দোরগোড়ায় হামলা, তাই সতর্ক জেলা
অপূর্ব চট্টোপাধ্যায় ও দয়াল সেনগুপ্ত • সিউড়ি |
নলহাটির কাছে রেল লাইনে ডিটোনেটর এবং জিলেটিন স্টিক উদ্ধার হয়েছে দিন কয়েই আগেই। তার সঙ্গে মাওবাদী যোগ রয়েছে কি না তদন্তও চলছে। শুধু তাই নয়, মাওবাদী মোকাবিলায় ইতিমধ্যে দু’কোম্পানী কেন্দ্রীয় বাহিনীও এসে পৌঁছেছে জেলায়। এরই মধ্যে সীমান্তবর্তী ঝাড়খণ্ডের দুমকায় মঙ্গলবার মাওবাদী হামলার ঘটনায় বীরভূমে নজরদারি আরও বাড়বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই মাওবাদী হামলার ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই সিউড়িতে বুধবার জরুরি বৈঠকে বসেন আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) সিদ্ধিনাথ গুপ্ত।
|
দুমকার কাঠিকুণ্ডে মঙ্গলবার এখানেই খুন হন এসপি-সহ ৬ জন। |
এ দিন দুপুর পৌনে বারোটা নাগাদ খয়রাশোল, রাজনগর, দুবরাজপুর, মহম্মদবাজার, রামপুরহাট, নলহাটির মতো নটি থানার (যেগুলি ঝাড়খণ্ড সীমানা ঘেঁষা অথবা যে সব থানা এলাকায় ইতিমধ্যেই মাওবাদী নাশকতা হয়েছে কিংবা মাওবাদী গতিবিধি লক্ষ্য করা গিয়েছে) ওসি, আইসিদের নিয়ে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে প্রায় ঘন্টা দু’য়েক রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়। জেলা পুলিশ সুপার মুরলীধর শর্মা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দেবস্মিতা দাস, ও জেলা পুলিশের একাধিক আধিকারিকের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন জেলায় সদ্য আসা কেন্দ্রীয় বাহিনীর অ্যাসিস্ট্যান্ট কমান্ডার ধর্মেন্দ্র কুমার।
রুদ্ধদ্বার এই বৈঠকে কী কী বিষয়ে আলোচনা হল, সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে সে ব্যপারে অবশ্য বিশদে কিছু বলতে চাননি আইজি। তিনি বলেন, “মঙ্গলবার যে ঘটনা পাশের রাজ্যে ঘটেছে সেটা খুব বড় ঘটনা এবং ঘটনাস্থলও এই জেলার খুব কাছেই। ঝাড়খণ্ডের কিছু থানা রয়েছে যেগুলি মাওবাদী প্রভাবিত আথবা ওই রাজ্যের জঙ্গলের সঙ্গে বীরভূমের সীমান্ত এলাকার জঙ্গলের যোগ রয়েছে। সেই পথ ধরে সহজেই যাতায়াত করা যায়। সেই কারণেই জেলার সীমান্তবর্তী থানাগুলিতে মাওবাদীদের গতিবিধি রুখতে আগামী তিন মাস আমাদের কী ধরনের পদক্ষেপ বা সতর্কতা নেওয়া উচিত মূলত সেই নিয়েই আলোচনা হয়েছে।” আইজি আরও বলেন, “এর আগেও মাওবাদী সমস্যা নিয়ে ঝাড়খণ্ড পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। প্রয়োজনে আবার বৈঠক করব।” |
|
|
কাঠিকুণ্ডে মাওবাদী নাশকতার পরে মহম্মদবাজার-ঝাড়খণ্ড
সীমান্তের নতুনডিহিতে চলছে তল্লাশি। |
সিউড়িতে বৈঠকে যোগ দিতে
যাচ্ছেন পুলিশ কর্তারা। |
|
যেটুকু জানা গিয়েছে, পুলিশের সুরক্ষা, থানাগুলির সুরক্ষা, পুলিশকর্মীদের কোথাও যাতায়াতের ক্ষেত্রে সতর্কতা, থানায় অ্যালার্মের ব্যবস্থা, জনসংযোগ যতটা সম্ভব বাড়িয়ে তোলার দিকে নজর দিতে বলা হয়েছে বৈঠকে।
