ব্যাগ গুছিয়ে... খোলা চিঠি, কালিখোলার
বাংলা-ভুটানের মাঝ বরাবর ভীমাকার এক নদী রেকোয়া। শীতের নদী শুকনো পাথর। ও পিঠে মেঘলা পাহাড় সারবদ্ধ। আমাদের গাড়ি এসে রুখল নদীর মাঝে। কুমারগ্রাম থেকে চা বাগান আর জঙ্গল ফেলে এসে বিভাজক নদীটির ও পারে ভুটানের কালিখোলা আমাদের গন্তব্য। গাড়ি থেকে নেমে সঙ্গী ছবি-যন্ত্রে ভরে নিচ্ছে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে জমে থাকা মেঘের আঁশ। জলদভারে ঢাকা শৈলশিখরের ছবি। ইতিমধ্যেই চালক দেখিয়েছে একজোড়া চিবে পাখি।
প্রায় দেড় ফুটের ভুষো কালো পাখির লেজের প্রান্তভাগে হকিস্টিকের মতোই বাঁকানো দুই স্টিক। লেন্সে জমা পড়ে সেই ভীমরাজও। ডুয়ার্সের গভীর বনেই নাকি ওদের বাস। নদী পেরিয়ে এ দিকে জঙ্গলের বহরও বড় কম নয়। তারই শুঁড়িপথে আচমকা এক গ্রাম গেল শিবসুনি। কিছুটা এগোতেই পেলাম ‘ওয়েলকাম টু ভুটান’ দরওয়াজা। চালকের নির্দেশে ইতিমধ্যেই ক্যামেরাগুলো লুকিয়ে ফেলেছি। বাইরে গাড়ি থামিয়ে চালকটি গেল ভুটানের সীমান্ত দফতরে অনুমতি আদায়ে। কিছু কথাবার্তার পরে সে ফিরে এল এক প্রহরী-সহ। প্রহরীর মামুলি নজর-তল্লাশিতেই ছাড়পত্র পেয়ে গেলাম।
কালিখোলায় ঢুকেই নজরে পড়ল দু’পাশে জঙ্গল, সামনে চড়াই, বাঁ দিকে পাহাড়ের পিঠে ঝুলে থাকা এক কিন্ডারগার্টেন স্কুলের আপেল-রাঙা শিশুরা মেরুন ‘বুক্ষু’ পরে পাহাড়ের পাদদেশে সবুজ লনে খেলে বেড়াচ্ছে। পাহাড়ের গর্ভে অবাক করা এমন শিশু পাঠশালা! গাড়ি এসে ঢুকেছে কালিখোলার ভুটানি পাড়ায়। পাড়া বলতে দু’পাশে জীর্ণ তক্তা-বাড়ি। মানুষগুলি বাড়ির সামনে মন্থর ভঙ্গিতে বসে গৃহস্থালির গল্প করেন আর ছোট ছোট চুমুকে পান করেন ‘আয়রক’ (তরল নেশা)। দাদু নাতি বাবা জ্যাঠা সকলে মিলেই এই সঙ্ঘ-পান! এ দিকে ট্যুরিস্টের যাওয়া-আসা নিতান্তই কম। ফলে বাইরের মানুষে ওঁদের যথেষ্ট কৌতূহল। চারিদিকে জঙ্গল যেমন চলছে, তেমনই পাহাড়ের আড়ম্বরও কিছু কম নয়! পাড়াটি নিতান্তই ছোট। পাড়ার শেষ প্রান্তে এসে দেখি, অনেক নীচে শুয়ে আছে একটি নদী। তাকে জড়িয়ে আছে জংলা পাহাড়। সে যেন ঘন নীল উড়ানি একখানি, অকস্মাৎ উড়ে এসে পড়েছে পাহাড়ের ফাঁদে।
ওই সঙ্কোস! নদীকে দূর থেকে দেখা আর ছুঁয়ে থাকায় ফারাক বিস্তর। তাই গাড়ি থেকে নেমে সরাসরি পৌঁছে যাই সঙ্কোসের জলে। ডুবোপাথরে বসেছি স্ফটিক-নীলে পা ডুবিয়ে। নীচে গর্দি, ঠের, বোরোলি মাছের চারা-রা কুচো রাংতার মতো পাখনা কাঁপিয়ে খেলে বেড়ায়। নীল সঙ্কোস বাঁকে বাঁকে বহু দূর ইস্তক ছড়িয়ে আছে। পায়ের নীচে স্থির নদী, মাথার উপরে একমুঠো ভুটানি পাড়া। আর পাশে পিছনে ‘ধোঁয়াধার’ পাহাড় জঙ্গল নৈঃশব্দ্যে ডুবে আছে। সূর্যটা যেন রক্ত ঢেলে দিয়েছে এই ইন্ডিগো ফিল্ডে আর বর্ণময় এক ছবির গ্যালারি খুলে গেল চোখের সামনে। মনের লুকোনো ক্যামেরায় ‘শাটার’ পড়ে অবিরাম। মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল জুরেলি পাখি রাতের আশ্রয়ে। ছপছপ ডানা ঝাপটে উড়ে গেল ধনেশ দম্পতি। আলো কমে আসছে। আমরাও উঠে এসেছি উপরে।
