আগের দিন ছিলেন সমরাদিত্য পাল এবং মীনাক্ষি অরোরা। আজ মীনাক্ষির সঙ্গে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের হয়ে সওয়াল করতে ডাকা হয়েছিল দেশের অন্যতম প্রবীণ আইনজীবী ফলি নরিম্যানকে। কিন্তু তাঁকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে হলো মাত্র এক বার। তা-ও শীর্ষ আদালত পঞ্চায়েত ভোটের নির্ঘণ্ট অপরিবর্তিত রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে দেওয়ার পরে।
বস্তুত, আজ বিচারপতি এ কে পট্টনায়ক এবং বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের ডিভিশন বেঞ্চে এমনই হেলায় পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে শেষ আইনি যুদ্ধ জিতে নিল রাজ্য নির্বাচন কমিশন। এবং আরও এক বার মুখ পুড়ল রাজ্য সরকারের। তাদের কার্যত ভর্ৎসনা করে শীর্ষ আদালত বলল, ভোট চাইলে রাজ্য আগেই নিজস্ব বাহিনীর ব্যবস্থা করতে পারত। হাইকোর্টে এত দিন ধরে গড়িমসি করত না। কালবিলম্ব না-করে ১১ জুলাই থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত পাঁচ দফায় পঞ্চায়েত ভোটের জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি করার নির্দেশও রাজ্যকে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। |
সেই নির্দেশ মেনে আজ সন্ধ্যাতেই মহাকরণ থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি করে দেওয়া হয়। রাজ্য প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দিল্লিতে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়ও সুপ্রিম কোর্ট থেকে সরাসরি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে চলে যান। কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন নিয়ে তাঁদের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের যুগ্মসচিব (পুলিশ) নির্মলজিৎ সিংহ কলসির বৈঠক হয়। ঠিক হয়, ১১ তারিখ প্রথম দফায় জঙ্গলমহলের তিন জেলায় ভোটগ্রহণের তিন দিন আগে থেকেই বাহিনী মোতায়েন করা হবে। অর্থাৎ ৮ জুলাই থেকেই রাজ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী পৌঁছতে শুরু করবে। সব মিলিয়ে এত দিনে পঞ্চায়েত ভোটের বল বাধাহীন ভাবে গড়াতে শুরু করল বলেই মনে করা হচ্ছে।
২৮ তারিখ সুপ্রিম কোর্টের প্রথম রায়ের দিনে দিল্লি ছুটে এসেছিলেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে। আগাগোড়া নজর রেখেছিলেন সওয়াল-জবাবে। আজও তিনি বসেছিলেন কমিশনের আইনজীবীদের সঙ্গে। আদালত রায় দেওয়ার পরে তৃপ্ত মুখে চুমুক দিলেন চায়ের কাপে।
আর পাঁচ দিনের মধ্যে পরপর দু’বার সুপ্রিম কোর্টে ধাক্কা খেয়ে মুখ্যমন্ত্রী উষ্মা গোপন করেননি বলেই তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে খবর। মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র এবং রাজ্য সরকারের হয়ে সওয়াল করা আইনজীবী তথা তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর রীতিমতো অসন্তুষ্ট তিনি। এঁরাই তাঁকে ভুল পথে চালিত করেছেন বলে ঘনিষ্ঠ মহলে অভিযোগ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের উপরে অবশ্য মমতার ক্ষোভ বর্ষায়নি। যদিও প্রশাসনের একটি অংশের মত, এই মামলার বিষয়টি মূলত দেখভাল করছিলেন চন্দ্রিমাই। তা ছাড়া, আইনমন্ত্রী হিসেবে এই বিপর্যয়ের দায় পুরোপুরি এড়াতেও পারেন না তিনি। তবে সঞ্জয়বাবু এবং কল্যাণবাবুর উপরে ক্ষুব্ধ হলেও তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ভাবনা এখনই মুখ্যমন্ত্রীর মাথায় নেই। তার বদলে সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকারের আইনজীবী অভিজিৎ ভট্টাচার্যের উপরে কোপ পড়তে পারে বলে সরকারি সূত্রে খবর।
