শ্রীমান অমিত, সুশ্রী লাবণ্য, অনেক দিন পরে আপনাদের কাছে ফিরলাম। আপনারা বোধহয় জানেন না, একবিংশ শতকের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘সম্পর্ক’ বা ‘রিলেশনশিপ’য়ের ধ্যানধারণায় বাঙালি নতুন প্রজন্মের একটা বড় অংশের কাছে আপনারাই অভিজ্ঞান!
অমিত আপনি-ই তো বলেছিলেন, “ভালবাসা কথাটা বিবাহ করার চেয়ে আরো বেশি জ্যান্ত।” আর লাবণ্যের মত ছিল, “বিয়ে করলে মানুষকে মেনে নিতে হয়, তখন আর গড়ে নেবার ফাঁক পাওয়া যায় না।” একবিংশ-সমাজে ইলেকট্রন কণার মতো সবেগে বিস্তার পাচ্ছে আপনাদের চেতনা। এখনকার জেট প্রজন্মের ধারণাতেও ভালবাসা চিরস্থায়ী, বিয়ে নয়। বিয়ে মানেই হাজারো বাধ্যবাধকতা, রোম্যান্সে ইতি। কেরিয়ারমুখী ছেলেটি বা মেয়েটির উচ্চাভিলাষে ধাক্কা। তাই যত দিন পারা যায়, বিয়ে ঠেকিয়ে রাখতে চাইছেন তাঁরা। জীবনটাকে উপভোগ করে, কাজ বা পড়াশোনার ক্ষেত্রে পাওয়া সুযোগের সদ্ব্যবহার করে, কেরিয়ারে স্থিতি এনে তবে ছাঁদনাতলার কথা ভাবছেন।
তথাকথিত খেটে খাওয়া, নিম্নমধ্যবিত্ত গণ্ডিতে বা গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক কাঠামোয় অপেক্ষাকৃত তাড়াতাড়ি বিয়ে এখনও দেখা যায় হয়তো। কিন্তু মধ্যবিত্ত-উচ্চমধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালি পরিবারে ছেলেরা তো বটেই, গড়পড়তা শিক্ষিত বাঙালি মেয়েরাও এখন নিজের পায়ে না-দাঁড়িয়ে, চাকরি না-পেয়ে বিয়ে করতে অনিচ্ছুক। তার জন্য জীবনের একটা বড় সময় চলে যায়। স্বভাবত, মেয়েদের বিয়ের গড় বয়স এখন বাড়তে-বাড়তে অনায়াসে তিরিশ। ছেলেদের ক্ষেত্রেও সেটা আঠাশ-ঊনত্রিশ থেকে লাফিয়ে পঁয়ত্রিশ-আটত্রিশ।
সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ‘ইন্ডিভিজুয়াল অ্যাসপিরেশন’-এর কথা বোঝাচ্ছিলেন তিনি। বলছিলেন ১৫-২০ বছর আগেও মানুষের আশা-আনন্দ-বিনোদনের কেন্দ্র জুড়ে ছিল পরিবার। এখন পারিবারিক সম্পর্কগুলো খুব নৈর্ব্যক্তিক, খুব অনাত্মীয়ধর্মী। মানুষ তাই বহির্মুখী, মেটেরিয়ালিস্টিক। তার জীবনের ধারণায় আকাশপাতাল বদল এসেছে। পরিবারের গণ্ডিতে বাঁধা পড়তে সে আর অতটা স্বচ্ছন্দ নয়। সে স্বাধীনচেতা। তার উচ্চাশা আছে, উচ্চশিক্ষা আছে, বিদেশভ্রমণ আছে, শপিং মল-বিদেশি ব্র্যান্ড আছে, ফ্ল্যাট কেনা-গাড়ি কেনা আছে। এই সব মিটলে তার পর বিয়ের কথা ভাবা যেতে পারে।
আপনাদের এই প্রজন্মের কয়েক জনের গল্প শোনাই অমিত-লাবণ্য। |
কালিকাপুরের রঞ্জিনী বসু এক বেসরকারি ব্যাঙ্কে মানবসম্পদ আধিকারিকের পদে কাজ করেন। তিরিশে পা দেওয়া অবিবাহিত রঞ্জিনীর কাছে বিয়েতে দেরি করার কারণ একটু আলাদা। তাঁর ব্যাখ্যায়, আগে বিয়েটা পুরোপুরি ছিল সামগ্রিক ভাবে পরিবারের ইচ্ছাধীন। ছেলে বা মেয়েটির তাতে কোনও মতামত থাকত না। সেই বিয়ে সফল না হলে তার দায় বর্তাত পরিবার বা পরিবারের বড়দের উপর। ছেলেটি বা মেয়েটি তখন সকলের সাহায্য, সহানুভূতি পেতেন। এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিয়েটা হয় ছেলে-মেয়ের নিজের পছন্দে বা ইচ্ছায়। ফলে তাতে ভাল-মন্দ কিছু হলে পুরো দায় তাঁদের। ফলে অনেক ভেবেচিন্তে, বেছে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
