হৃদরোগে নির্দেশিকা চান ডাক্তাররা
অ্যাঞ্জিওগ্রাম শেষ হওয়ার আগেই অপারেশন থিয়েটার থেকে মুখ বাড়িয়ে ডাক্তারবাবু রোগীর বাড়ির লোককে বললেন, “অনেকগুলো ব্লক রয়েছে। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করতে হবে। এখন করাবেন, না পরে? দেরি হলে সমস্যা বাড়বে।”
চিকিৎসাবিদ্যার বিন্দুবিসর্গ না জানা বাড়ির লোকেরা তখন বিভ্রান্ত। দেরি হলে বিপদ হতে পারে, এটাই মাথায় ঘুরছে। বহু ক্ষেত্রে তখনই তাঁরা ডাক্তারবাবুকে বলে দেন, “আপনি যা ভাল বুঝবেন তাই করুন।”
অতঃপর তড়িঘড়ি অ্যাঞ্জিওপ্ল্যাস্টিই হয়। জানা যায় না, অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি নাকি বাইপাস সার্জারি, সংশ্লিষ্ট রোগীর ক্ষেত্রে কোনটা জরুরি ছিল। শুধু ওষুধেই চিকিৎসা চালানো যেত কি না স্পষ্ট হয় না সে কথাও।
হৃদ্রোগের চিকিৎসা নিয়ে এমন বিভ্রান্তি নতুন নয়। প্রয়োজন ছাড়াই কখনও অ্যাঞ্জিওপ্ল্যাস্টি, আবার কখনও বাইপাস সার্জারির অভিযোগ উঠছে। এতে বিভ্রান্তি বাড়ছে, অবিশ্বাসও বাড়ছে চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্কে। চিকিৎসকদের একটা বড় অংশই মানছেন, বহু ক্ষেত্রে যেমন অস্ত্রোপচার অনিবার্য, তেমনই প্রয়োজন ছাড়াই বা অন্য বিকল্পের কথা না ভেবেই অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি বা বাইপাস সার্জারির নিদান হাঁকা হয় অনেক সময়ে। এই পরিস্থিতিতে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখতেই তাঁরা চান, অবিলম্বে হৃদ রোগের চিকিৎসার ‘স্ট্যান্ডার্ড গাইডলাইন’ তৈরি হোক।
কিন্তু প্রশ্ন, নির্দেশিকা তৈরি হলেও চিকিৎসকদের তা মানতে বাধ্য করা যাবে কী ভাবে? এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক সংগঠনগুলির হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করছেন তাঁরা। তাঁদের বক্তব্য, গাইডলাইন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হলে তাঁরাও নির্দেশিকা মানতে চিকিৎসকদের পরোক্ষ ভাবে চাপ দিতে পারবেন।
হৃদ্রোগের চিকিৎসার ‘স্ট্যান্ডার্ড ট্রিটমেন্ট গাইডলাইন’ নতুন নয়। ২০১০ থেকেই আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, জাপানে হৃদরোগ চিকিৎসার নির্দেশিকা অনুসরণ করা হচ্ছে। কিন্তু এ দেশে কিছুই নেই। বিশেষজ্ঞরা মানছেন, এখানে চিকিৎসা প্রায় পুরোটাই নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের মর্জির উপরে। চিকিৎসার ফল ভাল হলে সমস্যা হয় না, আর না হলেই রোগীর তরফে অভিযোগ, আদালত, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি। অথচ সাফ সাফ নির্দেশিকা থাকলে কোন ক্ষেত্রে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি প্রয়োজন, কোন ক্ষেত্রে বাইপাস সার্জারি, তা নিয়ে বিভ্রান্তি থাকে না।
বেসরকারি হাসপাতালে বাইপাস সার্জারির খরচ প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। আর অ্যাঞ্জিওপ্ল্যাস্টির ক্ষেত্রে একটি স্টেন্ট বসাতেই লাগে কম-বেশি দেড় লাখ টাকা। সরকারি হাসপাতালে খরচ কিছুটা কম। কিন্তু সব মিলিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ জড়িত থাকায় এ নিয়ে প্রায় সর্বত্রই অসাধু চক্রের রমরমা বাড়ছে বলে অভিযোগ।
