মিউচুয়াল ফান্ড
সবুরে মুনাফা মেলে
ফুটবল নিয়ে আড্ডায় মেসি-রোনাল্ডোর নাম যত বার ওঠে, সেই তুলনায় থিয়াগো সিলভা বা চিয়েল্লিনির কথা কত বার শুনি আমরা? সম্ভবত দশ বারে এক বারও নয়। অথচ মেসি আর রোনাল্ডো যদি এই মুহূর্তে বিশ্বের দুই সেরা গোল-স্কোরার হয়, তা হলে সিলভা আর চিয়েল্লিনিও প্রথম সারির ডিফেন্ডার। আসলে শুধু আজ নয়, চিরকালই এই খেলায় গোল করা খেলোয়াড়ের যতটা খাতির, গোল বাঁচানোর লোকের তার কানাকড়িও নয়। ঠিক ইক্যুইটি আর ডেট ফান্ডের মতো।

কদর দুয়োরানির!
মিউচুয়াল ফান্ডের চৌহদ্দিতে ইক্যুইটি ফান্ডকে ঘিরে যত মাতামাতি, ডেট ফান্ডকে নিয়ে তার সিকি ভাগও নয়। ইক্যুইটি ফান্ডের তহবিল শেয়ারে খাটে। তাই সেখানে চড়া রিটার্নের হাতছানি। যে কারণে এই ফান্ডকে বেশ নেকনজরে দেখি আমরা।
সেখানে ডেট ফান্ড যেন নিছকই দুয়োরানি, অন্তত সাধারণ লগ্নিকারীদের কাছে। তাঁদের অনেকেই মনে করেন, এখানে রিটার্ন তুলনায় কম। তা হলে আর এর গুণগান করব কেন?
কিন্তু সম্প্রতি শেয়ার বাজারের উথাল-পাতাল এই ধারণাকে অনেকটাই বদলে দিয়েছে। বাধ্য করেছে ডেট ফান্ডকে নতুন আতস কাচের তলায় ফেলতে। মনে করিয়ে দিয়েছে, রিটার্নের সম্ভাবনা ইক্যুইটি ফান্ডে বেশি ঠিকই। কিন্তু তেমনই সেখানে ঝুঁকিও ষোলো আনা।
তাই বাজারের এই দুঃসময়ে এখন সকলের নজর পড়েছে ডেট ফান্ডের দিকে। ফুটবল মাঠে প্রতিপক্ষ ঝোড়ো আক্রমণে উঠলে ডিফেন্ডারের দিকে নজর ফেরে । ঠিক তেমনই শেয়ার বাজারের এই টালমাটাল সময়ে এখন কদর বেড়েছে ফান্ডের ‘দুয়োরানি’র।

