যে বাঁচার ন্যূনতম অধিকারগুলো দাবি করে। এক স্বতন্ত্র সম্ভাবনা দেখলেন
বোলান গঙ্গোপাধ্যায় |
১৩ বছরের পিতৃহীন মেয়েটি এই বাড়ি থেকে দাদার সঙ্গে স্কুলে যেত। সে দাঁড়াতে চাইছিল বইকে হাতিয়ার করে। দরিদ্র মামারা তার মূক-বধির মাকে কিছু সাহায্য করে ওদের উঠে দাঁড়াবার সুযোগ করে দিচ্ছিলেন। তাঁদেরও নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তবু ভাগ্নে-ভাগ্নির পড়া বন্ধ হয়নি। বিয়ে দিয়ে দায়মুক্তিও চাননি। এ যেন অন্য এক পশ্চিমবঙ্গ দেখতে পাই।
মেয়েটিকে তিন জন মিলে ধর্ষণ করে মেরে ফেলে যায়। কুড়ি ঘণ্টা পর যখন তার মৃতদেহ মেলে, তখন তার দশ হাত দূরে ধর্ষক ছেলেটি খেতে কাজ করছে। সেও হতদরিদ্র। কেন এই কাজ করল? কোনও সদুত্তর গ্রামবাসীদের কাছে নেই।
তবে আর যাতে এমন না-ঘটে, তার জন্য তাঁরা ঘটনার দু’দিন পর থেকেই উদ্যোগী হয়েছেন। এগারো জনের কমিটি গঠন করেছেন। সেই কমিটিই মেয়েটির কেস নিয়ে লড়ছে। তাঁরা এককাট্টা: যে দলেরই সমর্থক বা সদস্য হোক, কিছু এসে যায় না।
গ্রামের মঙ্গল, মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য তাঁরা জড়ো হয়েছেন একটি অ-রাজনৈতিক ছাতার তলায়। কমিটি গ্রামে এক সপ্তাহ ধরে প্রতিবাদ আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়েছেন। শোকমিছিল, এক দিন অরন্ধন হয়েছে। থানায়, বিডিও-র কাছে ডেপুটেশন দিয়েছেন। ২১ তারিখে ধর্মঘট করেছেন গ্রামে। ১৫ মিনিটের প্রতীকী ট্রেন অবরোধ করতে চেয়েছিলেন। পুলিশ করতে দেয়নি। |
একই চিত্র কামদুনিতেও। সেখানে ধর্ষিতা মেয়েটির পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে গোটা গ্রাম। গেদে-র মতো। দু’জায়গাতেই স্থায়ী প্রতিকার হিসেবে চাওয়া হচ্ছে, বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম প্রয়োজন। যেমন, গেদে-র মানুষরা থানা চেয়েছেন। ১৬ কিলোমিটার দূরে ৫১টি গ্রাম নিয়ে একটি থানা। ২০-রও কম পুলিশ। অথচ সীমানা-গ্রাম বলে বিএসএফ ক্যাম্প আছে। সীমান্তের অন্যান্য জায়গার মতো এঁরাও বিএসএফ দ্বারা উৎপীড়িত। কিন্তু অত দূর থানায় প্রতিকার, চাইতে যাওয়া অসম্ভব। অবাস্তব। অন্য সীমান্তবর্তী গ্রামের মতোই গেদেতেও সমাজবিরোধী, চোরাচালানকারীদের আনাগোনা খুব বেশি। অথচ নিরাপত্তার জন্য আলাদা ব্যবস্থা নেই। টিমটিমে আলোর বদলে তাঁরা আলোকিত রাস্তা চান। চান বিপিএল কার্ডের অব্যবস্থার নিরসন। দারিদ্রসীমার একেবারে তলানিতে পড়ে থাকা এই পরিবার বিপিএল কার্ড পাননি, অথচ সম্পন্ন পরিবাররা পেয়েছে। এই দুর্নীতি-অব্যবস্থার প্রতিকার চান তাঁরা।
ঠিক যেমন কামদুনির মানুষ চেয়েছেন বিদ্যুৎ, পরিবহণ, স্কুল, রাস্তা, পানীয় জল ও নিরাপত্তা। যা প্রাণধারণের জন্য জরুরি, অথচ স্বাধীনতার ৬৬ বছর পর তার দাবি নিয়ে নাগরিককে পথে নামতে হচ্ছে।
নাগরিক সমাজ এখন সারা পৃথিবীতেই অনেক বেশি সোচ্চার। সচেতন। তা শাহবাগ, তেহরিক স্কোয়ারই প্রমাণ করেছে। পশ্চিমবঙ্গ সেই সচেতনতারই ধারাবাহিকতা।
গ্রামের মানুষ সমাজের প্রয়োজনে পঞ্চায়েত তৈরি করেছিলেন। কিন্তু রাজনীতির পাটোয়ারি বুদ্ধির কাছে সে ব্যবস্থা বলি হয়েছে। গ্রাম-সমাজ নয়, রাজনীতির রং নিয়ে পঞ্চায়েতের এখন বেশি মাথাব্যথা। তাই, শুধু বাঁচার তাগিদেই নাগরিক সমাজ প্রতিকারের আন্দোলনে নেমেছেন।
এ এক নতুন স্বর। নতুন ভাবনা। যা ভোটের সঙ্গে নিজেদের সমাজ জীবনের নিরাপত্তা, সুখ-দুঃখ মিলিয়ে ফেলে না। প্রসঙ্গত মনে পড়ে সিঙ্গুরকে। সেখানেও রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ার বাইরেই শুরু হয়েছিল গ্রামবাসীর নিজস্ব আন্দোলন। কিন্তু ধরে রাখা যায়নি। দলীয় রাজনীতির কালো থাবা তাকে গ্রাস করেছিল। তাই এই নতুন স্বরকে বাঁচিয়ে রাখতে অনেক সচেতন, সাবধানী হতে হবে।
ধর্ষণ কেন এবং কী তার প্রতিকার? প্রশ্নটি অনেক চিন্তা এবং সমাজ-মানসিকতার বিশ্লেষণ দাবি করে। এটা দলীয় ক্ষমতার দর্পের চাইতে যে বেশি কিছু, তা এখনই বুঝছি। কিন্তু দৈনন্দিন নিরাপদ বাঁচার জন্য প্রশাসনের যেটুকু করা কর্তব্য, সেটুকু করবে না কেন? উত্তর নেই। আজ নাগরিক সমাজ সেই প্রশ্নের উত্তর চেয়ে এককাট্টা হচ্ছে। বলতেই হবে, আমাদের ছোট ছোট মেয়েদের জীবন, ইজ্জতের পরিবর্তে এক নতুন পশ্চিমবঙ্গ মাথা তুলতে চাইছে। |