প্রবন্ধ ১...
এ কেবল পার্ক বাঁচানোর আন্দোলন নয়

ছবি-১
একটি পার্কের নিচু রেলিংয়ের বাইরে ফুটপাথের ওপর লাঠি-ঢাল-বর্ম পরিহিত সার-বাঁধা পুলিশের দল আর রেলিংয়ের ভিতরে পার্কের বাঁশের ওপর বসা জনা দশ-বারো নারী-পুরুষ। হাতে বই। পুলিশের দিকে পিছন ফিরে তাঁরা মন দিয়ে বই পড়ছেন। শুধু এক জন পুলিশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নাটকের লাইন আওড়াচ্ছেন। ছবিটি তুরস্কের ইস্তানবুল শহরের কেন্দ্রবিন্দু তাকসিম স্কোয়ারের (কলকাতার ধর্মতলার সমতুল্য) বুকে এক চিলতে সবুজ গেজি পার্ক। ছবিটি মে মাসের শেষ সপ্তাহের।
ছবি-২
তিরিশ বা চল্লিশের কোঠার এক পুরুষ— ঢিলেঢালা প্যান্ট-শার্ট পরে, প্যান্টের দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে নীরব নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছেন সেই তাকসিম স্কোয়ারের মধ্যিখানে আধুনিক ও নব্য তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণপুরুষ কামাল আতাতুর্কের মূর্তির দিকে তাকিয়ে। ব্যক্তিটি হলেন তুরস্কের বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী এরদেম গুনদুজ। ছবিটি জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহের।

সপ্তাহ তিনের সপ্তাহের ব্যবধানে এই দুটি ছবির অন্তর্বর্তী সময়ে গোটা তুরস্ক উথালপাথাল হয়েছে প্রতিবাদ মিছিলে। কিন্তু কীসের প্রতিবাদ? প্রথম প্রতিবাদ শুরু ইস্তানবুল-এর তাকসিমের একমাত্র সবুজ অংশ গেজি পার্ককে বাঁচানোর জন্য। নাগরিক সমাজের নানান মানুষ, ছাত্র, শিক্ষক, নগর পরিকল্পনাকারী, পরিবেশবাদী বদ্ধপরিকর ছিলেন যে, বুলডোজার দিয়ে ওই পার্কের গাছ উপড়ে, মাটি খুঁড়ে সেখানে একটি বিশালায়তন বিপণন কেন্দ্র বা শপিং মল গড়তে দেবেন না।
তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রেজেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এই প্রতিবাদীদের ‘উন্নয়ন বিরোধী’ আখ্যা দিয়ে কাঁদানে গ্যাস, জলকামান ও লাঠিধারী পুলিশবাহিনী পাঠান ওই পার্ক খালি করার জন্য। তুরস্কের সংবাদমাধ্যম হয় সরকারি চাপ বা সরকারের প্রতি আনুগত্যের কারণে পুলিশের এই চরম দমননীতির কোনও সংবাদ প্রচার না করা সত্ত্বেও আহত প্রতিবাদীদের ছবি, অকুতোভয়ে জলকামানের মুখোমুখি হওয়া প্রতিবাদীদের ভিডিয়ো ফেসবুক বা টুইটারের মাধ্যমে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আহত প্রতিবাদীদের চিকিৎসা করার জন্য শহরের নানান প্রান্ত থেকে চিকিৎসক ও নার্সরা ছুটে আসেন। জমজমাট পর্যটনকেন্দ্র তাকসিমের দোকানদার, হোটেল, বাসিন্দারা তাঁদের দরজা খুলে দেন কাঁদানে গ্যাস এড়াবার জন্য। পরদিন ভোরে লাখ মানুষের ঢল নামে বসফরাস প্রণালীর সেতুর ওপর। বয়স্ক গৃহবধূরা প্রতি সন্ধ্যায় বাড়ির ছাদে উঠে রান্নাঘরের থালা-বাসন বাজিয়ে সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে ধিক্কার জানাতে থাকেন।


গণতন্ত্রের স্বার্থে। তাকসিম স্কোয়ার, ইস্তানবুল, ২৯ জুন। ছবি: এ এফ পি
