শুধু ‘মা-মাটি-মানুষ’ নয়। বরং ‘রোটি, কাপড়া অউর মকান’।
১৯৭৪-এ মনোজ কুমার অভিনীত-পরিচালিত বলিউড ছবিটা তাঁর দেখা আছে কি না, জানা নেই। কিন্তু ভোটের বাজারে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে লাগসই দু’চার কথা তো বলতে হবে। নইলে যে ‘পাবলিকে’র কান পচে যায়!
জেলা পরিষদের ৩০ নম্বর আসনে দাঁড়িয়ে তৃণমূল নেতা গোলাম জার্জিস তাই ফিরে গিয়েছেন বহু দিনের চেনা বচনে। রোটি, কাপড়া অউর মকান অর্থাৎ কি না দু’বেলা পেট পুরে খেতে পাওয়া, লজ্জা ঢাকার কাপড় আর মাথা গোঁজার ঠাঁই। চেনা দাবি, চেনা আশ্বাস।
গোলাম কীসে ওস্তাদ তা তাঁর অনুগামীরাই বলতে পারবেন, কিন্তু আছেন তিনি ঝালে-ঝোলে-অম্বলে। নিজেই এক নিঃশ্বাসে বলে দেন, “আমাকে আপনারা চাষাদের নেতা বলে ভাবছেন তো! আমি কিন্তু আইনে স্নাতক, অর্থনীতিতেও অনার্স ডিগ্রি রয়েছে। ডিপ্লোমা রয়েছে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে।” আইন-অর্থ-প্রযুক্তিতে যাঁর এই ‘অবাধ’ বিচরণ, তিনি এখন খালি বলে চলেছেন, ‘ভোট দিন’।
গোলাম জার্জিসের রাজনীতিতে ওঠার রাস্তাটা লম্বা। তাঁর দাবি, এক সময়ে সিপিএমের ভয়ে গ্রামছাড়া ছিলেন। সাতের দশকে খুন হওয়ার আগে (যে খুনে অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন প্রয়াত সিপিএম নেতা প্রদীপ তা) তাঁকে সিপিএমের হামলা থেকে বাঁচিয়ে যান প্রাক্তন কংগ্রেস বিধায়ক কাশীনাথ তা। এখন না কি তিনি দলের ‘সম্পদ’। বর্ধমান ২ ব্লকের জেলা পরিষদ আসনের জন্য প্রচারে বেরিয়ে বারবার বলছেন, জিততে পারলেই মানুষের একান্ত দরকারি ‘রোটি, কাপড়া অউর মকান’ ঢালাও পাইয়ে দেবেন তাঁর ভোটারদের। বড়শূলের শিল্পতালুক স্বমর্যাদায় ফিরবে। |
বাম কর্মীরা অনেকেই কিন্তু বলছেন, গোলাম সাহেবের জেতা অত সহজ হবে না। এমনিতে ভোটের আগেই কার্যত তৃণমূলের দখলে চলে গিয়েছে গোটা ব্লকের নিচুতলা। কিন্তু জেলা পরিষদে তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন ফরওয়ার্ড ব্লকের পরিচিত মুখ আত্তর আলি। কংগ্রেস এবং নকশালেরা প্রার্থী দিলেও লড়াই আসলে দ্বিমুখী। গোলাম অবশ্য প্রায় মাঠি ওড়ানোর ঢঙেই উড়িয়ে দিতে চাইছেন প্রতিদ্বন্দ্বীকে “আরে, উনি তো বর্ধমান ২ পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ ছিলেন। নিজের এলাকায় কিছুই উন্নয়ন করেননি। আমাকে হারানো অসম্ভব বলেই তো সিপিএম এই আসনে প্রার্থী দেয়নি।”
সিপিএম আবার প্রথম থেকেই লাগামছাড়া সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে আসছে। দলের বর্ধমান সদর জোনাল কমিটির সম্পাদক মহবুব আলম আগে থেকেই বলে আসছেন, “সন্ত্রাস করেই ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন জিততে চাইছে তৃণমূল। ওই ব্লকে ১১৬টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনের মধ্যে মাত্র ৪৩টিতে আমরা প্রার্থী দিতে পেরেছি। একটাও দেওয়াল লিখতে পারছি না।” সত্যি বলতে, বামফ্রন্টের প্রচার বলতে কিছুই নেই। বড়শূলে সিপিএমের এক মহিলা সমর্থক নিচু গলায় বলেন, “জার্জিসই তো এই এলাকার হার্মাদ। ওর জন্যই তো আমাদের লোকেরা প্রার্থী দিতে পারেনি।”
জার্জিস পাল্টা বলছেন, “সবাই জানে, এখানে সিপিএমই সন্ত্রাস চালিয়েছিল। ওদের অফিস থেকেই আগ্নেয়াস্ত্র-বোমা মিলেছে। মনোনয়ন পর্বে ওরাই আমাদের অফিস ভাঙচুর করে লুঠ করে। ওদের যদি প্রার্থী দেওয়ারই ছিল, মহকুমাশাসকের দফতরে গিয়ে মনোনয়ন জমা করেনি কেন? প্রার্থী না পেয়ে যত সন্ত্রাসের গল্প বলছে!”
গাড়িঘোড়া-লোকলস্কর নিয়ে প্রচারে বেরিয়ে হাসিমুখে এ দিক-ও দিক তাকাচ্ছেন জার্জিস আর হিসেব কষছেন “এই কেন্দ্রে মোট ভোটার সংখ্যা ৫২ হাজার। ৪৮ হাজারও যদি বাক্সে পড়ে, তার মধ্যে ৩২ হাজারই আমি পাব।” তত ক্ষণে তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গেরা স্লোগান তুলেছেন, ‘কৃষক নেতা গোলাম জার্জিসকে ভোট দিয়ে জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি পদে নির্বাচিত করুন।’
ভোটারেররা জেতাতে পারেন, কিন্তু একেবারে সহ-সভাধিপতি বানিয়ে দেবেন কী করে?
অস্বস্তি গিলে, ঘামে ভেজা মুখে লেগে থাকা উচ্চাকাঙ্ক্ষা পাঞ্জাবির হাতায় মুছে নিয়ে জার্জিস এ বার দ্রুত মনোজ কুমার ছেড়ে ফেরেন দিদি-কথিত তিন অক্ষরে “আমরা তো মা-মাটি-মানুষের সন্তান! মানুষ যা চাইবে তাই হবে।”
আড়াল-আবডাল থেকে মুখ বের করে বামকর্মীরা অবশ্য এখনও বলে চলেছেন, “সত্যি ভোট হলেই বোঝা যাবে, মানুষ কাকে চাইছেন। আমাদের আশা, এত দিনের সব হিসেব উল্টে দিয়ে আমরাই জিতব।”
কে না জানে, বর্ধমানের খেতে-খামারে আশাতেই বাঁচে-মরে চাষা। |