ডান দিকে হৃৎপিণ্ড
জটিল অস্ত্রোপচার, পেসমেকার বসল বুকের বাঁ দিকে
জারুর একটা কাঁটা বিঁধেছিল বুকের বাঁ দিকে। লক্ষ্য ছিল হৃৎপিণ্ড। কিন্তু বরাতজোরে বেঁচে যান দেবাশিস ভট্ট। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শজারুর কাঁটা’ উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র। যিনি জানতেন, আর পাঁচ জনের মতো তাঁর হৃৎপিণ্ড বুকের বাঁ দিকে নয়, রয়েছে ডান দিকে। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে ‘ডেক্সট্রোকার্ডিয়া।’ সেই সূত্র ধরেই রহস্যভেদ করেন ব্যোমকেশ বক্সী। বার্ধক্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে প্রায় একই রকম অভিজ্ঞতা হল ডানকুনির কৃষ্ণপুরের হীরেমন বিবির। তবে শজারুর কাঁটা নয়, তাঁর বুকে অবশ্য বসল পেসমেকার।
হীরেমন বিবি।
নিজস্ব চিত্র।
হৃৎপিণ্ড যে ডান দিকে রয়েছে, ৭৫ বছর বয়সী হীরেমন বিবি তা জেনেছেন মাত্র কয়েক বছর আগে। তেমন কোনও অসুবিধা ছিল না। কিন্তু আচমকা শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। হৃৎপিণ্ডে ‘ব্লক’ ধরা পড়ে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সপ্তাহখানেক আগে তাঁর সেই ডান দিকে থাকা হৃৎপিণ্ডে পেসমেকার বসেছে।
এমন ঘটনা একেবারে বিরল নয়। তবে এমন রোগীর বুকে পেসমেকার বসানো বেশ জটিল বলে মনে করেন ডাক্তাররা। তাঁদের মতে, উল্টোদিকে হৃৎপিণ্ড থাকায় অনেক সময় দেহের বিভিন্ন অঙ্গের অবস্থানও বদলে যায়। যেমন হীরেমন বিবির ক্ষেত্রে হয়েছে। তাঁর বুকের ডান দিকে হৃৎপিণ্ড থাকার পাশাপাশি যকৃৎও রয়েছে বাঁ-দিক ঘেঁষে, প্লিহা আবার বাঁ-দিকের বদলে ডান দিকে, পাকস্থলীও বাঁ-দিকের পরিবর্তে ডান দিক ঘেঁষে। অ্যাপেনডিক্সও ডান দিকের বদলে বাঁ-দিকে। এঁদের ‘ইসিজি-গ্রাফ’, এক্স-রে-এর ছবি অন্য রকম হয়। এই ধরনের রোগীর শরীরে পেসমেকার বসানোর অভিজ্ঞতাও চিকিৎসকদের কম। তাই অস্ত্রোপচার করাও কঠিন হয়।
বিশ্বে প্রতি ১০ হাজার মানুষের মধ্যে এক জনের দেহে ডান দিকে হৃৎপিণ্ড দেখা যায়। ২০১১ সালে তামিলনাড়ুর তিরুচিরাপল্লির কাবেরী মেডিক্যাল সেন্টার হাসপাতালে ডান দিকে হৃৎপিণ্ড থাকা ৮১ বছরের এক বৃদ্ধার পেসমেকার বসিয়েছিলেন চিকিৎসক এন সেন্থিল কুমার। তিনি লিখেছেন, ডেক্সট্রোকার্ডিয়া দু’রকমের হয়। একটিতে রোগীর হৃৎপিণ্ডের মতো শরীরে নানা অঙ্গ উল্টো দিকে থাকে। একে বলা হয় ‘মিরর ইমেজ ডেক্সট্রোকার্ডিয়া’। হীরেমন বিবির এই ধরনের ডেক্সট্রোকার্ডিয়াই রয়েছে। এ ছাড়া ‘আইসোলেটেড ডেক্সট্রোকার্ডিয়া’-ও হয়। সে ক্ষেত্রে শুধু হৃৎপিণ্ডটাই ডান দিকে থাকে। শরীরের বাকি সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঠিকঠাক অবস্থানে থাকে।