তবে মাওবাদী গতিবিধি এই জেলায় বেড়েছে কি না সে প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর দেননি আইজি। কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, ৭০ দশকে বীরভূমে নকশাল আন্দোলনের ইতিহাস আছে। আশির দশকেও জেলায় নকশালবাদী সংগঠন সেকেন্ড সিসি’র কার্যকলাপ পুলিশি তদন্তে ধরা পড়েছে। জেলায় প্রথম মাওবাদী হানা হয়েছে ২০০৩ সালে। ওই বছর সারা ভারত কৃষক সভার নেতা এজাজুল শেখ নিহত হওয়ার ঘটনায় জনযুদ্ধ গোষ্ঠী জড়িত রয়েছে বলে পুলিশ দাবি করেছিল। ২০০৪ সালে পোস্টার সাঁটাতে এসে নলহাটিতে কয়েক জন ধরাও পড়ে। ২০০৭ সালে প্রথম বড় নাশকতা হয় খয়রাশোলে। তখন অন্ডাল-সাঁইথিয়া শাখার পাঁচড়া ও ভীমগড়ের মধ্যবর্তী জায়গায় রেললাইন উড়িয়ে দিয়েছিল মাওবাদীরা। মাওবাদী নামাঙ্কিত পোস্টারও উদ্ধার হয়েছিল। ২০০৮ সালে পেশায় শিক্ষক দুই সিপিএম নেতা খুন হন। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময় খয়রাশোল, দুবরাজপুর, রাজনগরের বিভিন্ন জায়গায় মাওবাদী নামাঙ্কিত পোস্টার মিলেছে। ফের বড় নাশকতা হয় ২০১০ সালে। ওই বছর জানুয়ারি মাসে পুলিশের আরজি পার্টির দুই যুবককে গুলি করে খুন করা হয়। ওই মাসেই খয়রাশোলে মাওবাদীরা একটি বেসরকারি টেলিফোন সংস্থার টাওয়ারের বেসস্টেশন উড়িয়ে দিয়েছিল। দিন দশেক পরে খয়রাশোলেই খুন এক সিপিএম কর্মী। |
ঘটনাস্থলে পড়ে গুলির টুকরো। |
এই ব্লকেই ডিসেম্বর মাসে খুন হন সিপিএমের জোনাল সদস্য। প্রত্যেকটি ঘটনার পিছনে মাওবাদীদের যোগ ছিল বলে পুলিশ দাবি করেছে। পরবর্তীতে রাজনগর, খয়রাশোল, মহম্মদবাজার, কাঁকরতলা, সদাইপুর, রামপুরহাট, নলহাটি, মুরারইয়ে বিভিন্ন ঘটনায় মাওবাদীদের জড়িত থাকার প্রমাণ পুলিশ পেয়েছিল।
২০১১ সালে বেশ কয়েক জন মাওবাদী স্কোয়াড সদস্য ধরা পড়ে। তার পর থেকে জেলায় তেমন নাশকতার ঘটনা ঘটেনি। সেই সঙ্গে মাওবাদী নিয়ে ঢিলেঢালা মনোভাব দেখা যাচ্ছিল পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে। সীমান্ত ঘেঁয়া থানাগুলিতে বা যে সব এলাকা দিয়ে মাওবাদীরা যাতায়াত করে বলে চিহ্নিত ছিল, সেই সব গ্রামে আগে নিয়মিত এলআরপি (লঙ রেঞ্জ পেট্রোল) করত পুলিশ। সেগুলিও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গত বছরের শেষ বা এই বছরের শুরুর থকেই সেই সব অঞ্চলে আবার নতুন করে মাওবাদী গতিবিধি নজরে আসার পরেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর আবেদন করে পুলিশ। ২ কোম্পানী কেন্দ্রবাহিনী জেলা পেয়েছে। পুলিশ সুপার মুরলীধর শর্মা বলেন, “সম্প্রতি নলহাটি, রামপুরহাট, মুরারই এলাকার জন্য এক কোম্পানি এবং খয়রাশোল, রাজনগর, সদাইপুর, কাঁকরতলা, মহম্মদবাজার এলাকার জন্য আরও এক কোম্পানি বাহিনী এসেছে।” ইতিমধ্যে ওই বাহিনী এলাকায় টহলদারিও শুরু করেছে। সব ধরনের ঝামেলা মোকাবিলা করতে পুলিশ প্রস্তুত আছে বলে জানিয়েছেন জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা।
এ দিকে, তৃণমূলের জেলা চেয়ারম্যান আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “রাজ্যে মাওবাদী মোকাবিলায় সরকার যথেষ্ট সক্রিয়। নির্বাচনের আগে বা পরে এ ধরনের কোনও হামলা হবে না বলে আশা করি।” যদিও সিপিএমের জেলা সম্পাদক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায় অভিযোগ তুলেছেন, “তৃণমূল-মাওবাদী যোগসাজোসে আমাদের নেতাকর্মী খুন হয়েছেন। সুতরাং নির্বাচনের আগে বা পরে মাওবাদীরা হামলা চালাবে না তার নিশ্চয়তা নেই।” দিলীপবাবু বলেন, “সীমানা লাগোয়া এলাকায় মাওবাদীরা সক্রিয় আছে বলেই কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন হয়েছে।” এসপি বলেন, “মাওবাদী মোকাবিলায় আমাদের তরফে যা যা করণীয় সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাব।” |
ছবি: সব্যসাচী ইসলাম ও তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়। |