চার্জশিট দেখে সিআইডিকে ধমক বিচারকের
ঞ্চায়েত ভোটের পরে কামদুনি-কাণ্ড। সুপ্রিম কোর্টের পরে বারাসত আদালত। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আরও এক বার কোর্টে জোর ধাক্কা খেল রাজ্য সরকার। এ দিনই কামদুনি কাণ্ডে সিআইডি-র চার্জশিট নিয়ে বারাসত আদালতে শুনানি শুরু হয়। সেই শুনানি চলাকালীন চার্জশিটে একাধিক অসঙ্গতির কথা তুলে বিচারক অর্পণ চট্টোপাধ্যায় প্রশ্ন করেন, তা হলে কি সিবিআই তদন্তের জন্য এই মামলা হাইকোর্টে পাঠিয়ে দেব?
এখানেই থেমে থাকেননি বারাসত ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের বিচারক। রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ সিআইডি-কে সরাসরি ভর্ৎসনা করে তিনি জানতে চান, চার্জশিট তৈরির সময়ে সাধারণ নিয়ম ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা মানা হয়েছে কি? কামদুনি-কাণ্ডে ঠিকমতো তদন্ত হয়েছে কি না, তোলেন সেই প্রশ্নও। বস্তুত, এই প্রশ্ন এ দিন এজলাসে হাজির কামদুনির বাসিন্দাদের অনেকের মনেই উঠেছে। আবার আইনজীবীদের বড় অংশও প্রশ্ন তুলেছেন: এই চার্জশিটের পরে দোষীদের আদৌ শাস্তি হবে তো?
বিচারকের মন্তব্যের পরে বিশেষ সরকারি আইনজীবী সন্দী ভট্টাচার্য জানান, তাঁরা একটু সময় নিয়ে চার্জশিটটি ঠিক করে দেবেন। বিচারক চট্টোপাধ্যায় অবশ্য আজ, বৃহস্পতিবারেই চার্জশিট সংশোধন করে তা আদালতে পেশ করতে নির্দেশ দিয়েছেন সিআইডি-কে।
আইনজীবীরা বলছেন, অসঙ্গতিটা ধরা পড়েছে চার্জশিট এবং কেস ডায়েরির বিবরণে। এই দুই ক্ষেত্রে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তা পরস্পর-বিরোধী। কী রকম? ছাত্রীর ধর্ষণ ও খুনের পর তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো অভিযোগে চার জনের নাম ছিল। এবং গণধর্ষণের মামলা (ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৬এ এবং ডি ধারা) দায়ের হয়েছিল। চার্জশিটেও সইফুল-সহ ধৃতদের বিরুদ্ধে গণধর্ষণ ও খুনের মামলা দায়ের করা হয়েছে। অথচ ওই চার্জশিটের অন্তর্গত কেস ডায়েরিতে বলা হয়েছে, সইফুল একাই ধর্ষণ করে খুন করেছে। বাকিরা সেখানে ছিল না। পরে এসেছে। আইনজীবীদের বক্তব্য, প্রথমত, দু’টো বিষয় পরস্পর-বিরোধী। দ্বিতীয়ত, কেস ডায়েরিতে যা বলা হয়েছে, তার মানে হল, সইফুল ছাড়া অন্য কেউ ধর্ষণ এবং হত্যার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়। ফলে একে গণধর্ষণ বলা হবে কী ভাবে, তা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। এক আইনজীবী বললেন, “সইফুল ছাড়া বাকিরা সেখানে ছিল না। অথচ, তাদের বিরুদ্ধে গণধর্ষণের মামলা দেওয়া হয়েছে! কিন্তু বাকি অভিযুক্তদের ওই ধারায় শাস্তি দেওয়া যায় কি?”

আইনজীবীরা আরও প্রশ্ন তুলেছেন, সইফুল একাই ওই মেয়েটিকে ধর্ষণ করল, খুন করল এবং তার পরে দু’পা ধরে চিরে ফেলল? এটা বাস্তবে কতটা সম্ভব? আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ঘটনাটি ঠিক কী ঘটেছিল, তা চার্জশিট পড়ে পুরোপুরি বোঝা যাচ্ছে না।”
এই প্রসঙ্গে উঠেছে পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের প্রসঙ্গও। পার্ক স্ট্রিটের ক্ষেত্রে গণধর্ষণের মামলা হয়েছিল এবং সব ক’জনকেই এই অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। এখানে কিন্তু তা ঘটল না। অথচ এখানে অপরাধ শুধু গণধর্ষণ নয়, নৃশংস ভাবে খুনও।
আইনজীবীরা বলছেন, পরে প্রশ্ন উঠতেই পারে, যে সিআইডি এত সব গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্ত করে, তাদের দেওয়া চার্জশিটে এমন অসঙ্গতি?
