|
|
|
|
|
|
|
আপনার সাহায্যে... |
|
যৌবন ধরে রাখার মূল্য...
হরমোন থেরাপি সত্যিই কি খুব বিপজ্জনক?
ডা. গৌতম খাস্তগীরের সঙ্গে কথা বললেন রুমি গঙ্গোপাধ্যায় |
|
|
জরায়ু বাদ যাওয়ার পর হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি শুরু হয়েছিল অপরাজিতার। হরমোনের ওষুধ শুনে অনেকেই ক্যানসারের ভয় দেখাল। ওষুধ বন্ধ করে দিলেন অপরাজিতা। আর ছয় মাসের মধ্যেই তিনি ঘটাতে লাগলেন নানা আজব ঘটনা। কখনও দশ কিলো আম কিনছেন অথবা শাড়ির দোকানে একসঙ্গে অনেক বেনারসি অর্ডার দিচ্ছেন। মনোবিদের দ্বারস্থ হলে তিনি আবার হরমোন চিকিৎসার পরামর্শ দিলেন। কয়েক মাসের মধ্যেই স্বাভাবিক অপরাজিতা।
মেনোপজ। মেয়েদের জীবনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মেনোপজের পর একেক জনের শরীর এক এক রকম ভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়। হাসিখুশি মানুষটি হঠাৎই হয়ে যান খিটখিটে, মেজাজি। অথবা হতে পারে হট ফ্লাশ, প্রস্রাবের সংক্রমণ, অনিদ্রা, বা অস্টিয়োপোরেসিসের মতো রকমারি সমস্যা। যার মোকাবিলা করা হয় হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপিতে। কিন্তু এখানেই মুশকিল।
প্রচলিত ধারণা, হরমোন মানেই হাজারো সমস্যা। ওজন বাড়া, দাঁড়ি-গোঁফ গজানো, মেচেতা থেকে শুরু করে হতে পারে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, বা ক্যানসার। সত্তর দশকের আমেরিকার কথাই ধরুন। শোনা গিয়েছিল মেয়েদের জন্য এসে গিয়েছে ম্যাজিক ওষুধ, ইস্ট্রোজেন। যা কিনা আজীবন যৌবন ধরে রাখবে। শুরু হল মুঠো মুঠো ইস্ট্রোজেন খাওয়া। বছর দশেকের মধ্যেই হাতেনাতে ফল। ক্লিনিকগুলো ভরে গেল ক্যানসারের রোগীতে! তাই হরমোন থেরাপির কথা শুনলে অনেকেই আঁতকে ওঠেন। তবে কি জেনেশুনে বিষ খাচ্ছি?
ডা গৌতম খাস্তগীর জানালেন, “এ ধরনের সমস্যা যে হয় না, তা নয়। কিন্তু এর মধ্যে রয়েছে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি।” কী রকম? “কাকে, কী মাত্রায়, কত দিন ধরে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে এ সবের ওপর নির্ভর করে হরমোন ব্যবহারের ভালমন্দ। শুরুতে কড়া ডোজে ইস্ট্রোজেন দেওয়া হত। প্রোজেস্টেরন দেওয়া হত না। ইস্ট্রোজেন জরায়ুর দেওয়ালটা মোটা করে। প্রোজেস্টেরন মোটা দেওয়ালকে খসিয়ে দেয়। প্রোজেস্টেরন না দেওয়ায় ক্রমশ মোটা হতে হতে জরায়ুতে ক্যানসার হত। পরবর্তীতে ব্যাপারটা ধরা পড়ল। তত দিনে মানুষ জেনে গিয়েছেন, হরমোনের ওষুধ মানেই ক্যানসার।’’ সেই ভীতি আজও চলছে। অথচ নানা সমস্যায় চিকিৎসকদের হরমোন চিকিৎসাকেই ভরসা করতে হয়। |
|
হরমোন চিকিৎসা আসলে কী
