দিন দুয়েক রাস্তায় কাটিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পাহাড় বেয়ে ওঠা শুরু। দু’দিন চলার পরে দেখা মিলল সেনা জওয়ানদের। পাওয়া গেল খাবার। চোখের সামনে সেই সব স্মৃতি ভেসে উঠলেই চমকে উঠছেন নীলমনি ব্রহ্মচারী, কার্তিক প্রধান, রমেশ দে-রা। উত্তরাখণ্ড থেকে বেঁচে ফিরতে পেরেছেন, এখনও যেন নিজেরাই বিশ্বাস করতে পারছেন না কেতুগ্রামের এই তিন বাসিন্দা।
কেতুগ্রামের অট্টহাস আশ্রমে থাকেন নীলমনি ব্রহ্মচারী। অট্টহাসের পাশের গ্রাম দক্ষিণডিহির বাসিন্দা কার্তিকবাবু ও রমেশবাবু। গত ৯ জুন তাঁরা তিন জন চার ধাম দর্শনের জন্য রওনা হন। ১২ জুন পৌঁছন বদ্রীনাথ। ১৪ জুন কেদারনাথ দর্শন করেন। পর দিন রওনা হন গৌরীকুণ্ডের উদ্দেশে। নীলমনিবাবুর কথায়, “সকাল থেকে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে গৌরীকুণ্ডের দিকে রওনা দিই। ১৪ কিলোমিটার রাস্তা সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছে যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু কিছুটা যাওয়ার পরেই দেখতে পাই, জলের তোড়ে ধস নামছে পাহাড়ে। গণেশ চট্টির কাছে সেখানকার বাসিন্দারা আর এগোতে বাধা দেন।” |
কার্তিকবাবু বলেন, “রাস্তার উপরেই দু’দিন দাঁড়িয়েছিলাম আমরা। খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে অনেকের মৃত্যুও দেখছিলাম। এই অবস্থায় জায়গাটা নিরাপদ নয় ভেবে পাহাড়ের উপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করি। আমাদের সঙ্গে ছিলেন প্রায় সাতশো জন। বৃষ্টি পড়ছিল। চোখের সামনে অনেককে পা পিছলে সোজা খাদে পড়ে যেতে দেখেছি।” এই পাহাড় বেয়ে ওঠার সময়ে বাকি দুই সঙ্গীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন বছর চল্লিশের রমেশবাবু। তিনি বলেন, “ওদের দু’জনের থেকে আমার বয়স কম হওয়ায় দ্রুত পাহাড়ে চড়ছিলাম। প্রাণের দায়ে কারও কথা মনে ছিল না। দিনরাত এক করে হেঁটে জঙ্গলচট্টিতে পৌঁছই। যখন ওঁদের কথা মনে এল, ভাবলাম ওরা বোধহয় আর ফিরবে না।” রমেশবাবুর স্ত্রী মিনতীদেবী বলেন, “আমরা নীলমনিবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিলাম। তিনিই জানিয়েছিলেন, তাঁরা আমার স্বামীর খোঁজ পাচ্ছেন না। আমরাও আশা হারিয়েছিলাম।” কিন্তু তিন সহযাত্রীর মধ্যে আগে গ্রামে ফেরেন রমেশবাবুই। |
নীলমনি ব্রহ্মচারী ও রমেশ দে। |
নীলমনিবাবু জানান, পাহাড় টপকাতে তাঁদের দু’দিন সময় লেগেছিল। জঙ্গলচট্টি থেকে গৌরীকুণ্ড যাওয়ার সময়ে বহু মৃতদেহ টপকে যেতে হয়েছে, দাবি তাঁর। তিন দিন অভুক্ত থাকার পরে গৌরীকুণ্ডে সেনাবাহিনীর দেওয়া খাবার পান তাঁরা। নীলমনিবাবুর কথায়, “হেলিকপ্টারের আওয়াজ শুনে আমরা সেখানে যাই। গিয়ে দেখি, হেলিকপ্টারে যাওয়ার জন্য প্রচুর মানুষ ভিড় করেছেন। তাতে জায়গা পেতে আরও অন্তত পাঁচ দিন সময় লাগত। তাই সেনাবাহিনীর সাহায্যে আমরা ফের হাঁটাপথ ধরি।” সেনাবাহিনীই দড়ি ধরে তাঁদের নদী-পাহাড় পেরোনোর ব্যবস্থা করে দেয়। হৃষিকেষ হয়ে হরিদ্বারে পৌঁছন কার্তিকবাবুরা। পর দিন দুন এক্সপ্রেস ধরে সোমবার বাড়ি ফেরেন। কার্তিকবাবু বলেন, “রমেশের খবর কী ভাবে দেব, সে নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। গ্রামে ফিরে ও আমাদের আগেই চলে এসেছে শুনে খুব আনন্দ হয়। কিন্তু ওই ক’দিনের আতঙ্ক আর রাস্তায় পড়ে থাকা দেহগুলির কথা ভুলতে পারছি না।”
|