লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হইবে, অথচ অ-কংগ্রেসি, অ-বিজেপি তৃতীয় বিকল্প বা মোর্চা লইয়া তৎপরতা শুরু হইবে না, ইদানীং ভারতীয় রাজনীতিতে ইহা অকল্পনীয়। প্রতিটি নির্বাচনের আগে সি পি আই এমের নেতৃত্বে বামপন্থীরাই সর্বাগ্রে এই তৃতীয় বিকল্পের ধুয়া তুলিয়া থাকেন। এ বার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী আগেই ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় মোর্চা’ গড়ার ডাক দিয়া বামপন্থীদের পিছনে ফেলিয়া দেন। মুলায়ম সিংহ যাদব অবশ্য জানাইয়া দেন, ভোটের ফলপ্রকাশের পরেই এমন জোট গড়িয়া উঠিতে পারে। কিন্তু বামেরা তাহাতে দমিবেন কেন? অচিরেই প্রকাশ কারাট প্রমুখ ‘কর্মসূচি’র ভিত্তিতে তৃতীয় বিকল্প জোট গড়ার স্লোগান লইয়া মঞ্চে হাজির।
কারাটদের প্রস্তাবে নূতন কিছু নাই। দেশবাসী এত কাল ধরিয়া তাঁহাদের মুখে যাহা শুনিয়া আসিয়াছেন, তাহারই পুনরাবৃত্তি। গণবণ্টনে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ, পরিকাঠামোয় সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বিদেশ নীতিতে সার্বভৌমত্বের উপর জোর দেওয়া ইত্যাদি পুরানো এবং বহুলাংশে বস্তাপচা শর্তাবলির চর্বিতচর্বণই বাম বিকল্পের সার কথা। তুলনায় নূতন বলিতে খনিজ সম্পদের জাতীয়করণ এবং খুচরা ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ বন্ধের শর্ত, তবে তাহাও পুরানো বোতলমাত্র। কিন্তু বামপন্থীরা যাহাদের স্বাভাবিক মিত্র গণ্য করেন, সেই সমাজবাদী পার্টি, বিজু জনতা দল, তেলুগু দেশম, সংযুক্ত জনতা দল কিংবা এ ডি এম কে’র মতো দলগুলি তো সাধারণত উদারীকরণ এবং বিদেশি লগ্নির পক্ষে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণে তাহারা কেন জোটবদ্ধ হইবে? বামপন্থীরা নিশ্চয় মনে মনে জানেন, তাঁহাদের এই সব শর্ত একবিংশ শতাব্দীর ভারতে প্রায় কোনও দলই শিরোধার্য করিতে প্রস্তুত নয়। একটি দল অবশ্যই ব্যতিক্রম, তাঁহাদের নেত্রীও আগমার্কা বামপন্থী। কিন্তু হায়! কারাট-বুদ্ধদেব-বিমানরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহিত পঙ্ক্তিভোজনে বসিবেন কী উপায়ে? বিকল্প জোটের শর্ত বা দাবি লইয়া যাবতীয় আলোচনা ও জল্পনা অবশ্য সম্পূর্ণ অর্থহীন, যদি লোকসভায় পর্যাপ্তসংখ্যক আসন না মেলে। সংসদীয় শক্তির উপরেই নির্ভর করিবে অন্য দলের সহিত জোট গড়ার আলোচনা, কর্মসূচির উপর নয়। বামেরা যখন লোকসভায় ৬০-এর অধিক আসন দখল করেন, তখন জোট গড়ার জন্য শর্ত আরোপের অবস্থানে ছিলেন। অতঃপর তাঁহাদের সমূহ শক্তিক্ষয় হইয়াছে। তাঁহাদের সমর্থন বা বিরোধিতার উপর সরকারের থাকা, না-থাকা নির্ভর করে না, যেমন ২০০৯ সালে করিত। তাই কেহ আর এখন তাঁহাদের মুখাপেক্ষীও নয়। তাঁহাদের নেতৃত্ব শিরোধার্য করা দূরস্থান, তাঁহাদের সহিত তৃতীয় বিকল্প গড়িতেও কেহ বিশেষ ব্যগ্র নয়। ভারতীয় গণতন্ত্রের দরবারে কলকে পাইতে হইলে লোকসভায় আসন বাড়াইতে হইবে। তাহার জন্য জনাদেশ চাই। সূর্যকান্ত মিশ্ররা বরং সে দিকে মন দিন। |