ভোট আসে, ভোট যায়, আতঙ্ক ফুরোয় না ডোমকলে। নির্বাচনের দিন ক্ষণ ঘোষণার সঙ্গে আতঙ্কও জড়িয়ে গিয়েছে সীমান্তের গ্রামগুলিতে।
ভোট মানেই বারুদের গন্ধ। রাস্তায় আচম্বিতে পড়ে যাওয়া লাশ। পুলিশেও এ ভাবেই চেনে ডোমকলকে। স্থানীয় আম জনতার সঙ্গে প্রসাসনেরও তাই কপালে আশঙ্কার ভ্রূ-কুঞ্চন। সেই চেনা আতঙ্কে বুক বাঁধতেই এ বার তাই অন্যরকম ভোট চায় ডোমকল। একটু শান্তি, গুলিছোরা-ছুরির বদলে নির্বিঘ্ন একটা দিন।
আর তা মনেপ্রাণে চান বলেই এ বার তাই উঠে পড়ে লেগেছেন স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই। গ্রামে শান্তি বজায় রাখতে তাই ‘শান্তি কমিটি’ গড়েছেন তাঁরা। স্থানীয় বাসিন্দারা অনেকেই জানান, দীর্ঘদিনের ওই আতঙ্কে গ্রামবাসীদের ‘দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে।’
গরিবপুর তেমনই এক পিঠ ঠেকে যাওয়া গ্রাম। আটপৌরে যে গ্রামের বাসিন্দাদের নির্বাচনের কথা শুনলেই রোম খাড়া হয়ে ওঠে, ভয়ে উত্তেজনায়। দিন কয়েক ধরে তাই সন্ত্রাসহীন ভোটের খোঁজে একটা পথ খুঁছিল ওই গ্রাম। সম্প্রতি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের এক চিলতে মাঠে তিন রাজনৈতিক শক্তি কংগ্রেস, সিপিএম ও তৃণমূল নেতা-কর্মীরা জড়ো হয়ে গ্রামে শান্তি ফেরানোর শপথ নিয়েছেন। গড়েছেন শান্তি কমিটি। ওই সভায় গ্রামবাসীরা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন প্রশাসনের কর্তাদেরও। উপস্থিত ছিলেন ডোমকলের বিডিও রবীন্দ্রনাথ মিশ্র ও স্থানীয় থানার আইসি অরিজিত্ দাশগুপ্ত। প্রশাসনের তরফেও গ্রামবাসীদের সব সাহায্যের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
গত গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনে ১৪ জন মারা গিয়েছিলেন ডোমকলের আনাচে কানাচে। গরিবপুরে বোমা বাঁধতে গিয়ে মা রা গিয়েছিলেন ৩ জন। নির্বাচনের দিনেও খুন হয় এক কিশোর। জখম হয়েছিল বেশ কয়েক জন। গ্রামের বাসিন্দা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র আলমাস হোসেন মোল্লা বলেন, “অন্য সময় গ্রামের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলে। আড্ডা দেয় চায়ের দোকানের এক মাচায় বসে। কিন্তু ভোট এলেই ছবিটা বদলে যায়। বন্ধু হয়ে যায় শত্রু, সামনা সামনি হয়েও কথা হয় না পাশের বাড়ির মানুষটার সঙ্গে। এমনকী কথায় কথায় শুরু হয়ে যায় গণ্ডগোল। আর তা থেকে থানা পুলিশ আর কোর্টে দৌড়াদৌড়ি। এই গ্রামের এমনও মানুষ আছে যার নামে ১০টা মামলা ঝুলছে। মামলা নেই এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া মুশকিল।”
মামলার কথা উঠতেই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পেশায় ছুতোর মিস্ত্রি রবিউল ইসলাম এক গাল হেসে বললেন, কী আর বলব বলুন! ভোটের সময় মুরগি তো দূরের কথা, মুরগির ডিম নিয়েও থানায় দৌড়াদৌড়ি চলে। নেতাদের উস্কানিতে পান থেকে চুন খসলেই হল। এ ভাবে সামাজিক অবস্থার পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষতিও হয়েছে গ্রামের। বলতে পারেন, আমাদের এখন প্রায় দেওয়ালে পিঠ ঠেকার জোগাড়।” ওই দিনের সভায় ছিলেন গ্রামের কংগ্রেস নেতা তাহাজুদ্দিন মণ্ডল, সিপিএম নেতা আয়ুব আলি ও তৃণমূল নেতা নাজিমুদ্দিন গাঁধী। তাহাজুদ্দিনের কথায়, “ভৈরবের পাড়ের শান্ত গ্রামটি নির্বাচন এলেই বদলে যায়। আমরা বারবার চেষ্টা করেও ওই অবস্থার বদল করতে পারিনি। কিছু অসামাজিক মানুষ ওই পরিস্থিতি তৈরি করে। এ বার আমরা সকলে মিলে ওই পরিস্থিতির মোকাবিলা করব ঠিক করেছি।” একই বক্তব্য সিপিএম ও তৃণমূলের। তাদের কথায় : আর নয়, যা হওয়ার হয়েছে। এ বার ঘুরে দাঁড়াবার পালা।
শান্তি কমিটি অবশ্য নতুন নয়। এর আগেও ডোমকলে শান্তি কমিটি হয়েছে। কখনও রাজনৈতিক দল বা প্রশাসনের উদ্যোগে। তবে সেই কমিটি শেষ রক্ষা করতে পারেনি ডোমকলকে। ডোমকলের বিডিও রবীন্দ্রনাথ মিশ্র বলেন, “এই প্রথম গ্রামের মানুষ শান্তির জন্য আমাদের ডাকলেন। আমার মনে হয় এ বার নিজেদের ভালটা নিজেরাই বুঝতে পেরেছেন। আমরা গ্রামের মানুষকে সবরকমের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেব।” পুলিশের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে গ্রামবাসীদের। পুরনো মামলা নিয়ে পুলিশি হয়রানি না হওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। এখন দেখার, নির্বাচনের সকালে পুরনো চেহারায় ডোমকল ফেরে কি না। |