এই প্রতিবাদ রাজধানী আঙ্কারা-সহ অন্যান্য প্রধান শহরে ছড়িয়ে পড়ে এবং শেষমেশ সরকার তাকসিম থেকে পুলিশ সরিয়ে নেয়। কিন্তু দু’সপ্তাহ পরেই প্রধানমন্ত্রী এরদোয়ান শেষ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘সেই মা-দের বলছি, যাঁদের সন্তানরা প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন, তাঁরা যেন তাঁদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়ি নিয়ে যান।’ এর প্রতিক্রিয়ায় বহু মা তাকসিমে এসে প্রতিবাদকারী এবং পুলিশের মধ্যে ব্যারিকেড গড়ে তোলেন।
এরদোয়ান এবং তাঁর দল এ কে পার্টি বাস, ট্রেন ভরে গ্রামাঞ্চল থেকে তাঁদের সমর্থকদের এনে একটি বিশাল মিটিং করে ঘোষণা করেন যে, নগর উন্নয়নের যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, এবং তা সমস্ত বাধা সত্ত্বেও রূপায়িত করা হবে। একই সঙ্গে তিন সপ্তাহ বাদে রাতারাতি কাঁদানে গ্যাস, লাঠি, জলকামান দিয়ে পুলিশ তাকসিম খালি করে। এর পরেই এরদেম গুনদুজের নীরব-নিশ্চল প্রতিবাদ শুরু। এই অহিংস প্রতিবাদ এখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে।
কিন্তু শুধু কি একটি ছোট্ট পার্ক বাঁচানোর আন্দোলন গোটা দেশে এমন ছাপ ফেলতে পারে? সাধারণ বুদ্ধি বলে যে, এই দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়ানোর পিছনে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির সঙ্গী হিসেবে তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ইউরোপীয় শক্তিগুলি সেই সাম্রাজ্যকে টুকরো করে আধুনিক তুরস্কের চেহারা নির্ধারণ করে। ১৯২০-র দশকে কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে নব্য শিক্ষিত তরুণ তুর্কিরা ইউরোপীয় দখলকারীদের হটিয়ে দেশের দখল নেন এবং মুসলিমপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইসলামকে বাইরে রেখে একটি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের জন্ম দেন। এই আধুনিক সংবিধানের ভিত্তিতেই আধুনিক তুরস্কের উত্থান। আতাতুর্কের সব থেকে বড় সমর্থক ছিল দেশের নববিন্যস্ত সামরিক বাহিনী। তার পরের কয়েক দশক ধরেই ক্ষমতা ধরে রাখে এই বাহিনীই। ধর্মনিরপেক্ষতা বাঁচানোর নামে মার্কিন সাহায্যপুষ্ট এই সামরিক বাহিনী ১৯৬০ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত চার বার অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে, যার মূল কারণ ছিল প্রগতিপন্থী বাম রাজনীতির উত্থান রোখা।
এই সময়ে বাক্-স্বাধীনতা, রাজনৈতিক কার্যকলাপ বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা সব কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। আমার তুর্কি বন্ধু রাগেপ জারাকুলু ইস্তানবুল শহরের প্রবাদপ্রতিম প্রকাশক। প্রবাদপ্রতিম কেননা, রাজনৈতিক ভাবে নিষিদ্ধ বিষয়ে বই প্রকাশনার জন্য রাগেপ যে কত বার জেলে গেছেন তার হিসেব তিনি নিজেই রাখতে পারেন না। ভুলোমনা প্রফেসরের মতো দেখতে রাগেপের অফিসের দেয়ালে অন্তত দুই ডজন নিষিদ্ধ বইয়ের প্রচ্ছদ ঝুলছে। কিন্তু সত্তর বছরের রাগেপের প্রজন্ম ২০১৩ সালের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রথম সারিতে নেই। সেই জায়গা নিয়েছে তরুণ প্রজন্ম।
