অঞ্জন-ব্যঞ্জন
এক্কেবারে জগাখিচুড়ি
শ্যামপুকুর মোড়ে দাঁড়িয়ে সাইকেল বিড়িতে শেষ সুখটান দিচ্ছিল জগা। হঠাৎ আমাকে দেখে যেন ভূতের মতো চমকে উঠল। আমি ওকে না দেখার ভান করে যেই রাস্তা পার হতে যাব, অমনি দিব্যি ঝকঝকে আকাশ থেকে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। জগা তো তাই দেখে পড়ি কী মরি করে দুদ্দাড় ছুট। আমি মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে কাকভেজা ভিজতে ভিজতে চেঁচিয়ে উঠলাম, “ওরে জগা, পালাস না বাপ আমার, তোকে আমি আর খিচুড়ি রাঁধতে বলব না!”
আসলে, খিচুড়ি রাঁধার জন্য জগা গোটা তল্লাটেই বিখ্যাত। আর আমি কত বর্ষায় যে ওকে খিঁচুড়ি রাঁধতে বলেছি তার ইয়ত্তা নেই।
বিশ্বাস করুন, বর্ষাকাল এলেই খিচুড়ি নিয়ে এই স্বপ্নটা জগা-খিচুড়ি হয়ে আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। আসলে, সেই হাফপ্যান্ট পরা বয়েস থেকেই আকাশ থেকে দু-এক ফোঁটা জল ঝরল কি ঝরল না, অমনি রোজকার মেনুতে ভাতের বদলে খিচুড়ি হয়ে যায় আপনা-আপনি। আপনি অবশ্য বলতেই পারেন, এতে অবাক হওয়ার মতো আছেটা কী। বাঙালি মাত্রেই এই রোগ তো ঘরে ঘরে। সত্যিই, বৃষ্টি নামলে বাঙালির জীবনে ভাত-ডালের সঙ্গে মেলামেশাটা যেন হঠাৎ করেই একটু বেড়ে যায়। আজকাল তো আবার ফেসবুকে স্টেটাসও হয়, আয় বৃষ্টি ঝেপে, খিচুড়ি দেব মেপে! তো, এই খিচুড়ি-বাতিক হল গিয়ে বাঙালির বাপের সম্পত্তি। যুগ যুগ ধরে পুরুষানুক্রমে এই মিক্সচার বাংলার ঘরে ঘরে চলে আসছে। তেলজলে মিশ না খেলেও, চালেডালের এই মিলমিশ সেই ঈশ্বরী পাটনীর আমল থেকে বহাল।
কিন্তু, শুধুই কি খিচুড়ি? সঙ্গতে, পাঁপড়ভাজা থেকে ডিমের অমলেট হয়ে ঐশ্বরিক ইলিশ কাকে ছেড়ে কার কথা বলি! আর খিচুড়িও কি এক রকম? রকমফেরে, সেও তো রকমারি। আমিষ-নিরামিষ, ভাগাভাগির কি শেষ আছে। পুজোর খিচুড়িভোগ এক তো ভুনিখিচুড়ি আর এক। মা-মাসিমার হাতবদলেও বদলে যায় খিচুড়ির স্বাদ। ঠিক যেমন, চাল বা ডাল বদলালে, খিচুড়ির আস্বাদ পাল্টে যায় নিমেষে। মুসুরির ডালের খিচুড়ির যে টেস্ট, মুগ ডাল হলে আবার অন্য রকম। তাই, খিচুড়ি চালে-ডালে এক হলেও, রসনা বৈচিত্রে রীতিমতো একাধিক।
আর একটা ব্যাপার, এত সহজ রেসিপি আর কটা খাবারের হয় বলুন? চিনেরা দাবি করে, চাইনিজ না কি বিশ্বের সবচেয়ে সহজ ফর্মুলা। আমি তো বলব, খিচুড়ির ধারেকাছে কেউ নেই। যে জীবনে রান্নাঘরে অবধি ঢোকেনি, সেই আনাড়িও আর কিছু না পারুক, খিচুড়ি বানাতে পারবে। আজকাল খুব ফিউশন রেসিপির কথা শোনা যায়। খিচুড়ি হচ্ছে সেই ফিউশনের আদি সংস্করণ। ইতালিয়ানরা যে