নিজেদের জেদে এবং পরিবারের সহযোগিতায় এই মেয়েরা কত দূর থেকে কলেজে আসে।
রাস্তাঘাটে আলো, আরও কিছু বাসরুট, আরও ঘন ঘন বাস: এদের জন্য এইটুকু কি করা যায় না? |
সে দিন যখন রাজারহাট-খড়িবাড়ির রাস্তায় গাছপালায় ঘেরা ডিরোজিয়ো কলেজের নীল-সাদা বাড়িটা পিছনে ফেলে আসছি, চোখের উপর ভাসছিল কলকাতার খুব কাছেই উত্তর ২৪ পরগনার ছাত্র-ছাত্রীদের মুখগুলি, প্রতিদিনই যাদের বাঁচার অধিকার ও শিক্ষার অধিকার নানা ভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। এদের মধ্যে অনেকেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ও নিম্নবর্ণ হিন্দু পরিবারের প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া; যাদের কারও বাবা-মা সামান্য জমিতে ধান, আলু বা সরষে ফলান; কারও বাপ-ভাই রাজমিস্ত্রি বা দিনমজুর। রোজগারের তাগিদে বছরে ১০০ দিনের কাজে যেতে হয় কলেজের অনেক ছাত্রকেই। কলেজের কাউন্সেলিং সেলের বিশেষজ্ঞদের কাছে বেশির ভাগ সময়ে তাই তারা আসে আর্থসামাজিক চাপে ক্লাস না করতে পারা বা পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়ার মনখারাপ নিয়ে।
• আর যারা ওই কলেজের মোট পড়ুয়ার ৪০ শতাংশ, সেই ছাত্রীরা? যাদের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ বাঙালি মুসলমান পরিবারের এবং বাকি ১৫ শতাংশ অবাঙালি ও বাঙালি হিন্দু পরিবারের— তারাও কি একই ধরনের সমস্যা নিয়ে আসে? নাকি বাড়ি থেকে পড়া বন্ধ করে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলে তবেই তারা কাউন্সেলিং সেলের শরণাপন্ন হয়? নাকি উঁচু উঁচু পাঁচিল ঘেরা ফাঁকা জমি ও ভেড়ির পাশ দিয়ে আসতে আসতে প্রায়ই যে ধরনের হয়রানির শিকার হয় তারা, সেগুলোর মোকাবিলা করবে কী ভাবে, সেটাই আলোচনা করতে চায়? |
খুবই আশার কথা যে কলেজ স্তর পর্যন্ত যে ছাত্রীরা পৌঁছতে পারছে, তারা নিজেদের জেদে এবং কখনও কখনও পরিবারের মানুষদের সহায়তায় বিয়ের পরও অনেক সময় পড়া চালিয়ে যাচ্ছে। তবে বিবাহিত বা অবিবাহিত, সব মেয়েদের জন্যই কলেজে আসার সমস্যা অনেক। অন্ধকার বড় রাস্তা, বিদ্যুৎ না-পৌঁছনো গ্রামের পথ, বাস স্টপের ভয়াল নির্জনতা, খুব কম বাসরুট, অনেকক্ষণ পর পর আসা বাস এদের বাধ্য করে কেবলমাত্র সকাল এগারোটা থেকে দুপুর তিনটের মধ্যে ক্লাসগুলো করতে। বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থা কলেজের কাছে বড় বড় জমি কিনে বিশাল পাঁচিল তুলে দেওয়ায় এবং পাঁচিল-ঘেরা ফাঁকা জমিতে আলোর ব্যবস্থা না করায় সেগুলো হয়ে ওঠে স্থানীয় সমাজবিরোধীদের আখড়া। নিরাপত্তার অভাবে মেয়েরা বিকেলের দিকে কলেজের ‘রেমিডিয়াল’ ক্লাসগুলো করতে পারে না, যেগুলো করলে তাদের পরীক্ষার ফল আর একটু ভাল হত। ভাল ছাত্রী হয়েও বিজ্ঞান বিষয় বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা তাদের থাকে না তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার তাগিদে।
পথেঘাটে নিয়ত যৌন হেনস্থার ঘটনা এদের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। মনে পড়ছে দ্বিতীয় বর্ষের সেই লাজুক মেয়েটির মুখ, যে মুখ ফুটে প্রায় কিছুই বলতে পারল না। তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী যখন বলছিল গত দু-বছর বাড়ির প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে কী ভাবে দাঁতে দাঁত চেপে কলেজে আসছে এবং এখন তাদের কলেজেরই এক জনের বীভৎস মৃত্যুর পর যে কোনও দিন মেয়েটির বাড়ি থেকে পড়া বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে, তখন ওই দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রীটি লজ্জায় যেন মাটিতে মিশে যাচ্ছিল। বাড়ির আপত্তিটা যেন তারই লজ্জা! তার ভাইয়ের যতটুকু, তারও ততটুকু খাবার, একই শিক্ষার স্তর পর্যন্ত পৌঁছনোর অধিকার যে আছে, সেটা তো কেউ তাকে কখনও সাহস দিয়ে বলেইনি। রাস্তায় হেনস্থা হওয়ার কথাটা মুখ ফুটে প্রকাশ্যে বলার লজ্জাটাও তার! তাকে এবং তার মতো শত-সহস্র মেয়েকে তো ছোট থেকে শেখানোই হয়েছে যে লজ্জা নারীর ভূষণ। তাই ডিরোজিয়ো কলেজের মেয়েরা পর্বতপ্রমাণ বাধা ডিঙিয়ে ক্লাস করলে আসলেও, কী ভাবে অনেক দিন ধরেই কলেজে আসতে ভীত-সন্ত্রস্ত বোধ করছে, সেটা কাউন্সেলিং সেলে এসে জড়তা কাটিয়ে বলতে না-পারাটা কিছুই আশ্চর্যের নয়।
