দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে দুই সংগঠন প্রস্তুত করেছে সাড়ে তিনশো পাতারও বেশি বিপুলাকার এক রিপোর্ট।
হাজার হাজার মানুষের কাহিনি, যাঁরা হয় নিখোঁজ, নয় লাশ। ভূস্বর্গে তো এমনটাই হয়ে থাকে। |
বড্ড ভাল সেই দৃশ্য! ট্রেনের কামরায় স্কুলছাত্রীদের সঙ্গে পাশাপাশি বসে গল্প করতে করতে চলেছেন মনমোহন সিংহ এবং সনিয়া গাঁধী। কাশ্মীর উপত্যকার বানিহাল থেকে কাজিগুন্দ পর্যন্ত নতুন রেললাইনের উদ্বোধনে গিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং ইউ পি এ-র চেয়ারপার্সন। ওই রেলপথ বরফ পড়লেও বন্ধ হবে না, ফলে দেশের বাকি অংশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নও হবে না উপত্যকার।
দুই হাস্যোজ্জ্বল মুখের ছবি মেলাতে না মেলাতেই আবার, আবারও রাষ্ট্রশক্তির অন্য মুখ দেখলেন উপত্যকার মানুষ! উত্তর কাশ্মীরের বন্দিপোরা জেলার সুম্বল এলাকায় তল্লাশির সময় গুলি চালাল সেনাবাহিনী। মারা গেল দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র, ১৮ বছরের ইরফান নবি। সাধারণ মানুষজনের অভিযোগ, কোনও প্ররোচনা ছাড়াই গুলি চলেছে। প্রতিবাদে ফেটে পড়ে আশপাশের গ্রামের মানুষ পর দিন সকালে যখন বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, সে সময় দ্বিতীয় বার গুলি চালায় সেনাবাহিনী। মারা যান বছর সাতাশের ইরশাদ আহমেদ ডর। এই ঘটনার পরে মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা বললেন, ‘আমার সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই।... যদি ওদের জীবন ফেরানো যেত, তা হলে তার জন্য যা প্রয়োজন তা-ই করতাম আমি। কিন্তু সেই ক্ষমতা তো মানুষের নেই।’ |
প্রাণ ফেরানোর ক্ষমতা নেই রাষ্ট্রশক্তির, প্রাণ নেওয়ার ক্ষমতা আছে। সেই কারণেই তার দায়িত্ব আরও বেশি। সে দায়িত্ব পালন করা হয় কি? একটু পুরনো এক কাহিনিতে যাওয়া যাক। মহম্মদ আশরফ কোকা-র কাহিনি। অনন্তনাগ জেলার যে মহল্লায় তাঁর বাড়ি, তার নাম কোকাগুন্ড, দুরু-র ভেরিনাগের এক মহল্লা। ২৭ অক্টোবর ২০০১ সে বাড়ি থেকে বছর তেইশের আশরফকে তুলে নিয়ে গেল ইন্দো টিবেটান বর্ডার পুলিশের (আই টি বি পি) একটি দল। তাঁকে আর পাওয়া গেল না। আশরফ ছিলেন বিজবেহেরা-র সাব-জজ কোর্টের জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট। তাঁর পরিবার অভিযোগ করল, আই টি বি পি-র দশম ব্যাটালিয়নের ভেরিনাগ ক্যাম্পের জওয়ানেরা তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছে। আশরফের বাবা গুলাম হাসান কাকা ওই দলটির কয়েক জনকে চিনতেও পেরেছিলেন।
চেনাটা স্বাভাবিকও বটে। কারণ, যে কোনও উপদ্রুত এলাকায় পুলিশ বা সেনাবাহিনীর ছাউনি থাকলে স্থানীয় মানুষজন ধীরে ধীরে সংশ্লিষ্ট শিবিরের জওয়ানদের চিনে যান। এর উল্টোটাও সত্যি। আশরফের পরিবার এফ আই আর করতে গেলে পুলিশ যথারীতি তা নিতে চাইল না।
তাঁর পরিবার বিচার বিভাগের দ্বারস্থ হল। অনন্তনাগের মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশে পুলিশ এফ আই আর নিল ৩ নভেম্বর। জম্মু-কাশ্মীর হাইকোর্টে আশরফের পরিবার একটি হোবিয়াস কর্পাস আবেদন পেশ করে (নিখোঁজ ব্যক্তিকে সশরীরে আদালতের সামনে হাজির করানোর আর্জি)। আশরফকে তাদের হেফাজতে রাখার কথা অস্বীকার করে আই টি বি পি। ২০০৩-এর ১৬ সেপ্টেম্বর অনন্তনাগের জেলা ও দায়রা জজকে এই ঘটনার তদন্ত করতে বলে হাইকোর্ট। ২০০৪-এর ২১ ডিসেম্বরের রিপোর্টে জেলা ও দায়রা জজ এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের সুপারিশ করলেন।
কিন্তু পুলিশ রইল পুলিশেই! তদন্তে ঢিলেমি দেখে আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে আশরফের পরিবার ফের হাইকোর্টে গেল। ২০০৫-এর ১৪ নভেম্বর হাইকোর্ট তদন্ত শেষ করার নির্দেশ দিল। তাতেও কাজ হল না। আশরফের পরিবার দ্বিতীয় বার আদালত অবমাননার অভিযোগ করল হাইকোর্টে। ২০০৭-এর ১৬ অক্টোবর হাইকোর্ট অনন্তনাগের মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটকে এ ব্যাপারে নির্দেশ দিল। ইতিমধ্যে পুলিশ হাইকোর্টে তাদের পেশ করা রিপোর্টে জানায়, আশরফের অন্তর্ধানের পিছনে আই টি বি পি-র ১১ জন কর্মী অভিযুক্ত। আশরফের পরিবার আবার হাইকোর্টকে জানাল, তদন্তে আদৌ অগ্রগতি হচ্ছে না।
ইতিমধ্যে জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্য মানবাধিকার কমিশন তাদের তদন্ত রিপোর্টে জানায়, আশরফ নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজত থেকেই নিখোঁজ হয়েছে। তার পরিবারকে এককালীন ২ লক্ষ টাকা সাহায্য এবং ক্ষতিপূরণ বাবদ তার পরিবারের এক জনকে চাকরি দেওয়ার সুপারিশ করে কমিশন। কিন্তু আশরফের বাবা এক লক্ষ টাকা পান। আশরফের ভাই সরকারি চাকরিও পান। বৃদ্ধ গুলাম হাসান কোকা এ ব্যাপারে আর এগোননি। মানবাধিকার কমিশনে বিষয়টির ওখানেই ছেদ ঘটল।
কিন্তু, আশরফের অন্তর্ধান-রহস্যের সমাধান হয়নি। মামলাটি এখনও হাইকোর্টে ঝুলছে!