রিসেত্তো রাঁধে, সেও তো বাংলা খিচুড়ি মশাই! তা, এখন তো বৃষ্টিও ভুগোল বিশেষে ভ্যারি করে। এই ধরুন, হাতিবাগানে বৃষ্টি হচ্ছে তো গড়িয়াহাটে ঠা-ঠা রোদ্দুর। লোকাল ওয়ার্মিং-এর চোটে বাঙালির আজ ত্রাহি মধুসূদন কেস! আলিপুর যদি বলে আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে, তো সে দিন দেখবেন মেঘটেঘ কোনও সিনেই নেই! তাই, আপনি যে ওয়েদার ফোরকাস্ট দেখে গিন্নিকে খিচুড়ির রিকুইজিশন দেবেন, সেটা হওয়ার যো নেই। আর, বৃষ্টি না হলে, শুকনো দিনে খিচুড়ি তো একেবারেই যায় না।
শুধু খিচুড়ির কথা বললে আমার এই গপ্পোটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। অতএব, সঙ্গতকারীদের প্রসঙ্গে আসা যাক। আর এই ব্যাপারে, আমার এবং আপামর বাঙালির লিস্টিতে প্রথমেই নাম মাছের রাজার, অর্থাৎ, ইলিশ। ভেবে দেখুন, ইলশেগুড়ি বৃষ্টি শুরু হতে-না-হতেই খবরের কাগজে শিরোনাম: বাংলাদেশ থেকে ঢুকছে ইলিশ বোঝাই ট্রাক। এমন পরমাস্বাদনীয় বস্তুটির কথা ভাবতেও ভাল লাগে, কী বলুন। তো, খিচুড়ির সঙ্গে ইলিশমাছ ভাজা দিয়ে, অফিস ডুব মেরে, রেনি ডে এনজয় করতে ভালবাসেন না, এমন বাঙালি প্রজাতি বিরল। আমি আমার এক বন্ধুকে জানি যে তার বসের বাড়িতে ইলিশমাছ পাঠিয়ে রেনি ডে-র জন্য অ্যাপ্লাই করে ফি বছর। ছুটি মঞ্জুর না করে ওপরওয়ালা আর যায় কোথায়?
অবশ্য শুধু ইলিশের কথা বললে অন্য ভাজাগুলোর প্রতি অন্যায় করা হবে। সামান্য ডিমভাজাও যে খিচুড়ির সঙ্গে এত ভাল যায়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর পাঁপড়, যাকে কি না খিচুড়ির অর্ধাঙ্গিনীই প্রায় বলা যায়! এমন লংলাস্টিং মানিকজোড়, সুখাদ্যের ইতিহাসে পাকা জায়গা নিয়ে বসে আছে বছরের পর বছর ধরে। পাঁপড় আবার ভাজা ও স্যাঁকা, দু’য়েতেই সমান উপভোগ্য। এ ছাড়া, বেগুন, পটল, আলু ইত্যাদি-প্রভৃতির ভাজা তো আছেই।
আর একটা জিনিসের কথা না বললেই নয়। খিচুড়ির সঙ্গে যেটা মাস্ট। সেটা হল গিয়ে ঘি, গাওয়া হলে তো কথাই নেই। ওই জিনিসটি ছাড়া, বস, আর যাই হোক খিচুড়ি হয় না। গরম-গরম খিচুড়িতে দু’-চামচ গব্য ঘৃত, আহহহা! এমন স্বাদ জন্ম-জন্মান্তরেও ভুলিব না।
শেষপাতে, আমার গুরুস্থানীয় খিচুড়ি-শেফ জগাদার কথায় ফিরে আসি। শুনছি, সে না কি আজকাল লন্ডনের বাঙালিপাড়ায় একটা নতুন দোকান করেছে। সাহেব-সুবোরা না কি লাইন দিয়ে সেই রেস্তোরাঁয় ভিড় জমাচ্ছে। দোকানের মাথায় জ্বলজ্বল করছে মস্ত নিয়ন সাইন: জগা’স খিচুড়ি, হোয়্যার এভরি ডে ইজ রেনি ডে!

ছবি: শুভেন্দু চাকী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.