মেনোপজের পরের সমস্যায় দেওয়া হয় কম মাত্রায় ন্যাচারাল ইস্ট্রোজেন বা প্রোজেস্টেরন হরমোন বা দুটোই। এটাই হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি (এইচআরটি)। আবার কমবয়সিদের পিরিয়ড সংক্রান্ত নানা সমস্যায় দেওয়া হয় ওরাল কন্ট্রাসেপটিভ পিল (ওসিপি)। অভিজ্ঞতা থেকে ডা খাস্তগীর জানাচ্ছেন, “একে হরমোন তার ওপর কন্ট্রাসেপটিভ পিল শুনে অনেক অভিভাবকই ভয় পেয়ে যান। অথচ পিলের মধ্যের ওষুধ, পিরিয়ডের নানা সমস্যায় দারুণ কার্যকরী। পিল ও এইচআরটি হরমোন ওষুধ হলেও দুটোর কাজ ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আলাদা। দুটোকে এক ভেবে নিলেই ভুল।”
কী রকম
জরায়ু আছে এ রকম কাউকে এইচআরটি হিসেবে শুধু ইস্ট্রোজেন দিলে জরায়ুর ক্যানসার হতে পারে। কিন্তু ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন মিশিয়ে দেওয়া হলে জরায়ুর ক্যানসারের সম্ভাবনা উল্টে কমে যায়। অথচ এটা না বুঝে অনেকেই ধরে নেন এইচআরটি থেকে জরায়ুর ক্যানসার হয়। সেই কালি ওসিপি’র গায়েও লাগে। বাস্তবে নিয়মিত এক বছর ওসিপি নিলে জরায়ুর ক্যানসারের সম্ভাবনা উল্টে কমে। তাই হরমোনাল ট্রিটমেন্টকে এক কথায় ভাল বা মন্দ বলে দেগে দেওয়া যায় না।
কিন্তু ওসিপি...
ওসিপি নিয়মিত খেলে ওজন বাড়ে। মুখে অবাঞ্ছিত লোম বা মেচেতা হয়। ডিপ্রেশনও। এগুলি যে কম-বেশি কারও কারও হয় তা মেনে নিয়েও ডা. খাস্তগীরের পাল্টা যুক্তি “পিল ব্যবহার না করে অবাঞ্ছিত প্রেগন্যান্সি আসায় গর্ভপাত করালে ক্ষতি অনেক বেশি। তা ছাড়া এখন ওসিপি দেওয়া হয় কম মাত্রায়। তাতে সমস্যাও কম। আর সমস্যা হলে, ওষুধ বদলে দেওয়া হয়। অথচ ওসিপি বা এইচআরটি থেকে সমস্যা হবে, এটা অনেকটা গুজবের মতো ছড়িয়ে পড়েছে।”
এ প্রসঙ্গে তিনি একটি ঘটনাও শোনালেন। সদ্য বিবাহিত এক মহিলা এসেছিলেন কন্ট্রাসেপশনের পরামর্শ নিতে। ওসিপি দিলে ভয় পেয়ে তিনি আর সেটি খেলেন না। বদলে সহবাসের পর আই-পিল খেয়ে ফেলতেন। এক বার আই-পিল কাজ না করায় গর্ভপাতও করাতে হয়। পরে যখন তিনি মা হতে চাইলেন, দেখা গেল বন্ধ্যত্বে ভুগছেন।
হরমোন ও ভুল বোঝাবুঝি
চিকিৎসা করিয়েও বছর পঞ্চাশের এক মহিলার দীর্ঘ দিনের প্রস্রাবের সংক্রমণ কমছিল না। পরে তাঁকে এইচআরটি’র চিকিৎসা শুরু করলে অনেকটা ভাল হয়ে যান। কিন্তু অনেকের কাছ থেকে এইচআরটি’র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা শুনে তিনি তা বন্ধ করে দেন। এ দিকে বার বার প্রস্রাবের সংক্রমণ হতে থাকায় এক সময় তাঁর কিডনি ফেলিওর হয়ে যায়। খাস্তগীর বললেন, “পুরো না জেনে কয়েকটা ঘটনা দিয়ে এই চিকিৎসার ভালমন্দ বিচার করা যায় না।”