খোঁজ করে একটা চা-দোকান পাওয়া গেল। সামনে দোকানদারি, পিছনে গৃহস্থালি। দোকানটি চলে তিন বোনের তদারকিতে। তিন পাহাড়ি কন্যাই যেন দেব-প্রতিমা। বয়সও এমন কিছু নয়। আমরা ঢুকতেই যথাযথ আপ্যায়ন হল। বড় জন বলে, কী খাবে? গরম, নরম না চরম? অতশত বুঝি না, আমাদের চা চাই। আমাদের কিন্তু বাটার টি, নোনতা। চলবে তো? মেজটি বলে। সঙ্গে ট্রাউট ফ্রাই দিই? কবেকার মাছ? ছোট বোনটি বেশ দুষ্টু-মিষ্টি। সে মজার ভঙ্গি করে বলে, ওই সঙ্কোস থেকে ট্রাউট ধরা হল, কাটা হল, ফ্রাই হল, মশায়ের টেবিলে পড়ল। আমরা উপভোগ করি ওর বাচালতা। বলিবেশ তো, ফ্রাই-চা। দুজন ঢুকল রসুইঘরে। ছটফটে ছোটটি আমাদের সঙ্গে গল্পে বসে গেল। সে বলে, এ দেশটা তো দেখছ উঁচু-নিচু পাহাড়ি। আমরা বলিআমাদের বাংলা কিন্তু এমনটা নয়, বেশিটাই সমতল। সেখানে অফুরান ধান, গেঁহু, ফল, আনাজ। এই সময় ঘরে ফসল উঠছে। মেয়েটির চোখ যেন চকচক করে। সে বলে, তোমাদের কুমারগ্রাম, নিউল্যান্ডস দেখেছি। সবই তো জঙ্গল আর চা-বাগান। বলিআমাদের মুলুকের নানা স্থানে নানা গড়ন, নানা ধরন। তোমাদের জংলা পাহাড়ে জীবিকার উপায় কী? মেয়েটির রেডিমেড উত্তর, গাই পালন হয়। তার দুধ, পনির, ঘি, ছুরপি তোমাদের দেশেও বিক্রি হয়। শীতে পাহাড়ে যাই কমলা ছিঁড়তে। কমলার মরসুম শেষ হয়ে এল। এ পাড়ায় আমরা সবাই প্লাকার। যত উঁচু পাহাড়ে লেবুবাগান, তার প্লাকিং-এ তত বেশি আমদানি। সে বলে, আমাদের জীবনে খরচ তো তেমন নেই। এই ধরো মাড়ুয়ার ভাত, থুপ্পা, ঘরে ঘরে মাড়ুয়া পিষে ‘আয়রক’ মদ হল। কাওন দানা পেষাই করে হল ‘ঢেঁড়ো’। তার রুটির সঙ্গে ‘সিমল তরুল’ (বন-আলু) সিদ্ধ করে নিলাম। ঘরে সাজানো রঙিন বোতলে মদ। কমলা, হলুদাভ, গভীর লাল। কোনওটা অরেঞ্জ ফ্রেশ, কোনওটা ব্লু ড্রিম কিংবা সুইট হার্ট। এখানে একটাই হাট শনিবার। বাংলার দোকানি পণ্য এনে তাতে হাট বসান। দোকান-বাজারের ব্যবস্থা ওইটুকুই। দিন কাটে গৃহকর্মে। পশুপালন আর দারুপানে নিশিযাপন।
কথায় গল্পে চা-ফ্রাই শেষ। এ বারে ওঠার পালা। পাহাড়-জঙ্গলের টং-ঘরে বসত করা কয়েকটি ভুটানি কন্যা কত সহজেই পরকে আপন করে নেয়। গাড়িতে ওঠার আগে নদীকে দেখেছিব্লু টোন মুছে গিয়ে কালোয় ঢেকেছে। পাহাড়গুলি দুধ-কুয়াশার অ্যাপ্রনে অদৃশ্য! শুধু মাথার উপরে পিতলের চাঁদ এসে হাজির। তার বিভায় তিন পাহাড়ি কন্যার মুখে বিদায়-বিষণ্ণতা। এ ফেরায় থাকে আর এক ফিরে আসার ডাক। অস্ফুট কলিটির চোখেও দেখি সেই প্রত্যয় স্পষ্ট‘জানি, তুমি ফিরে আসবে আবার। জানি। জা...নি...।’

কী ভাবে যাবেন
শিয়ালদহ থেকে তিস্তা-তোর্সায় নিউ আলিপুরদুয়ারে নেমে গাড়িতে
কুমারগ্রাম। ওখান থেকে গাড়ি নিয়ে যাওয়া কালিখোলা।
কোথায় থাকবেন
কুমারগ্রামে বন দফতরের বাংলো আছে। ফোন নম্বর ০৩৫৬৪-২৫৬০০৫
প্রয়োজনীয় তথ্য
সচিত্র পরিচয়পত্র এবং জিওলিন সঙ্গে থাকবে।

ছবি: রঞ্জন মুখোপাধ্যায়




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.