ভি ফর ভিনিগার’-ই আজকের ব্রাজিলে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে মহাত্মা গাঁধী ও গাই ফকসকে। হাজার হাজার মানুষের হাতে গাঁধীজির ছবি, মুখে গাই ফক্সের মুখোশ। সেই গাই ফকস, চারশো বছরেরও বেশি সময় ধরে, যাঁর নামে প্রতি ৫ নভেম্বরের রাত্রি উদ্যাপিত হয়ে আসছে বিলেত জুড়ে। ‘গাই ফকস নাইট’। ‘গানপাউডার প্লট’-এর অন্যতম চক্রী। ১৬০৫ সালে রাজা প্রথম জেমসকে হত্যা ও ব্রিটেনের পার্লামেন্ট হাউস উড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করে ক্যাথলিকদের একটি দল। বারুদের বিপুল মজুত দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন দলের অন্যতম সদস্য গাই ফকস। কিন্তু ৫ নভেম্বর তিনি ধরা পড়ে যান। মৃত্যুদণ্ড হয় তাঁর। ফক্সের চক্রান্ত ব্যর্থ হয়েছিল, ফক্সের গ্রেফতারি বচ্ছরকার উদ্যাপন— তবু তামাম বিশ্বে মিথ হয়ে বেঁচে রয়েছেন গাই ফকস। তাঁর মুখের আদল সহজ মুখোশে বদলে নিয়েছে মানুষ— সেজেছে সরু গোঁফ আর ছুঁচলো দাড়িতে। সে মুখে অম্লান হাসি। যে হাসি স্পর্ধার। অ্যানার্কির মধ্যে যে কেমিক্যাল ভায়োলেন্স আছে, তা ফুটে ওঠে এই হাসিতে। মুখের ছাঁদে কোথাও যেন এসে পড়ে রবিন হুডের অনুষঙ্গও। মুখের উপর মুখোশ মানেই সব মানুষের এক হয়ে যাওয়া, এই মুখোশ সেই সাম্যের সঙ্গে জুড়ে নেয় প্রতিরোধের আগুন, প্রতিবাদের ভাষা। |
গাই ফক্সের মুখোশ আগেও বহুবার দেখেছে বিশ্ব। গত বছরই পোল্যান্ডের পার্লামেন্টে দেখা গিয়েছিল গাই ফক্সের মুখোশ পরা একঝাঁক সদস্যকে। তাঁরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ইন্টারনেট সেন্সারশিপ বিষয়ক অ্যান্টি-কাউন্টারফেইটিং ট্রেড এগ্রিমেন্ট বা অ্যাক্টা-র। ‘হ্যাকিং’ ও ‘অ্যাক্টিভিজম’-এর জোড়কলম ‘হ্যাকটিভিজম’-এ যাঁরা বিশ্বাসী, তাঁদের আন্তর্জাতিক সংগঠন অ্যানোনিমাস-এর লোগোও হয়ে উঠেছে গাই ফক্সের মুখোশ। ভারত সরকারও যখন টরেন্ট, ফেসবুক বা টুইটারের উপর থাবা বসাতে চাইছিল, আঘাত করতে চাইছিল দেশবাসীর ই-স্বাধীনতায়, তখনও মুম্বই বা বেঙ্গালুরুতে বিক্ষোভ-জমায়েতে প্রতিবাদীদের মুখে উঠে এসেছিল স্লোগান। সঙ্গে এই মুখোশ। আঁকা হয়েছিল এমন ছবিও— স্বয়ং মহাত্মা গাঁধী মুখে পরে নিচ্ছেন অ্যানোনিমাস-এর লোগো, গাই ফক্সের মুখোশ। আজ আবার ব্রাজিলের রাস্তায় একসঙ্গে দেখা গেল গাঁধী ও ফকসকে।
বছর দুই আগে, অণ্ণা হাজারে যখন রামলীলা ময়দানে অনশনে, তখন এক আশ্চর্য ছবি দেখা গিয়েছিল রিও-র কোপাকাবানা বিচে। শামিল হয়েছিলেন একদল ব্রাজিলীয়; মাথায় ছিল গাঁধী-টুপি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভারতবাসীর লড়াইয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা। সালভাদোরের রংচঙে কার্নিভালেও পথে নামতে দেখা যায় একদল মানুষকে, যাঁদের পরনে থাকা সাদা পোশাক। নিজেদের তাঁরা বলেন— ‘ফিলহোদ দে গাঁধী’, অর্থাৎ গাঁধীর সন্তান। গাঁধীর সঙ্গে ব্রাজিলের সম্পর্কের আরও একটি উদাহরণ নারীবাদী লেখিকা মারিয়া লাসেরদা দে মউরা। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে গাঁধীর প্রসঙ্গ। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্রাজিলের আমজনতা আবার হাতিয়ার করে নিলেন মহাত্মাকে।
তা হলে কি কোথাও একটা মিলছে না? একটা দ্বিচারিতার মধ্যে দিয়ে পথ হাঁটছে ভি ফর ভিনিগার মুভমেন্ট? আপাতভাবে দেখলে দ্বিচারিতা রয়েছে বটেই। ব্রাজিলবাসীর এই আন্দোলন কোথাও শান্তিপূর্ণ অবস্থান— সেখানে গান, বাজনা, সাম্বা। আবার কোথাও ভয়াবহ হিংসাত্মক চেহারা তার। চলছে অবাধ ভাঙচুর, লুঠপাট। মনে হবে, একই মুদ্রার এক পিঠে হিংসা, অন্য পিঠে অহিংসা।
আসলে শুধু ড্রিবল আর মাপা পাসের সৌন্দর্য দিয়েই ম্যাচ জিততে চায় না ব্রাজিল, কড়া ট্যাকলও চায়। ফেয়ার প্লে নয়, চ্যাম্পিয়নের ট্রফির দিকেই তাদের নজর। প্রেসিডেন্ট দিল মা রউসেফের যাবতীয় ঢোঁকগেলা প্রতিশ্রুতিকে উড়িয়ে দিয়ে আজ এতদিন পর তারা নানা ভাবে যেটা বলতে চাইছে— হ্যাঁ, সেটা আমাদেরও খুব চেনা স্লোগান— মানছি না, মানব না। |