প্রকাশ্যে অবশ্য রাজ্য সরকারের সুপ্রিম কোর্টে যাওয়াটাকে তাদের রাজনৈতিক ফায়দা বলেই দাবি করছে তৃণমূল। তাদের মতে, রমজান-প্রশ্নে আদালতের দ্বারস্থ হয়ে সংখ্যালঘু মানুষদের প্রয়োজনীয় বার্তা দেওয়া গিয়েছে। ভোটের প্রচারে দলীয় নেতৃত্ব এখন বলতে পারবেন যে, তাঁরা রমজানের সময় নির্বাচন এড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আদালতের নির্দেশ মানতে হচ্ছে। তৃণমূল নেত্রী নিজেও আজ বলেছেন, “ভাল রায় হয়েছে। আমরা সব ধর্ম-বর্ণ মেনে চলি। সংবিধান মেনে চলি। আমাদের বক্তব্য আমরা আদালতে নথিভুক্ত করিয়েছি।” রাজ্যের জনসংখ্যার প্রায় ২৮% মুসলিম, যাঁদের এক বড় অংশই পঞ্চায়েতের ভোটার। রমজান-প্রশ্নে সরব হওয়ায় এই অংশের মন পাওয়া যাবে বলে তৃণমূল নেতৃত্বের আশা। যে কারণে তৃণমূল নেত্রী ‘বক্তব্য নথিভুক্ত’ করানোর প্রসঙ্গ এনেছেন।
বিরোধীরা অবশ্য এই যুক্তি মানতে নারাজ। রমজান মাসে ভোট হওয়ার জন্য রাজ্য সরকারকেই দুষছে তারা। রাজ্য সরকার ‘বালখিল্যসুলভ’ আচরণ করেছে বলে মন্তব্য করে সিপিএম সাধারণ সম্পাদক বিমান বসু বলেন, “তৃণমূল সরকার যেনতেন প্রকারে এই ভোট বানচালের চেষ্টা করেছিল। এখন বর্ষা ও রমজানের মধ্যে ভোটের জন্য ওরাই দায়ী। সরকার যদি হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চের রায় মেনে নিত, তা হলে এত দিনে ভোট শেষ হয়ে যেত!” সিপিএম পলিটব্যুরোর সদস্য নিরুপম সেনেরও অভিযোগ, “কমিশন এক বছর আগেই ভোট করতে চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিল। রাজ্য সরকার সে সুপারিশ মানেনি। তাই আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে কমিশনকে। রাজ্যের ঢিলেমির জন্যই এই ভরা বর্ষায় এবং রমজান মাসে ভোট হচ্ছে।” আর প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “মানুষ এত বোকা নন! ভোটে হারার ভয় থেকেই তৃণমূল যে নির্বাচন পিছিয়ে এনে সংখ্যালঘু সমাজকে চরম অসুবিধার মধ্যে ফেলে দিয়েছে, তা মানুষ বুঝতে পারছেন।”
আদালতে একের পর এক ধাক্কা খেয়ে রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি যে খানিকটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা মানছেন তৃণমূল নেতারাও। নতুন সরকারের আমলে ধনেখালি থেকে পঞ্চায়েত, একের পর এক মামলায় রাজ্যের আর্জি খারিজ হয়েছে। এই অবস্থায় সুপ্রিম কোর্টে ফের আবেদন করার আগে কেন সব দিক খতিয়ে দেখা হয়নি, তা নিয়ে ঘনিষ্ঠ মহলে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তৃণমূলের এক নেতার কথায়, “সব দিক খতিয়ে না-দেখে ফের আবেদন করায় আখেরে রাজ্য প্রশাসন তথা তৃণমূলের মুখ পুড়েছে। আসলে মুখ্যমন্ত্রীকে যাঁরা ফের আবেদন করার পরামর্শ দেন, তাঁরাই ডুবিয়েছেন।”
কিন্তু অন্য সকলকে বাদ দিয়ে শুধু অভিজিৎবাবু মুখ্যমন্ত্রীর কোপের শিকার হতে পারেন, এমন সম্ভাবনায় বিস্মিত দল ও সরকারের অনেকে। অভিজিৎবাবুর নিজের কথায়, “আমার তো কিছু করার নেই। আমার কাছে যে আইনজীবী চাওয়া হয়েছে, তার ব্যবস্থা করেছি। তা ছাড়া রাজ্যের আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রসচিব, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অনেকেই ছিলেন। আমার দায় কোথায়!” তাঁর কথায়, “আমাকে কাজ দিলে করব। না দিলে করব না।” অন্য দিকে মুখ্যসচিবকে দায়ী করা প্রসঙ্গে প্রশাসনের একটি অংশের মত, “কোনও কারণে সরকারের মুখ পুড়লে আমলাদের উপর দায় চাপিয়ে দেওয়াটাই বাম-অবাম সব আমলেই রাজনৈতিক নেতাদের অভ্যাস। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।” |