কার্ডিওলজিস্ট অজিতকুমার মাইতির কথায়, “নির্দেশিকা বলে এখানে কিছুই নেই। একটি রক্তনালীতে ব্লক হলে স্টেন্ট বসানো হয়। আর দু’টি বা তার বেশি রক্তিনালী ব্লক বা রোগীর ডায়াবিটিস থাকলে বাইপাস সার্জারি শুধু এটুকু হয়তো মানা হয়।”
কার্ডিও থোরাসিক সার্জন কুণাল সরকার বলেন, “গত ২০ বছরে হার্টের চিকিৎসার অনেক নতুন দিক সামনে এসেছে, এটা ঠিক। কিন্তু তা প্রায়শই হচ্ছে খাপছাড়া ভাবে, তাৎক্ষণিক ভিত্তিতে। অভিযোগ, এ দেশে যত অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হয় তার এক তৃতীয়াংশই নিয়ম মেনে হয় না। ফলে ক্লিনিক্যাল, মেডিকো-লিগাল, আর্থিক সব ধরনের সমস্যাই হয়।”
কার্ডিওলজিস্ট বিশ্বকেশ মজুমদারের কথায়, “অনেক রোগের ক্ষেত্রে ইদানিং নির্দেশিকা মানা হচ্ছে। কিন্তু হার্টের চিকিৎসায় তার বালাই নেই। বহু ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনে স্টেন্ট বসছে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে তৈরি হচ্ছে স্টেন্ট-চক্র। বাইপাসের পরিকাঠামো ছাড়াও বাইপাস করা হচ্ছে, রোগী মারাও যাচ্ছেন। নির্দেশিকা থাকলে এ সব এড়ানো যেত। যেখানে স্টেন্ট বসানোর দরকার নেই, সেখানেও লক্ষাধিক টাকা খরচ করে স্টেন্ট বসানো হত না।”
কুণালবাবুর কথায়, “কোন ব্যথায় কী মাত্রার ওষুধ দেওয়া হবে, বা স্তন ক্যানসারে কী ধরনের কেমোথেরাপি দেওয়া হবে, সেটা তো এক এক জন এক এক রকম ভাবতে পারেন না। একটা নিয়ম মানতেই হয়। হার্টের চিকিৎসায় কেন তা থাকবে না?”
কার্ডিও থোরাসিক সার্জন সত্যজিৎ বসু মনে করেন, এটা একটা সামাজিক সমস্যা। তাই সচেতনতা বাড়ানোটা সব চেয়ে জরুরি। তিনি বলেন, “কোন চিকিৎসাটা দরকার, সেটা তো রোগী বোঝেন না, বোঝেন ডাক্তার। রোগীর বিশ্বাসের মর্যাদাটা তাঁর দেওয়া উচিত। এমন বহু ঘটনা জানি, যেখানে ওষুধেই হয়তো রোগী ভাল থাকবেন, সেখানে তাঁকে তড়িঘড়ি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করতে বলা হয়েছে। এটা অনৈতিক।” যে দেশে হার্টের অসুখ বা ডায়াবিটিস মহামারীর আকার নিচ্ছে, সেখানে সেই চিকিৎসার গাইডলাইন খুবই জরুরি বলে মনে করেন সত্যজিৎবাবু।
হৃদরোগী অনুপ মল্লিকের অভিজ্ঞতা, “এক ডাক্তারবাবু বলেছিলেন প্রধান ধমনীতে ৭৬ % ব্লক, অবিলম্বে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করতে হবে। টাকা ছিল না, তাই দ্বিতীয় এক ডাক্তারবাবুর কাছে গেলাম। তিনি বললেন, অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির প্রয়োজন নেই, ওষুধেই হবে। দিব্যি সুস্থ আছি গত ছ’মাস।” হৃদরোগী স্বপ্না সরকার বলেন, “একটা ভেসেলে ব্লক থাকার পরেও ডাক্তারবাবু বাইপাস সার্জারি করেছিলেন। পরে জেনেছি, স্টেন্ট বসিয়েই দিব্যি চলে যেত।”
কার্ডিওলজিস্ট ও কার্ডিও থোরাসিক সার্জনদের সংগঠনগুলির সম্মেলনে খাপছাড়া ভাবে এই সব প্রসঙ্গ হয়তো ওঠে, কিন্তু পরে সবটাই ধামাচাপা পড়ে যায়। তবে সংগঠনের কর্তারা মনে করেন, এখনই গবেষণা করে তড়িঘড়ি কোনও পৃথক নির্দেশিকা খাড়া করা হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু আন্তর্জাতিক স্তরে যা চালু রয়েছে, সেটাই অনুসরণ শুরু করা যেতে পারে। তাতে যেমন রোগীর স্বার্থ রক্ষা হবে, কার্ডিওলজিস্ট-কার্ডিও থোরাসিক সার্জনদের বৈরিতাও হয়তো কমবে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.