বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনী না দেওয়ার পণটি দুর্যোধনের পক্ষে শেষ পর্যন্ত প্রাণঘাতী হইয়াছিল। কথাটি অনেক সময় স্মরণ থাকে না, বিশেষত যখন জেদ প্রবল হইয়া উঠে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে তাহা স্মরণ করাইয়া দেওয়ার প্রয়োজন নাই ধনেখালি হইতে পঞ্চায়েত ভোট, কোনও যুদ্ধেই আদালতের ধোপে তাঁহার জেদ টেকে নাই। পঞ্চায়েত ভোটকে কেন্দ্র করিয়া তাঁহার সরকার এমন কুনাট্য রচনা করিল কেন, তাহা বোঝা দুষ্কর। রাজনৈতিক যুক্তি বলিবে, পঞ্চায়েত নির্বাচনে জয় লইয়া তাঁহার দুশ্চিন্তার তেমন কারণ ছিল না। তাঁহার রাজ্য পরিচালনার পদ্ধতি লইয়া প্রশ্ন বিলক্ষণ উঠিয়াছে, কিন্তু সেই প্রশ্নের এখনও এমন জোর নাই যে ব্যালট বাক্সে তাহার ধাক্কা লাগিবে। এমন ‘সহজ’ নির্বাচন কয় দফায় হইবে, কেন্দ্রীয় বাহিনী আসিবে কি না ইত্যাদি কূটপ্রশ্ন লইয়া কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ কেন? নেহাতই জেদের যুদ্ধ? কিন্তু জেদ তো বড় উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করা ভাল। বড় যুদ্ধে জিতিবার জন্য অনেক ক্ষেত্রে ছোট লড়াইয়ে হার স্বীকার করিয়া লইতে হয়। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সহিত তাঁহার সংঘাতের প্রথম অধ্যায় হইতেই উপসংহারটি বোঝা সম্ভব ছিল মুখ্যমন্ত্রী সংবিধানের বিপ্রতীপ অবস্থানে দাঁড়াইয়া আছেন। আদালতে সেই লড়াই জেতা সম্ভব নহে। তিনি নিজের জেদের নিকট আত্মসমর্পণ না করিয়া সেই লড়াইয়ে পরাজয় স্বীকার করিয়া লইলে তাঁহার গৌরব কমিত না। সব লড়াই লড়িতে নাই।
মমতাদেবী দৃশ্যত এই দর্শনে বিশ্বাসী নহেন। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সহিত লড়াই যত তাঁহার হাতছাড়া হইয়াছে, তিনি তত বেমানান অস্ত্র প্রয়োগ করিয়াছেন। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে খর্ব করিতে বামফ্রন্ট সরকার যে অনৈতিক আইন প্রণয়ন করিয়াছিল, মমতাদেবী সেই আইনকেও নিজের তূণে রাখিতে দ্বিধা করেন নাই। সেই অস্ত্র বিলক্ষণ প্রয়োগও করিয়াছেন। তাহাতে লাভ হয় নাই, তিক্ততা বাড়িয়াছে মাত্র। এই লড়াইয়ে আরও একটি দুর্ভাগ্যজনক অস্ত্র ব্যবহৃত হইল সংখ্যালঘু আবেগ। তবে, পূর্বোক্ত অস্ত্রটির সহিত বর্তমান অস্ত্রের একটি ফারাক লক্ষণীয়। রমজানের সময় ভোটে মুখ্যমন্ত্রী আপত্তি করিয়াছেন, এবং সিপিএম অথবা কংগ্রেস, কেউই এই প্রশ্নে দ্বিরুক্তি করে নাই। আপাতদৃষ্টিতে মনে হইতে পারে, প্রশ্নটি ধর্মীয় আচরণের। কিন্তু সব দলের সম্মিলিত শিরসঞ্চালন প্রমাণ করিয়া দেয়, ভারতীয় গণতন্ত্রে সংখ্যালঘু আবেগকে অতীতে বহু বার যে ন্যক্কারজনক ভঙ্গিতে ব্যবহার করা হইয়াছে, এই বারও তাহাই হইতেছিল। সৌভাগ্যক্রমে সুপ্রিম কোর্ট তাহা বাড়িতে দেয় নাই, প্রশ্নটিকে গোড়াতেই মারিয়া রাখিয়াছে। অবশেষে পঞ্চায়েত ভোটের বিজ্ঞপ্তি জারি হইয়াছে, তাহা স্বস্তির খবর। শেষ পর্যন্ত রাজ্য নির্বাচন কমিশনের শর্তেই নির্বাচনের ব্যবস্থা করিতে হইল ইহাকে মুখ্যমন্ত্রী নিজের পরাজয় বলিয়া ভাবিতেই পারেন। অথবা, এই সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠিয়া তিনি এই মুহূর্তটিকে একটি সুযোগ হিসাবেও বিবেচনা করিতে পারেন ইতিহাসে স্থান করিয়া লইবার সুযোগ। বামপন্থীরা সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থের কথা ভাবিয়া নির্বাচন কমিশনের এক্তিয়ারে সরকারের হস্তক্ষেপের ব্যবস্থা করিয়াছিল। মমতাদেবী নির্বাচন কমিশনকে তাহার এক্তিয়ার ফিরাইয়া দিন। সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন নির্দেশে স্পষ্ট, তাহাই সংবিধানের পথ। অতএব, আজ সরকার উদ্যোগ না করিলে ভবিষ্যতে হয়তো সুপ্রিম কোর্টই রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে তাহার হৃত ক্ষমতা ফিরাইয়া দিবে। সেই দিনের অপেক্ষায় থাকিবার প্রয়োজন নাই। মুখ্যমন্ত্রী স্বপ্রবৃত্ত হইয়া কাজটি করুন। বামফ্রন্ট সরকার আইন প্রণয়নের সময় নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতায় ভাগ বসাইয়া যে অন্যায় করিয়াছিল, তিনি তাহার প্রতিকার করুন, আইন সংশোধন করিয়া নির্বাচন কমিশনকে নিরঙ্কুশ অধিকার অর্পণ করুন। তাঁহার সহিত কমিশনের যে লড়াই শেষ পর্যন্ত ফুরাইল, তাহা মহাকালের হিসাবে নিতান্তই তুচ্ছ। সেই হিসাবের খাতায় ব্যক্তি অকিঞ্চিৎকর, প্রতিষ্ঠানই মূল। রাজ্য নির্বাচন কমিশন নামক প্রতিষ্ঠানটিকে তাহার সম্পূর্ণ অধিকার ফিরাইয়া দিলে ইতিহাস মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ইতিবাচক দিকটি স্মরণে রাখিবে। তাহা তুচ্ছ প্রাপ্তি নহে। |