হীরেমন বিবির অস্ত্রোপচার হয়েছে কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে। যিনি করেছেন সেই হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ শুভ্র মুখোপাধ্যায় জানান, ডেক্সট্রোকার্ডিয়াকদের হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে যুক্ত শিরা-ধমনীগুলির অবস্থান অধিকাংশ ক্ষেত্রে এলোমেলো হয়, অথবা কুঁচকে থাকে। তাঁর কথায়, “ওই বৃদ্ধার হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে যুক্ত শিরা-ধমনীগুলির মধ্যে একাধিক বড় বাঁক ছিল। ফলে পেসমেকারের তার ঠিকমতো নিয়ে যাওয়াটাই বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তাঁর পেসমেকার বসানো হয়েছে বুকের বাঁ-দিকে।” খরচ হয়েছে প্রায় ১ লক্ষ টাকা। এখন স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারছেন হীরেমন বিবি দাবি ওই ডাক্তারের।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ডেক্সট্রোকার্ডিয়াকদের দেহে পেসমেকার বসানোর উদাহরণ খুব বেশি নেই। ১৯৯৯ সালে ইতালির বারি শহরে ‘ইনস্টিটিউট অফ কার্ডিয়াক সার্জারি’-র দু’জন চিকিৎসক ৭১ বছরের এক বৃদ্ধার দেহে পেসমেকার বসান। তাঁরও হৃৎপিণ্ড বুকের ডান দিকে ছিল। অস্ত্রোপচারের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ওই দুই চিকিৎসক লিখেছিলেন ‘এই ধরনের অস্ত্রোপচার করার আগে অ্যাঞ্জিওগ্রাফি করা বাধ্যতামূলক। আবার রোগী একটু সুস্থ হলে তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছাড়ার আগে ভাল ভাবে ‘বাই-ডাইমেনশিয়াল ইকোকার্ডিওগ্রাফি’ করতে হয়।
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অরুণাংশু গঙ্গোপাধ্যায় জানালেন, তিনি তাঁর ১৫ বছরের ডাক্তারি জীবনে দু’জন ‘আইসোলেটেড ডেক্সট্রোকার্ডিয়াক’ রোগীর দেহে পেসমেকার বসিয়েছেন। তাঁর কথায়, “এই ধরনের কেস খুব কম পাওয়া যায়। শুধু হৃৎপিণ্ড যাঁদের অন্য দিকে থাকে, তাঁদের হৃৎপিণ্ডজনিত একাধিক সমস্যা থাকতে পারে। তুলনায় ‘মিরর ইমেজ ডেক্সট্রোকার্ডিয়াক’দের সমস্যা অনেক কম।” কার্ডিওথোরাসিক সার্জেন সত্যজিৎ বসু আবার জানালেন, তিনি ২০ বছরের ডাক্তারি জীবনে দু’জন ‘মিরর ইমেজ ডেক্সট্রোকার্ডিয়াক’ রোগীর বাইপাস করেছেন। তাঁর অভিজ্ঞতায়, “আমাদের বুকের পিছনে দু’টি ধমনী থাকে। একটার নাম ‘রিমা’, অন্যটি হল ‘লিমা’। স্বাভাবিক রোগীর বাইপাসের সময় আমরা লিমার সঙ্গে রিমাকে জুড়ে ‘y’ এর আকার দিই। ডেক্সট্রোকার্ডিয়াকদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো। তখন রিমার সঙ্গে লিমাকে জুড়ে ‘y’ আকার দিতে হয়।”
কলকাতার হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ ভবতোষ বিশ্বাসের কথায়, “এমবিবিএস-এর পাঠ্যক্রমে ডেক্সট্রোকার্ডিয়া নিয়ে তেমন কিছু বলা নেই। ফলে এই নিয়ে ছাত্রছাত্রীদেরও স্বচ্ছ ধারণা নেই। তবে এমডি, ডিএম স্তরের পাঠ্যক্রমে ডেক্সট্রোকার্ডিয়া পড়ানো হয়। কিন্তু এমন রোগী বিরল বলে বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীর বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকে না। তাই পরে অস্ত্রোপচার করতে হলে সমস্যায় পড়েন চিকিৎসকেরা।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.