পঞ্চায়েত ভোট করা নিয়েই রাজ্য সরকারের সঙ্গে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দীর্ঘ সংঘাত এবং আইনি লড়াই। হারের ভয়ে শাসক দল পঞ্চায়েত ভোট করতেই চায়নি বলে বিরোধীদের প্রবল সমালোচনা। আদালতে রাজ্য সরকারের একের পর এক ধাক্কা। কামদুনি কাণ্ডের পরে নাগরিক সমাজের বড় অংশের প্রতিবাদ। কিন্তু এত সবের পরেও আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের আধিপত্যেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে জনমত সমীক্ষা।
পঞ্চায়েত ভোটের আগে এবিপি আনন্দ-এ সি নিয়েলসেনের যৌথ জনমত সমীক্ষায় উঠে এসেছে, সাম্প্রতিক কালে নানা ঘটনায় রাজ্য সরকার তথা শাসক দলের ভূমিকা সমালোচিত হলেও ভোটবাক্সে তৃণমূলের প্রভাব এখনও অন্যদের তুলনায় বেশি। সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলা পরিষদ স্তরে তৃণমূল সামগ্রিক ভাবে পেতে পারে ৪৩% ভোট। প্রধান বিরোধী বামফ্রন্ট পেতে পারে ৩২% এবং আর এক বিরোধী দল কংগ্রেস ৯%। মত জানাতে চাননি ১০%। দেখা যাচ্ছে, ৪৩% ভোট পেয়ে ১৭টির মধ্যে তৃণমূলের জয়ের সম্ভাবনা ১১টি জেলা পরিষদে। তার মধ্যে ৯টিতে তাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা (অর্থাৎ ৫০%-এর বেশি ভোট) পেতে পারে। বামেরা ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেতে পারে জলপাইগুড়িতে। তারা এগিয়ে পড়শি জেলা কোচবিহারে। কংগ্রেস কোথাও নিরঙ্কুশ না-হলেও এগিয়ে মুর্শিদাবাদে।
এর বাইরে তিনটি জেলা পরিষদের পুরুলিয়া, মালদহ এবং উত্তর দিনাজপুর, ভাগ্য অনিশ্চিত। এই তিনটি জেলাতেই বেশ বড় অংশের মানুষ সমীক্ষকদের জানাতে চাননি তাঁরা কোন দলকে ভোট দেবেন। মালদহে এমন উত্তরদাতার সংখ্যা ৫৫%। পুরুলিয়া এবং উত্তর দিনাজপুরে যথাক্রমে ৩৫% ও ২৩%। রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে পুরুলিয়ায় সব চেয়ে এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল। সমীক্ষা বলছে, তারা পেতে পারে ৩৩ শতাংশ ভোট। আর মালদহ এবং উত্তর দিনাজপুরে এগিয়ে থাকা কংগ্রেস দু’জায়গাতেই ২৩ শতাংশ ভোট পেতে পারে।
যে যে জেলায় পঞ্চায়েত ভোট হচ্ছে, তার সব ক’টিতেই ঘুরেছেন সমীক্ষকেরা। সমীক্ষা হয়েছে গত ৭ থেকে ১৫ জুনের মধ্যে। অর্থাৎ সমীক্ষার জন্য যখন মতামত নেওয়া হচ্ছে, কামদুনির গণধর্ষণের খবর তত দিনে শিরোনামে। তারও আগে ঘটে গিয়েছে সারদা-কাণ্ড। জনমানসে প্রভাব ফেলার মতো এমন দু’টি ঘটনার পরেও জেলা পরিষদে তৃণমূলের আধিপত্যের ইঙ্গিত তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে।
বিস্তারিত দেখতে
ক্লিক করুন... |
|
তবে অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে, এই ধরনের জনমত সমীক্ষা কখনও মিলেছে, কখনও মেলেনি। নমুনা সংগ্রহ করে তাকে গাণিতিক ভাবে সাধারণ চেহারা দেওয়ার এই প্রয়াস নিয়ে বরাবরই নানা প্রশ্ন এবং সংশয় আছে। এ বারের পঞ্চায়েতে মোট ভোটার যেমন সাড়ে চার কোটির বেশি। তার মধ্যে মাত্র ৯ হাজার জনের সঙ্গে কথা বলে এই বিপুল জনতার মনোভাবের হদিস সন্ধান কতটা গ্রহণযোগ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকেই। অতীতে সব সমীক্ষার ক্ষেত্রেই এই প্রশ্ন উঠেছে। তবে সমীক্ষকদের যুক্তি, নমুনা থেকেই সার্বিক রাজনৈতিক চিত্রের একটা আভাস এই ধরনের সমীক্ষা থেকে উঠে আসে।
কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের একাংশের মতে, ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের মতো নির্বাচনে জনমত সমীক্ষার অঙ্ক কষা খুবই কঠিন। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মহম্মদ সেলিমের কথায়, “অনেকটা লোকসভা বা বিধানসভা ভোটের ধাঁচে এই সমীক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু পঞ্চায়েতের ভোট লোকসভা বা বিধানসভার সঙ্গে মেলে না। একই ভোটার জেলা পরিষদে যাদের ভোট দিয়েছেন, পঞ্চায়েত সমিতি বা গ্রাম পঞ্চায়েতে তাদের দেননি এই রকম অজস্র নজির আছে। একই জেলার আলাদা মহকুমায় আলাদা রাজনৈতিক ছবি পঞ্চায়েতে দেখা যায়।” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যেরও মত, “এ রাজ্যে এত বিচিত্র জনগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের চিন্তাভাবনা ধরার মতো কোনও যন্ত্র রয়েছে বলে মনে করি না! বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর নির্দিষ্ট ভাবনা থাকতে পারে বলেও মনে করি না। তাই এই সমীক্ষায় উঠে আসা মত অনুমান মাত্র! একে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণ নেই।”
আপাতদৃষ্টিতে সমীক্ষার এই ফল তৃণমূল নেতৃত্বের জন্য স্বস্তিদায়ক। তবু তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের সতর্ক প্রতিক্রিয়া, “সমীক্ষার প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। মানুষের উপরে আস্থা রাখছি। মানুষই ঠিক করবে, আগামী দিনে পঞ্চায়েত কার হাতে থাকবে। আমরা বিশ্বাস করি, গত দু’বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সরকার যে উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ শুরু করেছে, তাতে মানুষ সামিল হবে।” তাঁর অভিযোগ, তৃণমূলের সরকারের বিরুদ্ধে সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপি মিলে কুৎসা এবং অপপ্রচার করছে। মুকুলবাবুর সাফ কথা, “মানুষ ভোটবাক্সে ওই কুৎসা ও অপপ্রচারের জবাব দেবে!”
জেলাওয়াড়ি পরিসংখ্যানে যা দেখা গিয়েছে, তা নিয়েও কিছু ধন্দ আছে। অধিকাংশ জেলায় পঞ্চায়েতের কাজ ভাল বলছেন, এমন লোকের সংখ্যা বেশি। এখন রাজ্যের ১৩টি জেলায় জেলা পরিষদ বামেদের হাতে। অর্থাৎ, বামেদের কাজে সাধারণ মানুষ মোটের উপর খুশি। তা সত্ত্বেও বেশির ভাগ জেলায় সমীক্ষার আওতায় আসা অধিকাংশ মানুষ তৃণমূলকে ভোট দেওয়ার কথা বলেছেন। এমনকী, ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে বামফ্রন্ট, কংগ্রেসকে ভোট দেওয়া অনেকে এ বার তৃণমূলকে ভোট দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তৃণমূলকে ছেড়ে বাম-কংগ্রেসের দিকে ঝোঁকা মানুষের সংখ্যা তুলনায় কম।
এই প্রবণতার ব্যাখ্যা সমীক্ষা থেকে মেলেনি। যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা। সেলিমের দাবি, “পঞ্চায়েত ভোটের জন্য রাজ্যের নানা প্রান্তে ঘুরে দেখছি, তৃণমূল সরকারের প্রতি মানুষের মোহভঙ্গ হচ্ছে। এই অবস্থায় আরও বেশি মানুষ তৃণমূলকে সমর্থন করবেন, এটা খুব বাস্তবসম্মত ছবি বলে মনে হচ্ছে না।” প্রদীপবাবুও বলছেন, “যত দিন যাচ্ছে তৃণমূলের গ্রহণযোগ্যতা কমছে। ফলে, তৃণমূলের ১১টি জেলা পরিষদ পাওয়ার অবস্থা থাকবে বলে মনে হয় না।”
বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহও মনে করেন, এই সমীক্ষার সব তথ্য ঠিক নয়। তবে তৃণমূলের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা মানছেন তিনি। তাঁর বক্তব্য, “পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের বিপর্যয় হবে ঠিকই। তবে তাদের দু’বছরের কাজকর্মের জেরে যতটা বিপর্যয় হওয়ার কথা, ততটা হবে না।” তাঁর ব্যাখ্যা, “মানুষ সিপিএমের কাছে ফিরতে চাইছে না। ফলে, এখন তৃণমূলের বিকল্প নেই।” |