মশারির ভিতর থেকে দৃশ্যটা দেখে চমকে উঠেছিলেন বিষ্ণুপুরের তুঁতবাড়ি এলাকার মানিক মহাপাত্র। সারা রাত ধরে অঝোর বৃষ্টিতে জমা জলে তখন তাঁর ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়েছে। পড়িমড়ি করি তিনি বাড়ির সবাইকে নিয়ে পাশের বাড়ির ছাদে উঠে পড়েন। বলছিলেন, “জলের চাপে দেওয়াল ভেঙে পড়ার ভয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম।” মানিকবাবুর বাড়ি রক্ষা পেলেও তাঁর পড়শি ভুজঙ্গ শর্মা ও অনঙ্গ শর্মাদের বাড়ির একাংশ এ দিন সকালে ভেঙে পড়ে।
নদী ও মাঠ ছাপিয়ে জল ঢুকে পড়ে বাঁকুড়া ও সোনামুখী পুরসভারও বিভিন্ন এলাকায়। বাঁকুড়ার লোকপুরে জলমগ্ন এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে বাসিন্দাদের ক্ষোভের মুখে পড়েন পুরপ্রধান শম্পা দরিপা। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপুর শহরে দু’টি ত্রাণ শিবির খোলা হয়। জেলা আবহাওয়া দফতর সূত্রে খবর, শনিবার বিকেল থেকে ২৪ ঘণ্টায় বাঁকুড়া শহরে ২২৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। বিষ্ণুপুর মহকুমা এলাকায় প্রায় ২০০০ কাঁচা বাড়ি ভেঙে পড়ে। বাঁকুড়ার জেলাশাসক বিজয় ভারতী বলেন, “জেলার কিছু এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। আমরা সেই সমস্ত এলাকায় ত্রাণ পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি।” |
শনিবার রাত থেকে বাঁকুড়া জেলাজুড়ে নাগাড়ে বৃষ্টি হয়। চলে রবিবার বেলা পর্যন্ত। নদ-নদীগুলির নাব্যতা কমে যাওয়ায় শালি, গন্ধেশ্বরী, বিড়াই প্রভৃতি নদী উপচে জল ঢুকে পড়ে বসতি এলাকায়। মাঠ ওপচানো জল ভাসিয়ে দেয় বিষ্ণুপুরের যমুনাবাঁধ। সেই জল ঢুকে পড়ে ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের তুঁতবাড়ি এলাকার স্টেশন রোডের কয়েকটি বাড়িতে। ওই এলাকার বাসিন্দা ভুজঙ্গ শর্মা ও অনঙ্গ শর্মা বলেন, “ঘরের ভিতরে জল ঢোকার শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। সবাইকে নিয়ে বাড়ির বাইরে রাস্তায় বেরিয়ে আসি। তারপরেই দেখি বাড়ির একাংশ ভেঙে পড়ল।”
জলমগ্ন হয়ে পড়ে বিষ্ণুপুরের গুয়েনালা, ঝাপড়মোড়, হাড়িপাড়ার মতো নীচু এলাকাগুলিও। সন্ধ্যাতেও কোনও কোনও এলাকা থেকে জল নামেনি। বিষ্ণুপুরের উপপুরপ্রধান বুদ্ধদেব মুখোপাধ্যায় বলেন, “খেমকা হাইস্কুলে একটি ত্রাণশিবির খোলা হয়েছে। ১৯৭৮ সালের পরে এত বৃষ্টি হয়নি। তাই প্রথমে কিছুটা সমস্যা হলেও, পরে জল নামতে থাকায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে।” |
বাঁকুড়া শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের হাড়িপাড়া ও ময়রাবাঁধ এলাকার বহু বাড়িতেও জল ঢুকে যায়। পুরসভা ওই ওয়ার্ডের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ত্রাণ শিবির খোলে। জলমগ্ন হয়ে পড়ে সার্কাস ময়দান, লোকপুর, সিনেমারোড-সহ শহরের বেশ কিছু এলাকা। পুরপ্রধান শম্পাদেবী বলেন, “বাঁকুড়া পুরসভার ৪, ৫, ১১ ও ১৫ নম্বর ওয়ার্ড জলমগ্ন হয়ে পড়ে। ৪ নম্বরে আমরা একটি ত্রাণশিবির খুলেছি। ১১ নম্বর ওয়ার্ডে দমকল কর্মীরা পাম্প চালিয়ে জল বের করে দেন।” একই জল-ছবি সোনামুখী শহরেও। এখানকার ১, ৩, ৮, ৯ ও ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে জল জমে যায়। সোনামুখী শহর লাগোয়া শালি নদীর কজওয়েতে এ দিন সন্ধ্যায় জল উঠে দুর্গাপুরের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পুরপ্রধান কুশল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “প্রায় ১১টি কাঁচা বাড়ি ভেঙেছে।”
বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন গ্রামও জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। বিড়াই নদীর জল ঢুকে পড়ে লাগোয়া শ্যামসুন্দরপুর, বেলাড়া, দ্বারিকার মতো গ্রামগুলিতে। কানা নদী উপচে জল ঢুকে পড়ে বিষ্ণুপুরের ভাটরা, জয়কৃষ্ণপুরে। জলমগ্ন হয়ে পড়ে ওন্দার সাহাপুর, নিকুঞ্জপুর, বিক্রমপুর, বাঁকুড়া ২ ব্লকের চন্দ্রহাটি, খেমুয়া, কোষ্টিয়া, শিশাড়া, মুকুন্দপুর।
বিষ্ণুপুরের বাঁকাদহের চেকপোস্ট এলাকায় বিষ্ণুপুর-গড়বেতা ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের উপর দিয়ে তীব্র স্ত্রোতে জল বইতে থাকে। ফলে এ দিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ওই রাস্তা দিয়ে যান চলাচল বন্ধ থাকে। বিড়াই নদীর জল উঠে যাওয়ায় দ্বারিকার কাছে, সোনামুখী-বিষ্ণুপুর রাস্তাতেও এ দিন যাতায়াত বন্ধ ছিল। ফি বছর বর্ষায় ফুলে ওঠা গন্ধেশ্বরী নদীর জল উঠে পড়ত বাঁকুড়া শহরের সতীঘাটের কজওয়েতে। বন্ধ হয়ে যেত চলাচল। বাসিন্দাদের দাবি মেনে সম্প্রতি সেই কজওয়ে বেশ কয়েক ফুট উঁচু করা হয়। কিন্তু এ বার এক দিনের বৃষ্টিতেও সেই সেতু উপচে গেল নদীর জল। |