২০০৬-এ ওমেন হেল্থ ইনিসিয়েটিভ নামের গবেষণাপত্র বেরোনোর পর বিদেশে প্রচুর মহিলা এইচআরটি বন্ধ করে দেন। তাতে বলা হয়েছিল ষাটের ঊর্ধ্বে এইচআরটি’তে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বাড়ে। এটা যেমন ঠিক, তেমনই ৫০-৬০’এর মধ্যে এইচআরটি নিলে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা কমে। কোলেস্টেরল আর উচ্চ রক্তচাপ কমে। ১৯৯০-এ করা নার্সেস হেল্থ স্টাডি’তে এটি প্রমাণিত। অথচ পুরোটা না জেনে অনেকেই ধরে নেন এইচআরটি মানেই হার্ট অ্যাটাক! আবার টিনএজ থেকে দীর্ঘ দিন ওসিপি খেয়ে গেলে ব্রেস্ট ক্যানসারের সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু এটা অনেকে জানেন না, ওসিপি ও এইচআরটি কোলোরেক্টাল ক্যানসারের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। এইচআরটি বয়স্কদের অ্যালজাইমার্স কমিয়ে দেয়। কিন্তু যদি বেশি বয়সে শুরু করা হয় তবে উল্টো ঘটনা ঘটবে। তাই কী সমস্যায় কী ওষুধ, তা একমাত্র বিশেষজ্ঞরাই বলতে পারেন। হরমোন বা ওসিপি’র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়াতে এখন ভ্যাজাইনাল ক্রিম দেওয়া হয়। ওষুধ লিভারের মাধ্যমে যায়। কিন্তু ক্রিম ত্বকের মাধ্যমে রক্তে মিশে যাওয়ায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেকটাই এড়ানো যায় বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের।
হরমোন কখন ভিলেন
ছেলে থেকে মেয়ে হতে চাইলে অন্তত ১০-২০ গুণ বেশি ওষুধ দেওয়া হয়। তাতে শরীরের বিপাকীয় কাজের গোলমাল হয়ে নানা জটিলতা হতে পারে। সাধারণ হরমোন ট্রিটমেন্টের সঙ্গে এর কোনও তুলনাই চলে না। তাই দুটোকে এক করে দেখা একেবারেই ভুল।
যোগাযোগ-৯৮৩০৬৬৬৬০৬
|
হরমোনের ভাল ও মন্দ |
• ব্লাড প্রেসার: ওসিপির ব্লাডপ্রেসারের ওপর কোনও ভূমিকা নেই। কিন্তু উচ্চ রক্তচাপ থাকলে ৩৫ বছরের পর পিল ক্ষতি করে। আবার এইচআরটি খুব কম হলেও প্রেসার কমায়। |
• হার্ট অ্যাটাক: ওসিপিতে হার্ট অ্যাটাক হয় না। কিন্তু ৩৫-এর ঊর্দ্ধে ধূমপানের নেশা থাকলে ওসিপি হার্ট অ্যাটাকের সংখ্যা পাঁচগুণ বাড়ায়। আবার সদ্য মেনোপজ হয়েছে এমন কাউকে এইচআরটি দিলে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা কমে যায়। কিন্তু ৬০-এর ঊর্দ্ধে হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকলে নতুন করে দেওয়া যায় না। |
• ডায়াবেটিস: ৩৫ বছরের কম বয়সে ওসিপি নিলে ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস থেকে তৈরি জটিলতার সম্ভাবনা কমবে। ৩৫ পর উল্টো ঘটনা হতে পারে। এইচআরটি ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে ক্ষতি তো করেই না, বরং উপকার করে। কোলেস্টেরল কমায়। কিন্তু ডায়াবেটিক রোগীর হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকলে নতুন করে এইচআরটি দিলে সমস্যা বাড়বে। |
