শহরের বিপর্যস্ত ট্রাফিক ব্যবস্থায়, একে যানজটে নাজেহাল বাসিন্দারা। আবার নজরদারির অভাবের সুযোগে বাড়ছে বেপরোয়া যান চলাচল। ফলে, শহরে সড়ক দুর্ঘটনা নিত্য দিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবিলম্বে পুলিশ-প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তুলেছেন বোলপুর শহরের সব স্তরের মানুষ। জেলার আর পাঁচটা শহরের মতো এখানেও জনসংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানবাহানের সংখ্যাও। কিন্তু ট্রাফিক ব্যবস্থা সেই পুরনো আমলের। সকালবেলা ঘণ্টা দু’য়েক ও সন্ধ্যার সময় দু-ঘণ্টার কিছু কম শহরের দু’টি মুখ্য মোড়ে থাকেন বড়জোর দুই পুলিশকর্মী। কোনও কোনও সময় দুই এনভিএফ কর্মী জোড়াতালি দিয়ে সামলান শহরের ট্রাফিক। |
যানজটে আটকে পড়েছে দমকলের গাড়িও। বোলপুর শহরে তোলা নিজস্ব চিত্র। |
বাসিন্দারা জানান, বোলপুর-শান্তিনিকেতন এলাকায় বেপরোয়া যান চলাচল ক্রমশ বাড়ছে। বোলপুর স্টেশন রোড় থেকে শ্রীনিকেতন ও শান্তিনিকেতন যাওয়ার পথে নিত্য যানজট থাকে স্টেশনমোড়, চৌরাস্তামোড়, চিত্রামোড়, ট্যুরিস্ট লজমোড়-সহ শহরের সঙ্গে অন্য জেলার যোগাযোগের রাস্তায়। ফলে, শহরের মধ্যে থাকা একাধিক স্কুল, কলেজ, নানা সরকারি ও বেসরকারি দফতরে যেতে নানা দুর্ভোগ পোহানোর পাশাপাশি অনেক বেগ পেতে হয় বাসিন্দাদের। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া থেকে নানা দফতর ও আদালতের কর্মীরা সাধারণত কাজের দিনগুলিতে নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন ওই যানজটে। তা ছাড়াও, এলাকার ওপর দিয়ে যাওয়া বেশ কিছু ট্রেন যেমন শান্তিনিকেতন সুপারফার্স্ট, আজিমগঞ্জ গণদেবতা এক্সপ্রেস, ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস, বিশ্বভারতী ফার্স্ট পাসেঞ্জার-সহ একাধিক ট্রেনের আসা ও যাওয়ার সময় যানজটে নাকাল হন বাসিন্দারা। সেই সঙ্গে বেপরোয়া যান চলাচল সমস্যায় ফেলেছে বাসিন্দাদের। কোথাও স্কুল ভ্যানে বাসের ধাক্কা, কোথাও আবার ট্রাক পিষে দিছে পডুয়াকে। ফুটপাথ বেআইনি দখলের ফলে পথচারীদের হাঁটার পথ নেই। যানজট ও বেপরোয়া যান চলাচলে বাসিন্দাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রাণ।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, গত সপ্তাহে বোলপুর-শ্রীনিকেতন রাস্তায় মোটরবাইক চালিয়ে যাওয়ার সময় জামবুনি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বিশ্বভারতীর এক গবেষিকা ছাত্রীকে ধাক্কা মারে ট্রাক। সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর ওই গবেষিকা বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে মারা যান রাতে। দিন দু’য়েক আগে, বোলপুরের কর্ম বিনিয়োগকেন্দ্র সংলগ্ন রাস্তা থেকে শ্রীনিকেতন রাস্তায় ওঠার সময় এলাকার একটি বেসরকারী স্কুলের ভ্যান রিকশাকে ধাক্কা মারে একটি বাস। গুরুতর জখম হন পডুয়া ও ভ্যানচালক। কয়েক দিন আগে ওই শ্রীনিকেতন রাস্তায় প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের দাদা পীযূষবাবু। শান্তিনিকেতন এলাকার একটি পশুপ্রেমী সংগঠনের মুখ্য ঊর্মিলা গঙ্গোপাধ্যায় জানান, শান্তিনিকেতন এলাকায় ব্যাপকহারে বেপরোয়া যান চলাচল বেড়েছে। শিক্ষাভবনের সামনের রাস্তায় মাস খানেক আগে এক বড়সড় দুর্ঘটনা থেকে কোনও মতে রক্ষা পান তিনি।