কাশ্মীরের হাজার হাজার কিশোর-যুবক-প্রৌঢ় গত দুই দশকে নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজত থেকে যে ভাবে ‘নিখোঁজ’ হয়েছেন, এই ঘটনা তারই একটি মাত্র। নেহাতই মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত এক একটি পরিবার গণতন্ত্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দরজায় দরজায় সুবিচার চেয়ে কী ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, উপত্যকায় পা দিন, সেখানকার আকাশ-বাতাস সে কাহিনি শুনিয়ে দেবে।
আশরফের মতো এ রকমই অজস্র ঘটনার উল্লেখ রয়েছে উপত্যকার মানবাধিকার সংগঠন ‘ইন্টারন্যাশনাল পিপল’স ট্রাইব্যুনাল ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড জাস্টিস ইন ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্টারড কাশ্মীর (আই পি টি কে) এবং ‘অ্যাসোসিয়েশন অব পেরেন্টস অব ডিসঅ্যাপিয়ারড পারসন্স’-এর (এ পি ডি পি) রিপোর্টে। দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে এই দুই সংগঠন প্রস্তুত করেছে সাড়ে তিনশো পাতারও বেশি বিপুলাকার এই রিপোর্ট। প্রতিটি ঘটনার কালপঞ্জি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে সরকারি নথি অনুযায়ী। এই নথিপত্র পাওয়ার জন্য তাদের বারে বারে সাহায্য নিতে হয়েছে তথ্যের অধিকার আইনের। তাতে তারা কখনও সফল হয়েছে, কখনও নয়। রিপোর্টে নিরাপত্তা বাহিনীর এ রকম অভিযুক্ত ৫০০ জন কর্মীর তালিকা রয়েছে। ‘অ্যালেজ্ড পারপিট্রেটরস’ রিপোর্টে এমন অনেক ঘটনার কথা আছে। এ রকমই তো হয় ভূস্বর্গে! উপত্যকার হাজার হাজার মানুষ মেনে নেন, ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী সন্দেহে, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মদতে ধ্বংসাত্মক কাজের অভিযোগে যে কাউকে যখন-তখন তুলে নিয়ে যেতে পারে। কোথায়, তা সচরাচর জানা যায় না। এবং তাঁদের অনেককেই পরে আর পাওয়াও যায় না। স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে যায় মানুষগুলো!
কাউকে কাউকে পাওয়া যায় অবশ্য। বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে, জঙ্গলের মধ্যে অথবা সড়কের পাশে, বুলেটবিদ্ধ অবস্থায়, শুকিয়ে খয়েরি হয়ে যাওয়া রক্তের বদ গন্ধের মধ্যে শুয়ে থাকে তারা। জানা যায়, জানানো হয়, সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছে তাদের। নিরাপত্তা বাহিনীকে আক্রমণ করায় ‘বাধ্য হয়ে’ গুলি চালাতে হয়েছে। ব্যস! কোনও প্রতিকার নেই, কারণ সেই রক্ষাকবচ! সশস্ত্র বাহিনী (বিশেষ ক্ষমতা) আইন, ১৯৯০ বা আফস্পা। এই আইনের বলেই তো সামরিক বা আধা সামরিক বাহিনীর যা খুশি করার অধিকার জন্মে যায়। এ আইন রদ করার জন্যই মানবাধিকার সংগঠনগুলির দীর্ঘ আন্দোলন চলছে। এক যুগেরও বেশি অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন মণিপুরের ইরম শর্মিলা চানু। এই আইনের বলেই, যত মারাত্মক অভিযোগই উঠুক না কেন, সরকারের অনুমতি না মিললে নিরাপত্তা বাহিনীর কারও বিরুদ্ধেই কোনও আইনি প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই অনুমতি মেলে না।
ভূস্বর্গের উত্তুঙ্গ শিখরের রং বদল দেখতে, পাইন ও দেবদারুর জঙ্গলের গান শুনতে, ডাল লেকের হাউসবোটে, আপনাকে আমন্ত্রণ জানাই। সোনমার্গ, গুলমার্গ, পাটনিটপ আর পহেলগাঁও আপনারই অপেক্ষায়! তার বাইরে আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি! |