ছেলের খুনের ঘটনায় সিবিআই তদন্ত চান মা। ছেলের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে একই সঙ্গে চান, কামদুনিতে ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনাতেও তদন্তভার নিক কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা।
ঠিক এক বছর আগে, ৫ জুলাই গোবরডাঙা স্টেশনের সামনে দুষ্কৃতীদের গুলিতে নিহত হন বরুণ বিশ্বাস। শুক্রবার ছেলের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে মা গীতাঞ্জলিদেবী কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “কামদুনির ঘটনায় পুত্রশোকের মতো আঘাত পেয়েছি। আর কোনও মায়ের কোল যেন এ ভাবে কখনও খালি না হয়ে যায়। আমার ছেলেকে খুনে কারা জড়িত তা জানতে সিবিআই তদন্ত চাই। ওই মেয়েটাকে খুনের ঘটনাতেও সিবিআই তদন্ত হওয়া দরকার।
সুবিচার পেতে আমাদের এমন ভিক্ষা করতে হবে কেন?” কান্নায় গলা জড়িয়ে আসে বৃদ্ধার। তারই মধ্যে তিনি বলে চলেন, “মাঝে মধ্যে মনে হয়, শরীর-স্বাস্থ্য ভাল থাকলে কামদুনি গিয়ে ওদের পাশে দাঁড়াই। আমার ছেলেটা বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই এত দিনে তা-ই করত।”
২০০০-০৩ সাল নাগাদ সুটিয়ায় একের পর এক গণধর্ষণের ঘটনার পরে স্থানীয় মানুষ প্রতিবাদী মঞ্চ গড়ে আন্দোলনে নামেন। তারই সামনের সারিতে ছিলেন মিত্র ইন্সটিটিউশনের শিক্ষক বরুণ। তাঁর পরিবারের দাবি, ঘটনায় মূল ষড়যন্ত্রকারীরা এখনও অধরাই রয়েছে। |
বরুণ-খুনের পরে সিআইডি তদন্তে নেমে জানতে পারে, গণধর্ষণ কাণ্ডে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী সুশান্ত চৌধুরী দমদম সেন্ট্রাল জেলে বসেই খুনের ছক কষেছিল। সেই মতো লোক লাগিয়ে বরুণকে সরিয়ে দেয় সে। এই মামলায় ৭ জনকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করেছে সিআইডি। সুশান্তর বিরুদ্ধেও নতুন করে মামলা শুরু হয়েছে। যদিও বরুণের বাবা জগদীশবাবুও বলেন, “চার্জশিটে প্রকৃত অপরাধীদের নাম নেই। সিআইডির চার্জশিটে আমাদের কোনও ভরসা নেই। টাকার জোগান কোথা থেকে এল, তা-ও জানাতে পারেনি সিআইডি। ছেলের মৃত্যু-রহস্য উদ্ঘাটন করতে সিবিআই তদন্ত চাই।”
বরুণকে খুনের পিছনে তৃণমূলের এক মন্ত্রী ও দলের স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু নেতা জড়িত থাকতে পারেন বলেও সংশয় প্রকাশ করেছেন জগদীশবাবু। প্রতিবাদী মঞ্চের সভাপতি ননীগোপাল পোদ্দারের আবার অভিযোগ, শুরুর দিকে মঞ্চের বিরোধিতা করেছিল তৃণমূল। বরুণের পরিবারের অভিযোগ প্রসঙ্গে মন্তব্য না করলেও খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক দাবি করেছেন, “রাজনৈতিক স্বার্থে প্রতিবাদী মঞ্চকে ব্যবহার করছেন ননীগোপালবাবুরা।” শুক্রবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেত্রী দীপা দাশমুন্সি দেখা করেন বরুণের পরিবারের সঙ্গে। দীপাদেবী রাজনীতি করতেই এসেছেন বলে কটাক্ষ করেছেন জ্যোতিপ্রিয়।
এ দিনও বনগাঁ মহকুমা আদালতে মামলাটির শুনানি হয়েছে। সাক্ষ্য দেন বরুণের দাদা অসিত। সওয়াল-জবাব চলাকালীন কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। সুটিয়া থেকে মহিলারা দু’টি গাড়িতে করে হাজির হয়েছিলেন আদালতের সামনে। সেখানে সিবিআই তদন্ত ও দোষীদের চরম শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ দেখান তাঁরা।
সুটিয়ার স্মরণসভায় উপস্থিত ছিলেন এসইউসিসি সাংসদ তরুণ মণ্ডল, গাইঘাটার সিপিএম নেতা অরুণ মহাপাত্র, সিপিআইয়ের জোনাল কমিটির সম্পাদক অরুণজিৎ কর্মকার, চিত্রশিল্পী সমীর আইচ, গায়ক শুভেন্দু মাইতি প্রমুখ। তবে তৃণমূলের কাউকেই সেখানে দেখা যায়নি। বরুণের মা অনুষ্ঠান মঞ্চে উঠে হঠাৎই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূল পর্যবেক্ষক জ্যোতিপ্রিয়বাবু পরে বলেন, “ওঁদের (বরুণের বাবা-মা) অভিযোগ নিয়ে কোনও রকম মন্তব্য করব না। তবে আমরাই সুটিয়ায় পুলিশ ক্যাম্পের শক্তিবৃদ্ধি করেছি। ওখানে ফাঁড়ি তৈরি করার প্রক্রিয়াও এখন চলছে। বরুণকে খুনে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। সুটিয়ায় কারা দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে লড়েছে, তা সেখানকার মানুষ ভালই জানেন।”
এ দিন সকালে গোবরডাঙায় বরুণের স্মরণসভায় উপস্থিত ছিলেন দীপা। পরে নিহত শিক্ষকের বাড়িতে গিয়ে দেখা করেন পরিবারের সঙ্গে। দোষীদের শাস্তি চেয়ে বরুণের বাবা-মা রাষ্ট্রপতির কাছে দরবার করতে চান। এই ব্যাপারটি নিয়ে তাঁরা অনুরোধ করেছেন দীপাদেবীর কাছে। আশ্বাসও মিলেছে। দীপা বলেন, “আমি রাজনীতি করি ঠিকই। কিন্তু এক জন রাজনীতিবিদ হিসাবে আমি এখানে আসিনি।”
বরুণের জীবন-কাহিনী নিয়ে ছবি তৈরি করেছেন পরিচালক রাজ চক্রবর্তী। ৯ অগস্ট মুক্তি পাচ্ছে সেই ছবি। এ দিন সন্ধ্যায় সুটিয়া-বারাসত পল্লি উন্নয়ন বিদ্যাপীঠের মাঠে দেখানো হয় ‘প্রলয়’ নামে ছবিটির ট্রেলার। বড় প্রজেক্টরে সাড়ে তিন মিনিটের ট্রেলারটি দেখানো হয় বার কয়েক। ভিড়ে উপচে পড়ছিল মাঠ।
রাজ পরে জানান, আনন্দবাজার পড়েই জানতে পারেন বরুণের কথা। উত্তেজিত হয়ে টেলিফোন করেন চিত্রনাট্যকার পদ্মনাভ দাশগুপ্তকে। বলেন, সিনেমায় অনেক তো হিরো বানালাম। সব নকল হিরো। একটা আসল হিরোর সন্ধান পেয়েছি।
রাজের কথায়, “আমি তো মারপিট করতে পারব না। রাজনৈতিক বক্তৃতাও করতে পারব না। আমার কাজ ছবি তৈরি। সেই ভাষাতেই প্রতিবাদ জানালাম।”
|