আর যৌন হয়রানির কথা মুখ ফুটে বলতে না পারা তো বারাসতের মেয়েদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আলোচনা-চক্রে শুনেছিলাম, ঝাড়গ্রাম, ক্যানিং কিংবা বর্ধমানের নানা প্রান্তিক গোষ্ঠীর কলেজ-পড়ুয়া মেয়েদের কথা কলেজে কাউন্সেলিং সেল বা যৌন হেনস্থা-বিরোধী সেল থাকলেও তারা খুব বড় রকমের নৃশংস ঘটনা না ঘটলে মুখ খোলে না। ওই সেলগুলোও কাজ করে নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে। অথচ দরকার ছিল, নানা ভাবে এই সেলগুলির মাধ্যমে মেয়েদের ন্যায্য অধিকার ও নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতন করে তোলা। এ বিষয়ে লাগাতার আলোচনার পরিবেশ তৈরি করা। প্রয়োজন কলেজগুলিতে মেয়েদের শরীরচর্চা ও খেলাধূলার পরিবেশ তৈরি করা।
ডিরোজিয়ো কলেজে অবশ্য এখনও পর্যন্ত যৌন হেনস্থা-বিরোধী সেল তৈরি হয়নি। তবু তাদেরই এক জনের মর্মান্তিক পরিণতি ও সেই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রাজ্য জুড়ে আলোড়ন তাদের এতটাই নাড়িয়ে দিয়েছে যে গত কয়েক মাসে ঘটে যাওয়া যৌন নিগ্রহের যে ঘটনাগুলো সম্পর্কে ছাত্রীরা এত দিন সম্পূর্ণ নীরব ছিল, আজ সেগুলো অন্তত তারা নিজেদের মাস্টারমশাইদের গোচরে আনছে। তারাও সরব হতে শুরু করেছে এবং তাদের বেশির ভাগ শিক্ষক-শিক্ষিকা সংবেদনশীলতার সঙ্গে তাদের সময় দিচ্ছেন। এটা একটা আশার জায়গা।
স্থানীয় স্তরে এই সচেতনতা জাগিয়ে রাখার চেষ্টাটা ধরে রাখতে গেলে বাইরে থেকেও কিছু কিছু পদক্ষেপ করা জরুরি। রাজ্য মানবাধিকার কমিশন ও রাজ্য মহিলা কমিশন আশ্বাসমূলক আলোচনার জন্য কলেজগুলোতে গেলে এই ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের মনের জোর বাড়ে।
আর সত্যিই যদি এই আশার জায়গাটা ধরে রাখতে হয়, তবে কলেজ-সংলগ্ন অঞ্চলে দ্রুত একটা পরিকাঠামোগত উন্নয়ন হওয়া দরকার। ডিরোজিয়ো কলেজ যে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের (West Bengal State University) অন্তর্ভুক্ত, মাত্র পাঁচ-ছয় বছর আগে স্থাপিত সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আজও বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি! অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় রয়েছে ৬০টিরও বেশি কলেজ। বারাসতের নীলগঞ্জে ধানখেত-ঘেরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল চত্বরে জেনারেটার-চালিত বিদ্যুৎ অবশ্যই প্রবাহিত হয়, কিন্তু নীলগঞ্জ থেকে কাজিপাড়ার বাসরাস্তা পর্যন্ত অনেকটা রাস্তা অন্ধকার। আশেপাশের গরিব কলেজগুলো থেকে স্নাতক হয়ে আসা মেয়েরা কী ভাবে এই রাস্তায় নিরাপদ বোধ করবে যদি সেখানে আলো না থাকে? কিছু বাসরুট যদি চালু না হয়? ডিরোজিয়ো কলেজে ছেলেমেয়েরা যাতে নির্বিঘ্নে সকাল-সন্ধে যাতায়াত করতে পারে, তার জন্য বড় রাস্তা দরকার। গ্রামের পথে আলো দরকার। বাসস্টপগুলোতে আলো দরকার। আরও বাসরুট দরকার। বাসগুলি আরও ঘন ঘন চলা দরকার। এই কাজগুলি প্রশাসনকেই করতে হবে। কাজগুলি একেবারেই কঠিন নয়, একটু মনোযোগ দিলেই করে ফেলা সম্ভব। কিন্তু সেটুকু মনোযোগ যদি প্রশাসন না দিতে পারে, তা হলে কী হবে? এলাকায় সমাজবিরোধীদের প্রকোপ বাড়তেই থাকবে। ফাঁকা জমির চারপাশে পাঁচিল আরও উঁচু হতে থাকবে। একটি ঘটনার অভিযুক্তদের দ্রুত ফাঁসির ব্যবস্থা করলেও কামদুনি-লাঙলকোটা-পাথরঘাটার মেয়েদের কোনওভাবেই নিরাপত্তা দেওয়া যাবে না। সংবাদমাধ্যমগুলো অবশ্য তখন অন্য খবর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠবে। আমরাও চুপচাপ হয়ে যাব। |