সুদীপা-রাজদীপের আবার অন্য সমস্যা। দু’জনেরই বদলির চাকরি। সুদীপা বেঙ্গালুরু তো রাজদীপ গোয়া, আবার সুদীপা লখনউ, তো রাজদীপ হায়দরাবাদ। দু’জনেই সফল, উচ্চাভিলাষী। বিয়ে করলে এক জায়গায় থাকাই সমস্যার হবে তাঁরা জানেন। কিন্তু চাকরি নিয়ে আপসটা করবে কে? তাই পাঁচ বছরের সম্পর্কটা ফোন, মেল, স্কাইপেই টেনে যাচ্ছেন। দু’তরফের বাবা-মা বিয়ের কথা বলে-বলে ক্লান্ত। তাঁরা বুঝিয়েছেন, এই ভাবে বেশি দিন টানা যায় না। এই সব বাবা-মায়েদের মানসিক উদ্বেগ আর টানাপোড়েনও সাঙ্ঘাতিক। বনহুগলির স্মিতা আর অর্ণব রায়চৌধুরী শোনাচ্ছিলেন সেই কথা। স্মিতার একমাত্র মেয়ে তিয়াস কলেজের অধ্যাপিকা। তাঁর প্রেমিক অদ্বয় বয়সে তাঁর থেকে পাঁচ বছরের ছোট। পড়া শেষ করে ঠিকঠাক চাকরি পেতে অদ্বয়ের সময় লাগছিল। এ দিকে তিয়াস তেত্রিশে পা দিয়েছেন। আত্মীয়স্বজন-পাড়াপ্রতিবেশির প্রশ্ন আর কৌতূহলে অর্ণববাবুদের নাজেহাল অবস্থা। বাড়িতে মেয়ের সঙ্গে বিয়ে নিয়ে নিত্য তুলকালাম।
স্মিতা বলেন, “কয়েকজন তো আমাকে আকার-ইঙ্গিতে জিজ্ঞাসাই করেছেন তিয়াস সমকামী কি না। মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমাদের। তিয়াসের বিয়ের আগে যদি আমাদের কিছু হয়ে যায় তাহলে মেয়েটার কী হবে, কে দেখবে?”
এই বিয়ের ইস্যুতেই মা-বাবার সঙ্গে প্রায় রোজ ঝামেলা হয় সপ্তপর্ণা-র। বাঘাযতীনের সপ্তপর্ণা এমবিএ পাশ করে বেসরকারি সংস্থায় মোটা মাইনের চাকরি করেন। যথেষ্ট আকর্ষণীয়া, ঝকঝকে, বুদ্ধিদীপ্ত ২৯ বছরের তরুণী। বিয়ের প্রস্তাব একাধিক বার এসেছে স্বাভাবিক ভাবেই। সপ্তপর্ণা ‘না’ করেছেন। প্রথমত, তাঁর প্রতিজ্ঞা, পাত্রপক্ষের সামনে সেজেগুজে বসবেন না। বরং প্রেমে পড়ার অপেক্ষা করবেন। বিয়ে ব্যাপারটাতে তিনি ‘ধীরে চলো’ তত্ত্বে বিশ্বাসী। তাঁর ব্যাখ্যায়, বিয়ের পর কিছু দিন রোম্যান্সে হাবুডুবু খাওয়া, স্পর্শে গা শিরশির, চোখে হারানো, তুমি-আমি মার্কা মিষ্টি কথা। তার পর বছর ঘুরতে-না-ঘুরতে সবকিছু একঘেয়ে, ক্লিশে। আকর্ষণ-টাকর্ষন হাওয়া, হাতে রইল শুধু ‘কম্প্রোমাইজ’।
সেই যে লাবণ্য বলেছিলেন, “বিয়ের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ে স্ত্রী-পুরুষ বড়ো বেশি কাছাকাছি এসে পড়ে মাঝে ফাঁক থাকে না, তখন একেবারে গোটা মানুষকে নিয়েই কারবার করতে হয় নিতান্ত নিকটে থেকে। কোনও একটা অংশ ঢাকা রাখবার জো থাকে না।” সপ্তপর্ণাও সেই একই কারণে তাড়াতাড়ি বিয়ের মধ্যে না-ঢুকে জীবনটাকে আইসক্রিমের মতো চেটেপুটে উপভোগ করতে চান।
