রাজ্যকে আলোয় ভাসিয়েও আঁধারে ডুবছে বিদ্যুৎ বণ্টন
প্রদীপের নীচে অন্ধকার! রাজ্যবাসীকে পর্যাপ্ত আলো জুগিয়েও লোকসানের চোরাবালিতে যেন তলিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা।
নতুন সরকারের শীর্ষ কর্তারা দাবি করছেন, রাজ্যের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি অনেক ভাল। অর্থাৎ, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের দিন ফুরিয়েছে। বাস্তবও তা-ই বলছে। কিন্তু এর কারণ যাচাই করতে গেলে যে ছবিটা বেরিয়ে আসছে, সেটা বিশেষ আশাপ্রদ নয়। দেখা যাচ্ছে, গত ক’বছরে রাজ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন যে হারে বেড়েছে, সে হারে শিল্পায়ন হয়নি। বাড়তি বিদ্যুৎ কেনার মতো নতুন বড়-মাঝারি শিল্প সে ভাবে গড়ে ওঠেনি। সোজা কথায়, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ তৈরি করেও বেচার মতো খদ্দের মিলছে না, অনেকটা উদ্বৃত্ত থেকে যাচ্ছে। তাতেই গ্রাম-শহরে লোডশেডিংয়ের দাপট কমছে।
নাগরিকেরা স্বস্তি পেয়েছেন ঠিকই। তবে এতে বণ্টন সংস্থার আর্থিক মেরুদণ্ড নুইয়ে গেছে বলে মনে করছেন সরকারি কর্তাদের একাংশ। তাঁদের যুক্তি: উদ্বৃত্ত উৎপাদনের শিল্প-ক্রেতা না-মেলায় এমনিতেই আয়ে টান পড়ছে। তার উপরে উদ্বৃত্তের বহরে লাগাম দিতে গিয়ে অনেক সময়ে উৎপাদনক্ষম একাধিক ইউনিট বসিয়ে রাখতে হচ্ছে, যাতে ইউনিটপিছু উৎপাদন খরচ চড়ছে। পাওনা টাকাও ঠিকঠাক আদায় হচ্ছে না। আবার উপযুক্ত পরিকাঠামো ছাড়া যথেচ্ছ লাইন দেওয়ায় সংবহনজনিত ক্ষতি বাড়তে-বাড়তে এখন হাতের বাইরে চলে গিয়েছে। সঙ্গে বিদ্যুৎ চুরি বাবদ বিপুল ক্ষতির বোঝা তো আছেই।
সব মিলিয়ে বণ্টন সংস্থার আর্থিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে। খাতায়-কলমে কোম্পানি অবশ্য গত অর্থবর্ষেও ‘মুনাফা’ করেছে। তবে সে টাকা এখনও বাজারে পড়ে আছে, সংস্থার কোষাগারে আসেনি। যেমন সংস্থা-সূত্রের খবর, বিদুৎ-বিল বাবদ শুধু রাজ্য সরকারের নানা দফতরের কাছে বণ্টনের পাওনা প্রায় ছ’শো কোটি টাকা। বিভিন্ন জায়গায় এমন বহু টাকা অনাদায়ী হয়ে রয়েছে, যাকে সঙ্কটের অন্যতম কারণ হিসেবে ধরছেন সংস্থার কর্তারা। বিদ্যুৎ দফতর-সূত্রের ইঙ্গিত, চলতি অর্থবর্ষে সংস্থার রাজস্ব ঘাটতি আড়াই হাজার কোটি টাকা ছুঁতে পারে, যা কি না গত বারের দ্বিগুণ। দফতরের তথ্য বলছে, গোটা রাজ্যে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে (সংবহণ ও বাণিজ্যিক) গড় লোকসান অন্তত ৩০%। শ’খানেক গ্রাহক পরিষেবাকেন্দ্রে হারটা ৬০% ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ, সেখানে ১০০ টাকার বিদ্যুৎ বেচে আসছে সাকুল্যে ৪০ টাকা। বিদ্যুৎ-কর্তাদের মতে, অবনতির সূচনা বছর দুয়েক আগেই। এখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
ছয় দাওয়াই
• জরুরি ভিত্তিতে ক্ষতির বহরে লাগাম
• সময়ে বিল তৈরি ও আদায়ে জোর
• বকেয়া বিল শীঘ্র আদায়ের চেষ্টা
• তবু বকেয়া থাকলে লাইন কাটা
• রাজস্বে ঘাটতি হ্রাসে নয়া পথ সন্ধান
• পরিকাঠামোর খুঁটিনাটি ঢেলে সাজা