• স্ট্রোক ধূমপায়ী না হলে ৩৫-এর কম বয়সিদের ওসিপিতে সমস্যা নেই। ৪০-এর পর ওসিপি নিলে স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়ে। |
• ব্রেস্ট ক্যানসার ব্রেস্টে ব্যথা, ছোট সিস্ট ইত্যাদি কমে যায় ওসিপিতে। প্রথম প্রেগন্যান্সির আগে এই উপকার মিলবে। কিন্তু কম বয়সে পিল শুরু করলে, ব্রেস্ট ক্যানসারের সম্ভাবনা ২০% বেড়ে যায়। তবে এই ক্যানসার তাড়াতাড়ি ছড়ায় না। আবার ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন একসঙ্গে দিলে ব্রেস্ট ক্যানসারের সম্ভাবনা সামান্য বাড়ে। |
|
শখ করে কেউ এই ট্রিটমেন্ট করতে আসেন না
বললেন ডা. মণীশ মুকুল ঘোষ |
অন্য অপারেশনের মতো যে কোনও ধরনের প্লাস্টিক সার্জারিতে নানা জটিলতা হতে পারে। অপারেশনের পর উল্টে সমস্যা হয়েছে, এ রকম ঘটনা অনেক আছে। সেগুলোর মোকাবিলা সময়ের ব্যাপার এবং খরচেরও। তাই ছোটখাটো শারীরিক ত্রুটি মেরামত থেকে শুরু করে যে কোনও অপারেশনের জন্য যখন কেউ আসেন, এর ক্ষতিকর দিকগুলি সম্বন্ধে বার বার বোঝাই।
যেমন পরিবর্তনকামী মানুষদের শরীরে পরিবর্তন আনতে দীর্ঘ দিন ওষুধ খেতে হয়। ধীরে ধীরে শরীরে পরিবর্তন হতে শুরু করলে তখন কিন্তু পিছিয়ে আসা যাবে না। ওষুধ বন্ধ করে দিলেও আগের অবস্থা ফিরতে সময় লাগবে। এঁরা সামাজিক বা পারিবারিক দিক দিয়েও চাপে থাকেন। অনেকের কাছেই এঁরা পরিহাসের পাত্র। কাছের মানুষের কাছেও এটা বড় ধাক্কা। এত সব জানার পরও কেউ কেউ এই পথ নিয়ে থাকেন।
এঁদের বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসেন। অপারেশন ও ওষুধের বিপুল খরচ। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, এঁরা কেউ শখ করে আসেন না। পুরোটাই মানসিক ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে তাঁদের সঙ্গীর সহযোগিতা খুব জরুরি। তিনি কী ভাবে পুরো ব্যাপারটা দেখছেন তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে।
অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, অনেক পরিবর্তনকামী মানুষই ক্রস ড্রেস করেই খুশি। মানে ছেলেরা মেয়েদের মতো পোশাক আর সাজগোজ করলেই সন্তুষ্ট। মেয়েদের ক্ষেত্রে উল্টো ব্যাপার। তবে কেউ কেউ আরও বেশি কিছু চান। যেমন একটি মেয়ের সমস্যা ছিল, তিনি ছেলেদের মতো দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতে পারতেন না। হীনমন্যতায় ভুগতেন। অপারেশন করে সে ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। তাই বলছি, ওষুধ বা অপারেশনের ক্ষতিকর দিকগুলি জেনেও কেউ কেউ সামনের দিকে এগোতে চান। আমরাও বাধ্য হই। কারণ এঁদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অন্তত ৪০% বেশি। |
সাক্ষাৎকার: রুমি গঙ্গোপাধ্যায় |
|
|
|
|
|
|