দক্ষিণবঙ্গ তাঁর শক্ত ঘাঁটি, দেখা গিয়েছিল গত লোকসভা ও বিধানসভা ভোটে। পঞ্চায়েত ভোটেও দক্ষিণবঙ্গে বিপুল দাপট ধরে রাখতে চলেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। এবিপি আনন্দ-এ সি নিয়েলসেনের যৌথ জনমত সমীক্ষা অন্তত তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
কংগ্রেস বরাবরই উত্তরবঙ্গে শক্তিশালী। এ বারের পঞ্চায়েত ভোটেও তাদের ভাল প্রভাব দেখা যেতে পারে মালদহ ও উত্তর দিনাজপুরে। দুই বঙ্গের মধ্যবর্তী মুর্শিদাবাদ জেলা অধীর চৌধুরীর
খাস তালুক। ৫০%-এর বেশি ভোট পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও অধীরের গড়ে সমীক্ষায় এগিয়ে কংগ্রেসই।
আর সমীক্ষা বলছে, বামেদের খালি হাতেই ফেরাতে পারে দক্ষিণবঙ্গ! নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে তাদের জেলা পরিষদ জয়ের সম্ভাবনা একমাত্র উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়িতে। কোচবিহারেও তারা এগিয়ে। তবে সেখানেও তৃণমূলের যথেষ্ট লড়াইয়ে থাকার ইঙ্গিত।
পাঁচ বছর আগের পঞ্চায়েত ভোট থেকেই বামেদের ভোটব্যাঙ্কে ধাক্কার সূচনা। তার পরের লোকসভা ভোটে আরও বড় ধাক্কা, বিধানসভা ভোটে ধরাশায়ী হওয়ার পরে এ বারের জনমত সমীক্ষায় আভাস পাওয়া যাচ্ছে, বামেদের বিপর্যয়ের কাহিনি এখনও শেষ হয়নি! রাজ্যের মোট ১৭টির মধ্যে ১৩টি জেলা পরিষদ এখন বামেদের হাতে। সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, পঞ্চায়েত ভোটের পরে কোণঠাসা বামেদের হাতে থাকতে পারে শুধু উত্তরবঙ্গের দু’টি জেলা পরিষদ। সার্বিক বিচারে বামেদের (৩২%) তুলনায় অনেক কম ভোট পেয়েও কংংগ্রেস (৯%) বরং দুই থেকে বেড়ে তিন হতে পারে। মালদহ ও উত্তর দিনাজপুর ধরে রাখার পাশাপাশি তারা জিততে পারে মুর্শিদাবাদের জেলা পরিষদ।
ঘটনাচক্রে, মনোনয়ন ও প্রচার-পর্বে শাসক দলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ দক্ষিণবঙ্গেই বেশি। উত্তরবঙ্গে বরং টক্কর তুলনায় সেয়ানে-সেয়ানে! জনমত সমীক্ষা দেখাচ্ছে, সেই দক্ষিণবঙ্গেই তৃণমূলের বিজয়-রথ অপ্রতিরোধ্য! সব রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা নির্বিঘ্নে মনোনয়ন জমা দিতে পেরেছেন কি না, এর জবাবে অবশ্য সমীক্ষার উত্তরদাতাদের কাছ থেকে অন্য রকম ছবি পাওয়া যাচ্ছে। ৫৩% মানুষই বলেছেন ‘হ্যাঁ’। নির্বিঘ্নে জমা দিতে পারেননি, এই উত্তর ২২ শতাংশের। ২৫% উত্তরদাতা ‘জানি না’ বা ‘বলতে পারব না’ বলে স্পষ্ট জবাব এড়িয়ে গিয়েছেন।
তা হলে কি বিরোধীদের সন্ত্রাসের অভিযোগ জন-দরবারে টিকছে না? বিরোধী দলগুলি এই তত্ত্ব মানতে নারাজ। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিমের ব্যাখ্যা, “সব জায়গায় একই রকম ভাবে সন্ত্রাস হয়েছে, এমন কথা তো বিরোধীরা বলেননি! হতে পারে, যেখানে যেখানে সমীক্ষকেরা গিয়েছেন, সে সব জায়গায় একই রকম ভাবে সন্ত্রাস ছিল না।” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের যুক্তি, “মনোনয়ন পেশ করতে গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলি আক্রান্ত হয়েছে। সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হননি। ফলে, তাঁরা মনোনয়নের সময়ের সন্ত্রাসের ব্যাপারটি জানেন না।” আর জোরালো আপত্তি জানিয়েছে বিজেপি। “এই তথ্যে গলদ আছে বা মানুষ সত্য বলতে ভয় পেয়েছেন!” সাফ দাবি বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের।
তৃণমূল অবশ্য গোড়া থেকেই সন্ত্রাসের অভিযোগ নস্যাৎ করে আসছে। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুুকুল রায়ের বক্তব্য, এ বার ১ লক্ষ ৬৯ হাজারেরও বেশি প্রার্থী রয়েছেন পঞ্চায়েতে। মুকুলবাবুর প্রশ্ন, সন্ত্রাস হলে এত প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিলেন কী ভাবে? কংগ্রেস-সিপিএম-বিজেপি মিলে অহেতুক কুৎসা করছে বলে শাসক দলের পাল্টা অভিযোগ।
তবে বিরোধীদের আরও বক্তব্য, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফয়সালা হয়ে-যাওয়া আসনগুলি ছাড়াও বহু জায়গায় তৃণমূলের আনুষ্ঠানিক প্রার্থীর সঙ্গে দলেরই বিক্ষুব্ধ প্রার্থীদের লড়াই হচ্ছে। ফলে, বহু জায়গাতেই বিরোধীরা আসলে ময়দানে নেই। তাই ভোটপ্রাপ্তির হিসেবও গোলমেলে হতে বাধ্য। গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বে কিছু জায়গায় অনভিপ্রেত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে মেনে নিয়েও তৃণমূল শিবিরের পাল্টা যুক্তি, ওই সব আসনে যে-ই জিতুন, ভোটের পরে তিনি তৃণমূলেরই প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত হবেন! তাই সেই ভোটের হিসেবও তৃণমূলের পক্ষে হবে!
সমীক্ষায় মমতার পক্ষে স্বস্তির ইঙ্গিত, গত পাঁচ বছরে দুর্নীতি এবং গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের নানা অভিযোগ সত্ত্বেও দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা পরিষদ ধরে রাখতে পারে তৃণমূল। গোষ্ঠী-লড়াইয়ের মধ্যেই হাতে আসতে পারে বীরভূম। জয় আসতে পারে বাঁকুড়া ও বর্ধমানের মতো এক কালের বাম দুর্গে। কামদুনির প্রভাব কাটিয়েও ঝুলিতে আসতে পারে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদ। উত্তরবঙ্গে খাতা খুলতে পারে দক্ষিণ দিনাজপুরে।
পঞ্চায়েতে তৃণমূলের আধিপত্য বেশি হবে, ধরে নিয়েই ময়দানে আছে বিরোধীরা। সিপিএমের এক রাজ্য নেতার কথায়, “এর আগের সমীক্ষায় আগামী লোকসভা ভোটে আমাদের ভাল ফলের ইঙ্গিত ছিল, পঞ্চায়েতে তৃণমূলের জন্য ভাল খবর এল! তবে পঞ্চায়েতে যা-ই হোক, লোকসভায় অন্য লড়াই হবে!” |