এবং শিল্প-গ্রাহকের অভাবের ব্যাপারটা বাদ দিলে এ জন্য তাঁরা আঙুল তুলেছেন মূলত তিনটি কারণের দিকে। কী কী? প্রথমত, অপরিকল্পিত সংযোগ ও জীর্ণ পরিকাঠামো। এতেই বণ্টন সংস্থার সংবহনজনিত ক্ষতি (ট্রান্সমিশন লস) হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। “ছোট ছোট সাবস্টেশন, ফিডার লাইন না-করেই লম্বা লাইন টানা হচ্ছে। এতে প্রতিনিয়ত ওভারলোডের ফাঁদে পড়ে ক্ষতির বহর বাড়ছে।” মন্তব্য এক কর্তার। দ্বিতীয়ত তাঁরা দায়ী করছেন বিল-পদ্ধতির ত্রুটি-বিচ্যুতিকে। গত দেড় বছরে রাজ্য জুড়ে গৃহস্থ গ্রাহকের সংখ্যা কয়েক লক্ষ বাড়লেও বহু এলাকায় নিয়মিত মিটার রিডিং নেওয়া হচ্ছে না। কর্তারাই জানাচ্ছেন, বহু বাড়িতে স্রেফ গড় বিল পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারও টাকা সময়ে আদায় হচ্ছে না। তাই বাণিজ্যিক ক্ষতি (কমার্সিয়াল লস) বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। তৃতীয়ত, বেপরোয়া বিদ্যুৎ-চুরির চাপ। ২০১১-র ডিসেম্বরে মগরাহাটে হুকিং কাটতে গিয়ে বিদ্যুৎ-কর্মীরা জনবিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন। পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশ গুলি চালায়। তার পরে সরকারের মনোভাব বুঝে গোটা রাজ্যে চুরি বন্ধের অভিযান প্রায় থমকে গিয়েছে।
এই ত্র্যহস্পর্শে আয়-ব্যয়ের ব্যবধান এখন আকাশচুম্বী। এক বিদ্যুৎ-কর্তা জানাচ্ছেন, বছর চারেক আগেও বিভিন্ন ব্যাঙ্কে বণ্টন সংস্থার ১২০০ কোটি টাকার ফিক্সড ডিপজিট ছিল। ঘাটতির চাপে তার অনেকটা খরচ হয়ে গিয়েছে। বিপুল রাজস্ব ঘাটতির সম্ভাবনা নিয়ে সম্প্রতি সংস্থার পরিচালন পর্ষদের বৈঠকেও আলোচনা হয়। কর্তাদের হিসেবে, চলতি অর্থবর্ষে ১০০ টাকা আয় হলে ব্যয় করতে হবে ১১৬ টাকার কাছাকাছি। সুরাহার উপায় কী?
বণ্টন সংস্থার চেয়ারম্যান রাজেশ পাণ্ডে বলেন, “রাজস্ব আদায়ে কিছু অসুবিধে হয়েছে। তা মেটাতে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আশা করছি, সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারব।” পরিচালন পর্ষদ-সূত্রের খবর, আয়-ব্যয়ের ব্যবধান কমাতে ছ’দফা কর্মসূচি স্থির করা হয়েছে (চার্ট দেখুন)। তবে আপাতত পরিস্থিতি সামাল দিতে বাজার থেকে আরও বেশি ঋণ তোলা হবে। সংস্থার বার্ষিক ঋণ গ্রহণের সীমা সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে পাঁচ হাজার কোটি। কিন্তু সমস্যা সেখানেও। কী রকম?
বিদ্যুৎ দফতরের খবর: বণ্টন সংস্থার আয় ব্যাপক কমে যাওয়ায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি এখন ঋণ দিতে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে বণ্টন কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ব্যাঙ্কের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ইউবিআই-কে মাথায় রেখে কয়েকটি ব্যাঙ্ককে নিয়ে গড়া হয়েছে কনসর্টিয়াম, যেখান থেকে ঋণ মিললেও মিলতে পারে। পাশাপাশি কার্যকরী মূলধন (ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল) জোগাড় করতে এসবিআই ক্যাপিটাল মার্কেট’কে নিয়োগ করা হয়েছে।
রাজ্যের বিদ্যুৎ-কর্তাদের অবশ্য দাবি, রাজস্ব ঘাটতির দরুণ ঋণ পাওয়ার সমস্যা শুধু পশ্চিমবঙ্গের নয়। তাঁদের বক্তব্য: রক্ষণাবেক্ষণ-নজরদারির অভাব এবং সস্তায় বিদ্যুৎ দিতে গিয়ে বিভিন্ন রাজ্যের বণ্টন সংস্থার ঘাড়ে এই মুহূর্তে সব মিলিয়ে অন্তত দু’লক্ষ কোটি টাকা ঋণের বোঝা। তাদের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা এই মুহূর্তে কিছুটা ভাল হলেও রাজস্ব ঘাটতির বাড়বৃদ্ধির প্রবণতায় এখনই রাশ টানা জরুরি বলে মনে করছেন সরকারি কর্তারা।
সে জন্য ভরসা ওই ছ’দফা। তাতে কাজ হবে কি না, সময়ই বলবে।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.