বাবা-মা দিশেহারা দেখে আশ্বাস দিয়েছেন, “চিন্তা কোরো না। এখন অনেক হাইফাই বৃদ্ধাশ্রম আছে। টাকা জমাচ্ছি। বিয়ে না-করলে বুড়োবয়েসে বৃদ্ধাশ্রমে থাকব। এমনিতেই এখন ছেলেমেয়েরা মা-বাবাকে দেখে না।”
কিন্তু এই প্রবণতা কি দায়িত্বহীনতা নয়? স্বার্থপরতা নয়? সামাজিক কাঠামো, পারিবারিক বন্ধন, মূল্যবোধ কি তা হলে অর্থহীন? বাবা-মায়ের চিন্তাটাও তো একেবারে অযৌক্তিক নয়। চিকিৎসক-সমাজতাত্ত্বিক-মনোবিদরা বলছেন, বেশি বয়সে বিয়ে হলে ছেলে-মেয়ে উভয়ের মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা কমে, ধৈর্য কমে। দেরিতে বিয়ের জন্য বাচ্চাও দেরিতে হয়। বাবা-মা যখন ষাট পার করে ফেলেছেন তখন দেখা যায় ছেলে বা মেয়ে হয়তো সবে মাধ্যমিক পাশ করছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, দেরিতে সন্তান হতে গিয়ে মায়ের এবং সন্তানের কিছু শারীরিক সমস্যা হতে পারে। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ তরুণকান্তি ঘোষ যেমন জানালেন, মেয়েদের বেশি বয়সে সন্তান ধারণে অসুবিধা হয়, ডেলিভারির পর অনেক সময় রক্ত বন্ধ হতে চায় না, তা ছাড়া সন্তান নষ্ট হওয়ার বা শারীরিক-মানসিক ভাবে বিকলাঙ্গ সন্তান জন্মানোর আশঙ্কা থাকে। বিশেষ করে বেশি বয়সের সন্তানদের মধ্যে ডাউন সিনড্রোমের মতো রোগের আশঙ্কা বেশি। এত কিছুর পরেও কিন্তু দেরিতে বিয়ে করার হার ক্রমশ বাড়ছে। সমাজতাত্ত্বিক প্রদীপ বসু বলছেন, আসলে পারিপার্শ্বিকটাই বদলে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম দেখছে আশপাশে বহু বিয়ে টিকছে না। চারদিকে অসুখী দাম্পত্য, ভাঙা সম্পর্ক, সন্তান মানুষ করা নিয়ে ব্যস্ত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে টানাপোড়েন। এতে তাঁদের মোহভঙ্গ হচ্ছে। পাশাপাশি, সামাজিক জীবনের চাহিদা বদলে যাচ্ছে, ভুবনীকরণ এই প্রজন্মের চোখ খুলে দিচ্ছে। আগে মানুষ শেষ বয়সে বা অবসর নিয়ে একটা বাড়ি করত, গাড়ি কিনত। এখন কনসেপ্ট হল, জীবনটা আগে তো ভোগ করে নাও এবং আর্থিক ভাবে সুস্থিত হও, তার পর না হয় ...।
ইংরাজি সাহিত্যের তরুণ, অবিবাহিত অধ্যাপক দিগন্ত উপাধ্যায়-ও এই ভাবনার মধ্যে তেমন কোনও সামাজিক সঙ্কট খুঁজে পান না। তাঁর যুক্তি, “একজন যোগ্য, প্রতিভাবান, শিক্ষিত, উচ্চাভিলাষী তরুণ বা তরুণীর ক্ষেত্রে দ্রুত বিয়েটা অনেক সময় তাঁর আর্থ-সামাজিক গতিবিধির অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
হয়তো তিনি অন্য রাজ্যে বা বিদেশে কাজ বা পড়াশোনার কোনও সুযোগ পেলেন। কিন্তু পারিবারিক কিছু দায়িত্ব, ছেলেমেয়ের জন্য যাওয়া হল না। তিনি হয়তো একটা নতুন চাকরির ঝুঁকি নিতে চাইছেন, কিন্তু বিয়ে করেছেন বলে নিতে পারছেন না। তখন মনে হয়, এত কষ্ট করে, সময় নষ্ট করে পড়াশোনা, স্ট্রাগল সব বৃথা। এই অবসাদটা তিনি নেবেন, কেনই বা নেবেন?”
