বৃদ্ধাবাস শব্দটার সঙ্গে এতদিনের ধারণা আর অভ্যেসে জুড়ে গিয়েছে কিছু শব্দ। যেমন, একাকীত্ব, অবহেলা, অসহায়তা। তবে এই ধারনাটাও বদলাচ্ছে। এখন অনেকেই ছেলেমেয়ের ছুটতে থাকা জীবনের সঙ্গে না দৌড়ে চাকরি শেষে নিজের মতো করে বাঁচতে চান। কাজ, সংসারের চাপে যে ইচ্ছেগুলো পূরণ করা হয়নি সেগুলো মেটাতে চান। ‘লাগে রহো মুন্না ভাই’ সিনেমাতেও এমনই এক বৃদ্ধাবাসের ছবি উঠে আসে যেখানে বাসিন্দারা একলা, গুমরে নয়, বরং নিজেদের খুশিমতো সময় কাটান, জীবনটাকে নতুন ভাবে বাঁচেন।
এ রাজ্যেও কলকাতার পাশাপাশি অন্য শহরগুলোতে এই ধরণের বৃদ্ধাবাসে থাকার চাহিদা এবং প্রবণতা দুইই বাড়ছে।
দুর্গাপুরের এ জোনের নেতাজি সুভাষ রোডের বৃদ্ধাশ্রমে যেমন ২৫ জন বাসিন্দার বেশিরভাগই এসেছেন স্বেচ্ছায়। এটি পরিচালনা করে বর্ধমান ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি ফর হিউম্যান অ্যাক্টিভিটিস (বাদশা) নামে এক সংস্থা। এখানকার এক আবাসিক গৌরী দাশগুপ্ত, শহরের একটি নামি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াতেন। স্বামী ছিলেন চিকিৎসক। এখন তাঁর ছেলেরা বাইরে থাকে। তিনিও মাঝেমধ্যে ছেলেদের বাড়ি যান, তবে থাকেন না। তাঁর মতে, যেভাবে স্বাধীনভাবে সারা জীবন কাটিয়েছেন বাকিটাও সেভাবেই কাটাতে চান। আর তাই বৃদ্ধাবাসটির পাশের বস্তির শিশুদের নিয়ে সপ্তাহে তিন দিন স্কুল চালান তিনি। তাদের দিয়ে রবীন্দ্রজয়ন্তী, সরস্বতী পুজো বা শিশু দিবসে অনুষ্ঠানও করান। তিনি বলেন, “সারা জীবন তো পড়িয়ে এলাম। এখন এরাই আমার ছাত্রছাত্রী।”
|
|
থাকার খরচ ও শর্ত |
এ জোনের বৃদ্ধাবাস
|
মাসে ৩০০০ টাকা। এর মধ্যে থাকা, খাওয়া, ডাক্তার সব।
শুরুতে ৫০০০ টাকা জমা রাখতে হয়। তবে এটা ফেরতযোগ্য নয়। |
বি জোনের বৃদ্ধাবাস |
মাসে ৩৩০০ টাকা। এর মধ্যে থাকা, খাওয়া, ডাক্তার সব। শুরুতে ২০০০০ টাকা
জমা রাখতে হয়। বৃদ্ধাবাস ছেড়ে দিলে বা মৃত্যু হলে এটি নমিনি ফেরত পাবেন। |
|
আরেক আবাসিক চিত্রা ভট্টাচার্যের বয়স এখন সত্তর। দশ মাস হল এখানে এসেছেন তিনি। দুই মেয়েই শহরের বাইরে থাকে। বাড়িতে একা লাগত। বৃদ্ধাবাসে এসে গল্প করে, বই পড়ে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে দিব্যি কাটাচ্ছেন তিনি। বললেন, “ইচ্ছে হলে মেয়েদের বাড়িতে চলে যাই। কিছুদিন পরে আবার ফিরে আসি।”
তবে সমস্যা কি নেই? আবাসিকেরাই জানান, শহরের মধ্যে সামান্য বেড়াতে যাওয়ার জন্য কোনও বন্দোবস্ত নেই এই বৃদ্ধাবাসে। তাই বেশির ভাগ সময়েই ঘরবন্দি হয়ে থাকতে বাধ্য হন তাঁরা। উৎসবেও বাইরে বেরোতে পারেন না। সংস্থার তরফে মানবেন্দ্র মণ্ডল বলেন, “ডিএসপি, এএসপি, বিধায়ক ও সাংসদদের সাহায্য নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। ওঁদের কীভাবে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছি আমরা।”
শহরের আরেক বৃদ্ধাবাসের ছবিও এরকমই। বি জোনের আইনস্টাইন অ্যাভিনিউয়ে ডিএসপির একটি কোয়ার্টারে বিবেকানন্দ ভাবসমাজ সোসাইটির উদ্যোগে ২০০৫ সালে গড়ে উঠেছিল এই বৃদ্ধাবাসটি। পরে ডিএসপি কর্তৃপক্ষ আরও ২৬টি ঘর দেন তাঁদের। সেই বৃদ্ধাবাসের সামনে এখন বাহারি ফুল গাছের বাগান। পাশেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য রয়েছে একটি মঞ্চ। পাঁচ বছর ধরে এখানে আছেন বছর চুরাশির প্রতীতি রায়। দুই ছেলে শহরের বাইরে থাকেন। প্রতীতিদেবী বলেন, “খুব ভাল আছি। এটাই এখন আমার ঘর। ছেলেদের কাছে গেলেও এখানকার জন্য মন কেমন করে।”
বাড়ি বিক্রি করে বৃদ্ধাশ্রমে চলে আসছেন প্রবীণেরা, এমন দৃষ্টান্তও কম নয়। যেমন, বিজ্ঞানী (সেন্ট্রাল মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী, রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত) বিকাশরঞ্জন গুহ ও তাঁর স্ত্রী দেবী গুহ বিধাননগরে নিজেদের বাড়ি বিক্রি করে মাস তিনেক আগে চলে এসেছেন এখানে। ছেলে-মেয়ে থাকেন মুম্বইয়ে। তারা বলেন, “বাড়িটা ফাঁকা লাগত। এখানে একটা পরিবার পেয়েছি। মনে হয়, আগে কেন আসিনি!” ডিএসপি-র হাসপাতালের প্রাক্তন নার্স অর্চনা রায়ও অবসর নেওয়ার পরে ফ্ল্যাট বিক্রি করে চলে এসেছেন এখানে। সংস্থার তরফে দীপ্তি সান্যাল বলেন, “শেষ বয়সে আজকাল অনেকেই বৃদ্ধাবাসে কাটাতে চাইছেন। আমরা জায়গা দিতে পারছি না। আমরা সবাই এক পরিবারের সদস্য। আমিও এখন বাড়ি ছেড়ে এখানে থাকি।” আবাসিক অশ্রুকণা চট্টোপাধ্যায়, চিত্রা মুখোপাধ্যায়, গৌরী অধিকারী, চিত্রা মুখোপাধ্যায়, মলয় ভট্টাচার্যেরা জানান, সম্প্রতি একটি নাটকের দল তৈরি করেছেন তাঁরা। কাঁকসায় নাটক করতেও যাচ্ছে তাঁদের দল। বিভা মণ্ডল, রেনুকা তালুকদারদের কথায়, “ছেলেবেলার যৌথ পরিবারের সুখ আবার নতুন করে খুঁজে পেয়েছি।” |