প্রায় পাঁচ বছর ধরে গভীর বন্ধু হয়ে ওঠা বিশের কোঠার শেষের এক তরুণী গত তিন সপ্তাহ ধরে আমাকে শুধু বলছে যে, ‘এরদোয়ান নিজেকে কী মনে করেছে? আমাদের মতামতের কোনও মূল্য সে দিচ্ছে না। একে স্বৈরাচারী ছাড়া আর কী বলা যায়।’ এই তরুণী কোনও রাজনৈতিক কর্মী নয়, কিন্তু সে ও তার প্রজন্ম একটি আধুনিক সময়ে বেড়ে উঠেছে, যেখানে তাদের কাছে ব্যক্তি-মতামত, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অতি গুরুত্বপূর্ণ।
গত পাঁচ বছর ধরে তুরস্কে, বিশেষত ইস্তানবুলে যাতায়াত করে ধারণা করতে পেরেছি যে, মুক্তমনা, স্বাধীনচেতা শিক্ষিত ও বিশ্বমুখী এই তরুণ প্রজন্ম বৃহত্তর সমাজের ওপর বড় ধরনের অভিঘাত ফেলার মতো জায়গায় আসছে। এ বারে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। এদের সঙ্গে আলোচনায় টের পেয়েছি যে, চিন্তাভাবনার জগতে তারা পৃথিবীর যে-কোনও আধুনিক সমাজের নেতৃত্ব দিতে পারে।
প্রায় চার দশকের সামরিক স্বৈরতন্ত্রের ফলে তুরস্কে গণতন্ত্রের যে ক্ষতি হয়, তার সুযোগে প্রগতিশীল শক্তির বদলে সামরিক বাহিনীর মূল বিরোধী শক্তি হয়ে প্রধানমন্ত্রী এরদোয়ানের এ কে পার্টির উত্থান হয়। মধ্যপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি বারে বারে সামরিক শাসকদের সঙ্গ দেওয়ায় তাদের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল না। এই প্রেক্ষাপটে ২০০২ সালের নির্বাচনে তুরস্কের মানুষ ঢালাও ভোট দিয়ে ‘নরমপন্থী ইসলামবাদী’ এ কে পার্টিকে নির্বাচিত করে। এরদোয়ান আবার ২০০৬ আর ২০১০-এ দলকে জেতান।
এরদোয়ানের ভাবভঙ্গি অতি কট্টর ও দর্পিত। পরপর তিনটে নির্বাচনে জয়ী হওয়ায় দম্ভ আরও বেড়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এই প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলের সঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সি পি এম-এর দম্ভের মিল খুঁজে পাবেন। তুরস্কের গণতন্ত্রপ্রেমী জনতা এই দম্ভের প্রতিবাদ করছেন।
এ কে পার্টি প্রথম ক্ষমতায় আসার পর উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিয়েছিল। তাদের ইসলামি প্রবণতা প্রথম দিকে ততটা প্রকট ছিল না। এখন কিন্তু তারা ইসলামি আইন প্রণয়ন করার ওপর জোর দিয়েছে। সরকারি অনুদানে চলা বিদ্যালয়গুলিকে ক্রমশ ধর্মীয় বিদ্যালয়ে পরিণত করা, মদ বিক্রির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ, প্রকাশ্যে পুরুষ ও নারীর ঘনিষ্ঠ আচরণ বন্ধ করার ফতোয়া জারি হয়েছে। সংসদে আইন করে গর্ভপাত নিষিদ্ধ করার চেষ্টা চলছে।
এই প্রেক্ষাপটই বলে দেয়, রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব ছাড়াই কেন গণতন্ত্রপ্রেমী ধর্মনিরপেক্ষ তুর্কি জনগণ আজ সরকারের বিরুদ্ধে অহিংস পথে রুখে দাঁড়িয়েছে। তাঁরাই হলেন দেশের প্রগতিশীল সংবিধানের রক্ষাকর্তা।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.