এই কথাটাই একটু অন্য ভাবে বলছিলেন সুস্মিতা মিত্র। উচ্চশিক্ষিতা, স্বাধীনচেতা, স্কুলের শিক্ষিকা। এখনও বিয়ে করেননি।
তাঁর ব্যাখ্যায়, “আগে সমাজে সুযোগের ক্ষেত্রটা অসম ছিল। অর্থনৈতিক বলে বলীয়ান পুরুষ পরিবার এবং সমাজের উপর ছড়ি ঘোরাত। আমরা আমাদের মা-দিদিমাদের দেখেছি মুখ বুজে অনেক অন্যায় সহ্য করতে। তাঁদের অনেক সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু সুযোগ পাননি। বহু শখআহ্লাদ পূরণ করতে পারেননি। তখনই মেয়েরা বুঝেছে, অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিধর হলে ক্ষমতার রাশ তাঁর হাতেও আসবে, নিজের মতমাফিক, সম্মান নিয়ে সে-ও বাঁচতে পারবে। অনেক লড়াইয়ের পর ক্ষমতাটা আমরা পেয়েছি। একটু উপভোগ করি।”
আপনারা শুনে চমকিত হতে পারেন অমিত-লাবণ্য, এই প্রজন্মের অনেকে কিন্তু জড়তামুক্ত যৌনতার প্রতি সমাজের ক্রমশ ধাতস্থ হওয়াকেও দেরিতে বিয়ের অন্যতম কারণ মনে করেন। সমাজতাত্ত্বিক রামানুজের ব্যাখ্যায়, একটা সময় ছিল যখন দীর্ঘদিনের প্রেমিক-প্রেমিকাও বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্ককে পাপ, অনৈতিক বলে মনে করতেন। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক, যৌনসম্পর্কে সক্ষম মানুষের শরীরের খিদে তো তাতে চাপা থাকে না। এটা তো প্রাকৃতিক প্রবণতা। তাই শারীরিক চাহিদা পূরণ ছিল তাড়াতাড়ি বিয়ের বড় কারণ। যদিও এ ব্যাপারে আপত্তি তুললেন ম্যারেজ রেজিস্ট্রার শঙ্করী চক্রবর্তী। আর্থিকভাবে থিতু হয়ে বিয়ে করার তিনি পক্ষে, কিন্তু ‘প্রি-ম্যারিটাল সেক্স’? অসম্ভব। বললেন, “বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটি উচ্ছন্নে পাঠানোর জন্য এই সামাজিক কুকর্মগুলো যথেষ্ট। এমন প্রেম স্থায়ী হবে, তারই বা গ্যারান্টি কই! তখন? এ ধরনের মানসিকতা সমাজটাকে গোল্লায় পাঠাচ্ছে।”
কিন্তু এ প্রজন্মের যে শরীর নিয়ে জড়তা অনেক কম। এঁরা বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্ককে ব্যভিচার মনে করে না। শরীরের চাহিদার জন্য তাড়াতাড়ি বিয়ের দরকার পড়ে না।
অমিত, আপনার বিয়ের পরেও একই সঙ্গে কেতকীরূপী ‘ঘড়ার জল’ ব্যবহারের এবং লাবণ্যরূপী ‘দিঘি’তে সাঁতার দেওয়ার ক্ষমতা ছিল হয়তো, কিন্তু সকলের তো সেই ধক থাকে না। তাই এই প্রজন্মের অনেকেই ভাবেন, যতদিন পারা যায় ‘দিঘি’তে সাঁতার দিই, তার পর তো সেই ঘড়ার জল খেতেই হবে। তাতে একটু দেরি হলে হোক। আর এখনকার অনেক সাহসিনীকে প্রশ্ন করলে তাঁরা দৃঢ়তা নিয়ে আপনার লাবণ্যের মতোই বলেন, “বিয়ে করে দুঃখ দিতে চাইনে। বিয়ে সকলের জন্যে নয়।”
|