আসুন চিনি
ডেট ফান্ড কী, তা নিয়ে এর আগে বেশ কয়েকটি লেখাতেই আলোচনা করেছি আমরা। তবু সংক্ষেপে হলেও, এখানে ফের এক বার তার সঙ্গে পরিচয় সেরে নেওয়া ভাল—
• ডেট ফান্ড হল সেই সব ফান্ড, যার তহবিলের টাকা খাটানো হয় বিভিন্ন ধরনের ঋণপত্রে (সিকিউরিটিজ)। এর মধ্যে রয়েছে সরকারি ঋণপত্র (গভর্নমেন্ট সিকিউরিটিজ), সংস্থার ঋণপত্র (কর্পোরেট বন্ড), ডিবেঞ্চার, ডিপোজিট সার্টিফিকেট ইত্যাদি।
• লগ্নির টাকা এখানে তুলনামূলক ভাবে সুরক্ষিত। শেয়ার বাজারের ওঠা-পড়ার আঁচ এই ফান্ডের গায়ে লাগে না। কারণ, যে-সব জায়গায় এই ফান্ডের টাকা বিনিয়োগ করা হয়, সেখান থেকে আয়ের উত্‌স মূলত দু’টি (১) নির্দিষ্ট হারে প্রাপ্য সুদ (২) মেয়াদ শেষে লগ্নির মূল অর্থ (প্রিন্সিপাল) ফেরত পাওয়া।
• বাজারে বিভিন্ন ধরনের ডেট-ফান্ড রয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু স্বল্প মেয়াদে টাকা রাখার পক্ষে উপযোগী। কিছু আবার দীর্ঘ মেয়াদের জন্য।
নিত্য টালমাটাল শেয়ার দরের ঝক্কি এড়াতে এখন অনেকেই যে ঋণপত্র নির্ভর ফান্ডের দিকে ঝুঁকছেন, তা আগেই বলেছি আমরা। তাদের অনেকেই আবার আস্থা রাখছেন মাঝারি বা দীর্ঘ মেয়াদের (১৮-৩৬ মাস) ফান্ডের উপর। আশা করছেন, বেশ ভাল রিটার্ন দেবে এগুলি।
সুবিধা মন্দ নয়
• আকর্ষণের প্রধান রহস্য কম ঝুঁকি অথচ নিয়মিত ও স্থায়ী আয়। বাড়তি ঝুঁকি ছেঁটে ফেলে যাঁরা লম্বা সময়ের জন্য মোটামুটি ভাবে নির্দিষ্ট অঙ্কের আয়ের রাস্তা খোলা রাখতে চান, তাঁদের জন্য ডেট-ফান্ড উপযোগী।
ইক্যুইটি ফান্ডের চড়া রিটার্নের ‘গ্ল্যামার’ এখানে নেই। কিন্তু তেমনই ঝুঁকিও কম। তাই মেয়ের বিয়ে, উচ্চশিক্ষা, বাড়ি কেনা ইত্যাদির মতো দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনায় অর্থের জোগানদার হিসেবে এই ধরনের ফান্ডের উপর আস্থা রাখা চলে। ইক্যুইটি ফান্ডে কিন্তু তা করা শক্ত। কারণ, বাজারের হাল ভাল হলে হয়তো চড়া রিটার্ন পাবেন। কিন্তু বাজার তলিয়ে গেলে, কত টাকা হাতে আসবে, তা বলা মুশকিল। আর এই কারণেই ডেট ফান্ডকে আঁকড়ে ধরছেন অনেকে।
• মনে রাখবেন, বিনিয়োগে ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা সকলের সমান নয়। এমনকী কেউ তা নিতে না-ই চাইতে পারেন। তাই ইক্যুইটি ফান্ড সকলের জন্য নয়ও। কিন্তু ডেট ফান্ডের আবেদন সর্বজনীন। বাজার অথবা তার ঝুঁকি সম্পর্কে তেমন ধারণা না-থাকলেও সেখানে টাকা খাটানো সম্ভব। সাউথ ক্লাবের ঘাসের কোর্টে শখের টেনিস খেলতে রজার ফেডেরার হতে হবে কেন?
• ডেট ফান্ডের আর একটা মস্ত সুবিধা হল তার বৈচিত্র্য। যেন এমন একটা শাড়ির দোকান, যেখান থেকে পছন্দসই শাড়ি না-কিনে বেরোতো পারবেন না চরম খুঁতখুঁতে মহিলাও। ১০০ থেকে ১০,০০০ সব দামের সব ধরনের শাড়িই যেখানে মজুত।
যেমন ধরুন, হয়তো একেবারে কম সময়ের জন্য জমানো টাকা বিনিয়োগ করতে চান। আবার একই সঙ্গে সেই টাকা চট করে (হয়তো এক-দু’দিনের মধ্যে) তুলতে পারাও আপনার পক্ষে ভীষণ জরুরি। এক কথায়, ফান্ডে কারেন্ট বা সেভিংস অ্যাকাউন্টের সুবিধা চান। সে ক্ষেত্রে ফান্ড ম্যানেজার বলবেন, লিক্যুইড ফান্ড তৈরিই হয়েছে আপনার জন্য। বিস্তারিত জানতে www.anandabazar.com ওয়েবসাইটে গিয়ে গত ২১ মার্চের ‘বিষয়-আশয়’ দেখতে পারেন।
আবার যদি বছর দেড়েকের জন্য টাকা আটকে রাখতে অসুবিধা না-থাকে, তাহলে তুরুপের তাস হয়ে উঠতে পারে ওই মেয়াদের কোনও ফিক্সড ম্যাচিওরিটি প্ল্যান। এককথায়, বিভিন্ন মেয়াদের বিভিন্ন ধরনের ফান্ডের মধ্যে থেকে পছন্দসইটি বেছে নিতে পারবেন আপনি।