বোলপুরের প্রাক্তন পুরপ্রধান, কংগ্রেসের তপনকুমার সাহা বলেন, “পরিকল্পনা মাফিক শহরের যানজট অবিলম্বে দূর করা খুব জরুরি। নজরদারির অভাবে বেপরোয়া যান চলাচল শহরের মধ্যে খুব বেড়েছে। শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে সামনে রেখে, পুর-কর্তৃপক্ষের নাগরিক পরিষেবা ও পুর-উন্নয়ন কর্মসূচি নেওয়া খুব জরুরি। পুলিশ প্রশাসনের পাশাপাশি এই সমস্যা রোধে পুর-কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে।” তাঁর দাবি, “পুর-কর্তৃপক্ষের কোথাও একটা সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। এবং সংশ্লিষ্ট সকল স্তরের সঙ্গে রয়েছে সমন্বয়ের অভাবও।” বেশ কয়েকদিন আগে যানজট ও বেপরোয়া যান চলাচলের প্রতিবাদে বিরোধীরা পুরপ্রধানকে স্মারকলিপি দিয়েছিলেন। বোলপুর পুরসভার বিরোধী দলনেতা তথা বোলপুর ব্লক কংগ্রেসের সভাপতি মহম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, “সাধারণ মানুষ যানজটে নাকাল হছেন। শহরে দুর্ঘটনা নিত্য বিষয়। তাই সংগঠনের পক্ষ থেকে সমস্যা সমাধানের আর্জি জানিয়েছিলাম। পুরপ্রধান শীঘ্রই ব্যবস্থার কথা জানিয়ে ছিলেন। সেই মতো কিছুদিন নজরদারি ও যান চলাচলের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল শহরে। কিন্তু সেই সমস্যা ফের মাথাচাড়া দিছে।”
যদিও শহরের ট্রাফিক ব্যাবস্থা বিপর্যস্ত ও বেপরোয়া যান চলাচলের ওপর নজরদারির অভাব থাকার অভিযোগ মানতে চাননি বোলপুরের এসডিপিও প্রশান্ত চৌধুরী। তিনি বলেন, “শহরের ব্যাস্ততম জায়গা ও প্রয়োজনীয় মোড়ে মোড়ে নজরদারি-সহ ট্রাফিক ব্যাবস্থা রয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে শহরে ভারী যান চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তবে জনসাধারণকে আরও সচেতন হয়ে সহায়তা করতে এগিয়ে আসতে হবে। বেশ কিছু পরিকল্পনা রয়েছে, যা সব স্তরে আলোচনা করে কার্যকর করতে হবে।” পুরপ্রধান সুশান্ত ভকতও বলেন, “যানজটে নাকাল, বিপর্যস্ত ট্রাফিক ব্যবস্থার অভিযোগ সঠিক নয়। বাসিন্দাদের প্রয়োজনীয় পুর-পরিষেবাও আমরা দিচ্ছি। শহরকে যানজট মুক্ত করতে পুলিশের ট্রাফিক ব্যাবস্থার পাশাপাশি আমাদের তরফ থেকে সহায়তা করা হচ্ছে। পুলিশ-প্রশাসন ও পুরসভার উদ্যোগে শহরে ভারী যান চলাচল ওপর নির্দিষ্ট সময় ছাড়া ‘নো-এন্ট্রি’ ব্যবস্থা চালু আছে।” বেপরোয়া যান চলাচলের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে দ্রুত আলোচনা করা হবে বলে আশ্বাস সুশান্তবাবুর।
পুরপ্রধান যাই বালুন না কেন? বাস্তব চিত্র অন্য কথা বলছে। প্রাথমিক ভাবে শহরের বিভিন্ন মোড়ে ‘নো-এন্ট্রি’ বিষয়ে কোনও সুনির্দিষ্ট বোর্ড নেই। বাসিন্দাদের প্রশ্ন, পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় বাড়ালে, ওই কর্মীদের পাশাপাশি পুর-কর্মীদের দিয়ে অন্যান্য জায়গায় যানজট ও বেপরোয়া যান চলাচলের ওপর নজরদারি ব্যাবস্থা আরও কড়াকড়ি হত? বাস্তবে তা হয়নি। বোলপুরের মহকুমাশাসক প্রবালকান্তি মাইতি বলেন, “পঞ্চায়েত নির্বাচন শেষ হলে, সংশ্লিষ্ট সব স্তরের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” |