এক আঁটি মুলো কিনে মোটরবাইকে চেপে বাড়ি ফিরছিলেন মইদুল ইসলাম। হঠাৎ তাঁকে থামালেন তিন পুলিশ অফিসার। জানতে চাইলেন নাম-ধাম-পরিচয়। মইদুল তাঁদের বললেন, ‘‘ওই তো আমার বাড়ি।’’ কিন্তু ছাড় মিলল না। রীতিমতো তল্লাশি চালানোর পরে মোটরবাইক ও মোবাইল নম্বর খাতায় টুকে তবে যেতে দেওয়া হল মইদুলকে।
কাঁধে একটি ঝোলা নিয়ে গ্রামে ঢুকছিলেন সনাতন মণ্ডল। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়ে জানালেন, তিনি গ্রামের বাসিন্দা নন। একটি কাজে এসেছেন। তাঁকে সটান ফেরত পাঠালেন পুলিশকর্মীরা।
কাশ্মীর নয়, জায়গাটার নাম কামদুনি।
কাশ্মীরে প্রতিনিয়ত যে ভাবে জঙ্গিদের খোঁজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে তল্লাশি চালায় পুলিশ ও সেনাবাহিনী, কার্যত সে ভাবেই এখন কামদুনি ঘিরে রেখেছেন পুলিশ ও জলপাই-ছাপ পোশাক পরা ইন্ডিয়ান রিজার্ভ ব্যাটেলিয়নের জওয়ানেরা। রয়েছেন সাদা পোশাকের গোয়েন্দারাও। গ্রামের সবাই তাঁদের সন্দেহের তালিকায়। |
সোমবার এলাকায় গিয়েই নজরে এল, অন্তত ১০টি জায়গায় পুলিশি নজরদারি রয়েছে। তাঁদের পাশ কাটিয়ে থমথমে মুখে বাড়ি ফিরছে স্কুলের কচি-কাঁচারা। মাঝেমধ্যেই প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের। রেহাই পাচ্ছেন না ঘোমটা টানা মেয়ে-বউরাও। ঘোমটা সরিয়ে মুখ দেখিয়ে তবেই যাতায়াতের অনুমতি মিলছে।
এ দিন বিকেলে মোটরবাইকে চেপে বউকে নিয়ে কামদুনিতে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিলেন সইফুল মোল্লা। আবার কামদুনির দিক থেকে মোটরবাইকে চেপে সস্ত্রীক বাজারে যাচ্ছিলেন জগদীশ কয়াল। দু’টি গাড়িই থামাল পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের পর যখন ছাড়পত্র মিলল, তত ক্ষণে দুই মহিলারই চোখমুখ ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছে।
গোটা কামদুনিই এখন পুলিশি ঘেরাটোপে। রাজারহাট-খড়িবাড়ি রোড ধরে কামদুনি মোড়ে পৌঁছলেই দেখা যাবে, পাঁচিল ঘেরা সেই কারখানাতে (যেখানে ওই কলেজছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল) পুলিশি পাহারা বসেছে। মোড়ের মাথাতেও রয়েছে পুলিশি পিকেট। পুলিশের একাংশ বলছে, ফরেন্সিক প্রমাণ যাতে নষ্ট না হয়, সেই কারণেই বসানো হয়েছে পাহারা।
কিন্তু কারখানা চত্বর-সহ গোটা কামদুনি সশস্ত্র পুলিশ দিয়ে মুড়ে ফেলা হল কেন? উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের এক কর্তার দাবি, ছাত্রী ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার ৫৪ জন সাক্ষী-সহ এলাকার মানুষের নিরাপত্তার কারণেই এই ব্যবস্থা। যদিও এলাকাবাসীর অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী ‘মাওবাদী’ খুঁজে পাওয়ার পর থেকেই ক্রমশ বাড়ছে পুলিশি নজরদারি। সব থেকে বেশি নজরদারি কয়ালপাড়ার মুখে। যেখান থেকে দানা বেঁধেছে টুম্পা, মৌসুমি-সহ কামদুনিবাসীর প্রতিবাদ-আন্দোলন।
কামদুনির বাসিন্দারা দাবি করছেন, এলাকায় বিক্ষোভ-আন্দোলন যত বাড়ছে, ততই পুলিশ দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বাইরে থেকে আন্দোলনে যোগ দিতে আসা মানুষজনকে। এ দিনও যেমন আটকানো হয়েছে সনাতন মণ্ডলকে। তিনি মছলন্দপুরের বাসিন্দা। এসেছিলেন নিহত ছাত্রীর পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে। পুলিশি বাধায় ফিরে যাওয়ার আগে বললেন, “প্রতিদিনই ভাবি, কামদুনির ওই পরিবারের পাশে গিয়ে বলব, আমি আপনাদের সঙ্গে আছি। তাই এসেছিলাম। কিন্তু পুলিশ গ্রামে ঢুকতেই দিল না।”
নিহত ছাত্রীর দাদা এ দিন বলেন, ‘‘আমাদের নিরাপত্তা দেওয়ার নাম করে আসলে ওঁরা পুলিশ দিয়ে আমাদের আন্দোলনকে বানচাল করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু দোষীদের শাস্তি না হলে আমরা আন্দোলনে নামবই। পুলিশ দিয়ে আমাদের দমিয়ে রাখা যাবে না।”
|