ইহার পর কী, এই প্রশ্নের উত্তর অধুনা পশ্চিমবঙ্গে অমিল। সর্বক্ষেত্রেই। এমনকী, যে জায়গাগুলিতে প্রশ্নটির সম্যক উত্তর করিতে পারা যে কোনও প্রশাসনের প্রাথমিক দায়িত্ব, পশ্চিমবঙ্গে সেখানেও এই প্রশ্নটির উত্তর নাই। পঞ্চায়েত নির্বাচন কবে হইবে, কী ভাবে হইবে, কেন্দ্রীয় বাহিনী লাগিবে কি না, সব প্রশ্নেরই যথার্থ উত্তর স্বাভাবিক নিয়মে পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তাহা হয় নাই, কারণ প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের সহিত দ্বৈরথে অবতীর্ণ হইয়াছে। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট ঘুরিয়া রাজ্যে সমাধান পৌঁছাইল। সেই সমাধানও শেষ পর্যন্ত কার্যকর হইবে কি না, তাহা এখনও পর্যন্ত অনিশ্চিত। এই দিশাহীনতাই বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র ছবি। কাহার দোষে এমন হইল, এই প্রশ্নের উত্তরে যে তর্জনী উঠিবে, তাহার অভিমুখ বর্তমান শাসক দল এবং তাহার প্রধান নেত্রীর দিকে। এই কারণে নহে যে পশ্চিমবঙ্গে যাহা ঘটিতেছে, সবই তাঁহারাই ঘটাইতেছেন। এই কারণে, যে, তিনিই এই রাজ্যের শাসক। একটি রাজ্যে যদি অব্যবস্থা সর্বব্যাপী হয়, তাহার জন্য বিভিন্ন পক্ষই দায়ী থাকিতে পারে, সচরাচর থাকেও— বিরোধী পক্ষ, রাজনৈতিক সমাজ, নাগরিক সমাজ, সকলেই। কাহার দায়ভাগ কত, তাহাও হয়তো তথ্যনির্ভর বিশ্লেষণে জানা সম্ভব। কিন্তু সেই দায়ের বাঁটোয়ারার হিসাব ইতিহাসের পাতায় থাকিবে না। ইতিহাস বলিবে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে পশ্চিমবঙ্গ অন্ধকারে ডুবিয়া গিয়াছিল। তাঁহার আমলে পঞ্চায়েত নির্বাচন বিষয়ক অনিশ্চয়তার জেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা কার্যত অনির্দিষ্ট কালের জন্য পিছাইয়া গিয়াছিল। ছাত্রছাত্রীরা প্রশাসনিক ব্যর্থতার শাস্তি পাইয়াছিলেন। অকারণেই। ইহাই শাসকের ভাগ্য— রাজ্যের উন্নতি হইলে সেই কৃতিত্বের সিংহভাগ যেমন তাঁহার দখলে আসে, ব্যর্থতার দায়ও মূলত তাঁহাকেই বহন করিতে হয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দৃশ্যত সেই দায় বহনে নারাজ। গত দুই বৎসরে এই রাজ্যে যখনই কিছু ভুল হইয়াছে, তিনি ‘দোষী’ খুঁজিয়া লইয়াছেন। পঞ্চায়েত নির্বাচন না হইলে তাহা রাজ্য নির্বাচন কমিশন এবং সি পি আই এম-কংগ্রেসের ষড়যন্ত্র; ধর্ষণ হইলে তাহা হয় ‘সাজানো ঘটনা’, নয়তো বিরোধীদের চক্রান্ত; রাজকোষ বেহাল হইলে তাহা পূর্বসূরিদের দায়। তিনি বুঝিতেছেন না, এই ভাবে দায় হইতে অব্যাহতি পাইবার সুযোগ ইতিহাস তাঁহাকে দিবে না। যে কোনও শাসক সম্বন্ধে মহাকালের খাতায় যাহা পড়িয়া থাকে, তাহা মূলত ধারণা। সেই শাসক সফল না ব্যর্থ, সে বিষয়ে ধারণা। রাজ্য ব্যর্থ হইলে শাসকও ব্যর্থ। পশ্চিমবঙ্গের এই অতলযাত্রায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কতখানি অবদান ছিল আর অন্যদের কতখানি, সেই হিসাব কোথাও থাকিবে না। বিপরীতে, রাজ্য যদি সফল হয়, তবে সেই সাফল্যের প্রতিফলিত আলোকে শাসকও আলোকিত হন। দুইটি সাম্প্রতিক উদাহরণ স্মর্তব্য। প্রথমটি বিহারে নীতীশ কুমারের সাফল্য, দ্বিতীয়টি গুজরাতে নরেন্দ্র মোদীর। বিশেষত দ্বিতীয়টি, কারণ গুজরাত চিরকালই আর্থিক ভাবে উন্নত রাজ্য। তবুও, নরেন্দ্র মোদী, তাঁহার প্রশাসনিক তৎপরতা এবং বাস্তবোচিত বুদ্ধির কারণেই, ‘উন্নয়নের ভগীরথ’ হিসাবে স্বীকৃতি পাইতেছেন। মমতাদেবীর সম্মুখে দুইটি পথ: হয় তিনি উদ্যোগী হইয়া পশ্চিমবঙ্গের রাশ ধরুন, নয় ‘ব্যর্থ’ তকমাটি মানিয়া লউন।
অথচ, ইতিহাস তাঁহার জন্য বরণডালা লইয়া অপেক্ষায় ছিল। তিনি যে বামপন্থীদের হাত হইতে এই রাজ্যটি ছিনাইয়া লইয়াছিলেন, তাঁহাদের শাসনের চৌত্রিশ বৎসর মূলত ব্যর্থতার ইতিহাস হিসাবেই স্বীকৃত। মমতাদেবী বলিয়াছিলেন, তিনি বদলা চাহেন না, বদল চাহেন। সেই বদল আনিতে পারিলে সাফল্যের ইতিহাসে তাঁহার আসনলাভ ঠেকাইত কে? কিন্তু তিনি সেই পথে হাঁটিলেন না। তিনি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শিল্পায়নের পথের বিরোধী ছিলেন। ক্ষমতায় আসিয়া তিনি শিল্পায়নের বিকল্প পথের সন্ধান দিতে পারিতেন। সর্বজনীন প্রশাসনের উদাহরণ তৈরি করিতে পারিতেন। এই সব কিছুই তিনি করেন নাই। তাহার পরিবর্তে নিজের সাফল্যের ফিরিস্তি শুনাইয়াছেন, ব্যর্থতার দায় অন্যের দিকে ঠেলিয়াছেন। তাহাতে ভোটের বাক্সে কী সুবিধা হইবে, তিনিই জানেন। ইতিহাস তাঁহার প্রতি সদয় হইবে না। |