপস্থিতি নেই ওর খেলায়। হয়তো এখনও মানসিক ভাবে চূড়ান্ত পেশাদার হয়নি বলে।
স্কোলারি নিজের দেশে বিশ্বকাপের আগে আগামী এক বছর কী করবে, সেটা ও-ই জানে। আমি যদি ব্রাজিলের কোচ হতাম তা হলে নেইমারকে বলতাম, তোমার খেলায় ভ্যারিয়েশন আনো। বল পেয়েই ভিতরে না ঢুকে ফ্ল্যাগ লাইন ধরে দৌড়ও। মেসির মতো কাট করো। না হলে তোমাকে কিন্তু পরের বিশ্বকাপে ইউরোপের কোচেরা ধরে ফেলবে।
নেইমারকে যদি তুলনা করতে হয়, তা হলে, আমি বলব ও হচ্ছে গ্যারিঞ্চা আর রোনাল্ডিনহোর মিশেল। গ্যারিঞ্চার খেলা আমি দেখেছি স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে টিকিট কেটে বসে। তখন নিয়মিত ইউরোপ যেতাম। গ্যারিঞ্চার একটা দুর্দান্ত বডি ফেইন্ট ছিল। ওর দুটো পা-ই ধনুকের মতো অনেকটা বাঁকা ছিল। ফলে বলটা পায়ের ভিতর দিকে রেখে ড্রিবল করতে পারত। বিপক্ষ রক্ষণকে নড়িয়ে দিত। নেইমার কিন্তু গ্যারিঞ্চার পুরোটা পায়নি। যেটা পেয়েছে তা হল, গোলের জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া এবং হঠাৎ তোলা গতি। যেটা রোনাল্ডিনহোর মধ্যেও ছিল। |
নেইমারের যে ক’টা খেলা কনফেডারেশন কাপে দেখলাম তাতে ছেলেটার এখনও পুরো টিমকে ঘাড়ে নিয়ে জেতানোর মতো ক্ষমতা বা অভিজ্ঞতা হয়নি। আরও একটু সময় দিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। ড্রিবলটা আর একটু ভাল হওয়া দরকার। অনেকে দেখলাম বলছেন, নেইমারের ড্রিবল কোয়ালিটি উন্নত করার জন্য আর একটু গাট্টাগোট্টা হতে হবে। আমি কিন্তু তা মনে করি না। ছেলেটা যথেষ্ট রাফ অ্যান্ড টাফ এবং ভয়ঙ্কর চতুর। মেসির মতোই বুদ্ধিমান নেইমার। মাঝেমধ্যে পড়ে যায়। এবং এমনভাবে দৌড়োয় যে বিপক্ষ ডিফেন্ডার ওকে রুখতে গিয়ে ফাউল করবেই।
মেসি শুনলাম বলেছে, বার্সেলোনায় নেইমারের সঙ্গে খেলার জন্য মুখিয়ে আছে। ঠিকই বলেছে। মেসি-নেইমার একসঙ্গে খেললে কিন্তু বার্সেলোনা আরও ভয়ঙ্কর হবে বলেই আমার মনে হয়।
ব্রাজিল যে ফুটবলটা খেলছে সেটা গতবারের বিশ্বকাপের থেকে আলাদা। ডাইরেক্ট ফুটবলের ঘরানা। নেইমারের ভূমিকাটা সেখানে অনেকটা সাপোর্টিং স্ট্রাইকারের মতো। বাঁ দিকে খেলছে। অনেকটা লেফট উইং-এর মতো। কিন্তু যখন আক্রমণে যাচ্ছে, তখন কখনও কোনাকুনি উঠছে, কখনও সরলরেখায় গিয়ে পাস করছে বিপক্ষ বক্সের আশেপাশে।
কনফেড কাপে দেখলাম নেইমার- নির্ভর আক্রমণই বেশি হচ্ছে। বিশ্বকাপে নিশ্চয়ই স্কোলারি তাঁর স্ট্র্যাটেজি বদলাবেন। সেটা কেমন হবে ভবিষ্যতে দেখব। নেইমারের খেলায় কিন্তু বদল আনতেই হবে। দলকে কমাতে হবে ওর প্রতি নির্ভরতা। কারণ নেইমারকে রোখার জন্য অন্য দলের কোচেরা ভিডিও অ্যানালিস্ট দিয়ে এর মধ্যেই বিশ্লেষণ করতে শুরু করেছেন। আমার এখন দেখে মনে হচ্ছে, ডাবল কভারিং করে ওকে আটকানো সম্ভব। বিশ্বের বরণ্যে কোচেরা নিশ্চয়ই আরও কিছু স্ট্র্যাটেজি বের করে আনবেন নেইমারকে আটকানোর জন্য।
তবে নেইমাররা তো জাত ফুটবলার। কোচেরা যেমন ওকে ধরার চেষ্টা করবে, তেমনই বার্সেলোনায় যোগ দেওয়া ছেলেটিও চাইবে নিজের খেলায় বদল আনতে। বিপক্ষ কোচেরা নেইমারকে আটকানোর যুদ্ধে যদি সাফল্য না পান, তা হলে বলব, নেইমার তুমি সত্যিই গ্রেট। |