ভবানী ভবনের অফিসারদের দাবি, চার্জশিট তৈরির হাতিয়ার বলতে ছিল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া সইফুলের গোপন জবানবন্দি (ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৬৪ ধারা)। অন্য তথ্যপ্রমাণ তো দূর, মেলেনি ফরেন্সিক পরীক্ষার রিপোর্টও। এই অবস্থায় কামদুনির মতো সংবেদনশীল মামলায় চার্জশিট দেওয়া ঠিক হবে না বলেই জানিয়েছিলেন তদন্তকারীরা। কারণ, ফরেন্সিক পরীক্ষার রিপোর্ট (রক্ত, বীর্য, আঘাত প্রভৃতির বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ফলাফল) ছাড়া ধর্ষণের মামলার চার্জশিট অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কিন্তু উপরমহল এই যুক্তি মানতে চায়নি। সিআইডি সূত্রের খবর, যেন-তেন প্রকারে দ্রুত চার্জশিট পেশের জন্য উপরতলা থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এর পরেই ঠিক হয়, ফরেন্সিক রিপোর্ট ছাড়াই চার্জশিট দেওয়া হবে। পরে ফরেন্সিক রিপোর্ট মিললে তা অতিরিক্ত চার্জশিট হিসেবে আদালতে পেশ করা হবে।
সিআইডি-র একাংশের দাবি, এই অসম্পূর্ণ চার্জশিট পেশের ফলেই বুধবার বারাসত আদালতে ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হয়েছে তদন্তকারী অফিসারকে। ভবানী ভবনের একাংশ বলছেন, শীর্ষকর্তারা চার্জশিট পেশের জন্য তাড়াহুড়ো না করলে এমন ধমক খেতে হতো না।
কেন এই তাড়াহুড়ো? কামদুনি কাণ্ডের পরে মুখ্যমন্ত্রী ওই গ্রামে গিয়ে আশ্বাস দেন, ঘটনার ১৫ দিনের মধ্যে চার্জশিট পেশ করা হবে। কিন্তু ফরেন্সিক রিপোর্ট না মেলায় সেই সময়সীমার মধ্যে চার্জশিট পেশ করতে পারেনি সিআইডি। এর পরেই বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কামদুনির বাসিন্দারা। প্রশাসন সূত্রের খবর, তার পরেই উপরমহল থেকে সিআইডি-র কাছে তড়িঘড়ি চার্জশিট পেশ করার নির্দেশ যায়। একই কথা শোনা গিয়েছে তদন্তকারী অফিসারদের মুখেও। এক গোয়েন্দা অফিসার বলেন, “উপরমহল থেকে নির্দেশ আসতেই আধ ঘণ্টা অন্তর এক-এক জন বড়কর্তার ফোন আসছে। কিছু পদস্থ কর্তা বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত থেকে গেলেন।”
কিন্তু চার্জশিট পেশ করার মতো তথ্যপ্রমাণ হাতে নেই। এক অফিসার জানান, সইফুল ছাড়া বাকি কেউ ঘটনার কথা স্বীকার করেনি। আমিন আলি ও নুর আলি নামে দুই অভিযুক্ত ঘটনাস্থলে ছিল না বলে দাবি করেছে। সিআইডির দাবি, আমিন ও নুরের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণও মেলেনি। সইফুল তো বটেই, আমিন-নুরের না থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছে আনসার নামে আর এক অভিযুক্ত। ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার প্রমাণ মেলেনি বলেই ওই দু’জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়নি, ব্যাখ্যা সিআইডি-র।
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় শুক্রবার দুপুরের মধ্যে সাড়ে সাতশো পাতার তদন্ত রিপোর্ট তৈরি হয়। তা খতিয়ে দেখেন বড়কর্তারা। কিছু অসঙ্গতি ধরা পড়ে। তখন কয়েক জন পোড়খাওয়া অফিসারকে ডাকা হয়। রাতভর কাজ করে সেই অসঙ্গতি দূর করেন তাঁরা। তার পরের দিন শনিবার সকালে সিআইডি-র প্রথম সারির কর্তারা ওই রিপোর্ট খতিয়ে দেখেন। তার পরে বিকেলে সেই তদন্ত রিপোর্ট ও চার্জশিট পেশ করা হয় বারাসত আদালতে।
তাও শেষ রক্ষা হল না। বারাসত আদালতের আইনজীবী রঞ্জিত সাহা বলেন, “ত্রুটিপূর্ণ চার্জশিটের জন্য মামলাটি লঘু হয়ে যাবে ও আসামিরা ছাড়া পেয়ে যেতে পারে। সেই কথাই আদালতে জানাতে গিয়েছিলাম। বিচারক অবশ্য তার আগে নিজেই সেই ত্রুটির কথা জানিয়ে সিআইডি-কে ভর্ৎসনা করেন।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.