ঝুঁকিশূন্য নয়
এখানে একটা কথা স্পষ্ট করে দেওয়া জরুরি। তা হল, ডেট ফান্ডে ঝুঁকি কম ঠিকই। কিন্তু তা বলে শূন্য নয়। মূলত তিনটি ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি রয়েছে
(১) সুদের হার সংক্রান্ত ঝুঁকি: সাধারণ নিয়মে, বাজারে সুদ বাড়লে হাতে থাকা ঋণপত্রের দাম কমে। আর কমলে, উল্টোটা।
কেন? সহজ করে ভাবুন। ধরা যাক, ১০% সুদে ১০০ টাকার (ফেস ভ্যালু) একটি বন্ড কিনলেন। পরের দিনই সুদ বেড়ে দাঁড়াল ১৫%। তার মানে এ বার ১০০ টাকার কম লগ্নি করেই বছর শেষে ১১০ টাকা পাওয়া যাবে। তা হলে ওই বন্ড আর লোকে ১০০ টাকায় কিনবে কেন? তাই স্বাভাবিক ভাবেই দর পড়ে যাবে ওই বন্ডের। আবার বাজারে সুদ কমলে, দাম চড়বে ওই বন্ডেরই।
(২) ঋণ সংক্রান্ত ঝুঁকি: ধরুন, আপনি কোনও সংস্থার বন্ড কিনলেন। কিন্তু আর্থিক সঙ্কট কিংবা অন্য কোনও কারণে প্রতিশ্রুত সুদ তারা দিতে পারল না। কিংবা মেয়াদ শেষে ফেরত দিতে পারল না মূলধনই। তখন কিন্তু মহা ঝক্কি।
(৩) মূল্যায়ন কমার ঝুঁকি: কোনও সংস্থার বন্ড কেনার পর তার ক্রেডিট রেটিং কমে গেলেও বিপাকে পড়তে হতে পারে। কোনও সংস্থাকে ঋণ দেওয়া কতটা ঝুঁকির, এই রেটিং হল তার মূল্যায়ন। তাই তা কমা মানে ঋণের টাকা ফেরত না-পাওয়ার ঝুঁকি বাড়া। সুতরাং সংস্থা রেটিং খোয়ালে তার ঋণপত্রের চাহিদা কমে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।
ডেট-ফান্ডে লগ্নি করলে অন্তত এই তিন ধরনের ঝুঁকির মুখোমুখি হতেই হবে আপনাকে।

জানতেই হবে
ইক্যুইটি ফান্ডের মতো প্রতিনিয়ত বাজারের হালচাল বোঝার ক্ষমতা বা দক্ষতা হয়তো ডেট ফান্ডে লগ্নির জন্য জরুরি নয়। কিন্তু তা বলে একেবারে কিচ্ছুটি না-জেনে জয় মা বলে তরী ভাসানোও কাজের কথা নয়। সুতরাং ঋণপত্র-নির্ভর ফান্ডে লগ্নির জন্য কোমর কষার আগে অন্তত নীচের বিষয়গুলি জেনে রাখুন
এই ফান্ডের লগ্নিতেও ঝুঁকি আছে। যে-ফান্ড ম্যানেজারের উপর ভরসা করে টাকা লাগাচ্ছেন, ঝুঁকি সামলাতে তাঁর কৌশল কী? কোন ফান্ডে ঝড় সামলাতে কী খুঁটি ধরবেন তিনি?
ঋণপত্র কিন্তু ব্যাঙ্কের মেয়াদি আমানত (ফিক্সড ডিপোজিট) নয়। দু’জায়গাতেই সুদ পাওয়া যায় বটে। কিন্তু তাদের হার কখনওই তুলনীয় নয়। তা ছাড়া, আমানতে টাকা রাখলে মেয়াদ শেষে নির্দিষ্ট অঙ্ক পাওয়া মোটামুটি পাকা। বন্ডের বিনিয়োগে সেই আশা করবেন না। আর ঋণপত্রের সুদই যদি নির্দিষ্ট না-হয়, তা হলে ডেট ফান্ড আর নির্দিষ্ট রিটার্ন দেবে কী ভাবে?

হুঁশিয়ার!

লেখা শেষের আগে একটি বিষয়ে সতর্ক করতে চাই। ইদানীং ফান্ডের বাজারে একটা নাম প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। ডায়নামিক বন্ড ফান্ড। বলা হচ্ছে, এই ধরনের ফান্ড কৌশলগত ভাবে অনেক বেশি আগ্রাসী। তাই এখানে রিটার্নও নাকি বেশ চড়া।
আমার পরামর্শ হল, ভাল ভাবে না-জেনে এই ধরনের ফান্ডে টাকা ঢালবেন না। চটজলদি লাভের আশা অনেক সময়ে হতাশার কারণ হতে পারে। তার থেকে এই উথাল-পাথাল বাজারে বরং ধৈর্য ধরুন। নজর রাখুন ব্যাঙ্কিং এবং পিএসইউ (রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা) ডেট ফান্ডের উপর। চোখ রাখতে হবে পরিকাঠামোয় লগ্নি করা ফান্ডগুলির দিকেও। জানেনই তো, সবুরে মুনাফা মেলে।

লেখক উইশলিস্ট ক্যাপিটাল অ্যাডভাইজর্সের ডিরেক্টর
(মতামত ব্যক্তিগত)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.