সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরে ২৪ ঘণ্টাও কাটেনি। এর মধ্যেই রমজান মাস থেকে ভোট সরানোর আর্জি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের উচ্চতর বেঞ্চে যাওয়ার ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে তৃণমূল। শনিবার সাংবাদিক বৈঠক করে দলের পক্ষে সে কথা জানানোও হয়েছে। যে ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ভোট নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছে, সেটাই তাঁরা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবেন। সংখ্যালঘু ভাবাবেগ জড়িত থাকায় বিরোধীরা সরাসরি তৃণমূলের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু এই পরিস্থিতির জন্য বর্তমান সরকারকেই দায়ী করেছেন সকলে।
সুপ্রিম কোর্টের নতুন নির্দেশে পঞ্চায়েত ভোটগ্রহণ শুরু হচ্ছে ১১ জুলাই। তত দিনে রমজান মাস শুরু হয়ে যাবে। শুক্রবার শীর্ষ আদালতে এই প্রসঙ্গটি উঠেছিল বলেও দাবি তৃণমূলের তরফে। তোলা হয়েছিল ১০ জুলাই রথযাত্রার প্রসঙ্গও। দুই বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ রথযাত্রার জন্য ভোটগ্রহণ এক দিন পিছিয়ে দিলেও রমজানের ক্ষেত্রে প্রশ্ন তুলে জানিয়েছিলেন, ভোট এত দিন পিছিয়ে গেলে তো প্রায় সব পঞ্চায়েতের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে এবং সাংবিধানিক সঙ্কট দেখা দেবে। তার কী হবে? সেই যুক্তিতেই শেষ পর্যন্ত ১১ থেকে ২৫ জুলাই পাঁচ পর্বে ভোটের দিনক্ষণ ও জেলাবিন্যাসের কথা ঘোষণা করে শীর্ষ আদালত। এবং এই রায়ের সূত্র ধরেই যাবতীয় প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন।
তার মধ্যেই রমজান মাসের প্রসঙ্গ তুলে ফের আদালতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। কেন? বিভিন্ন রাজনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, সংখ্যালঘুদের নানা সংগঠন ওই মাসে ভোট নিয়ে ইতিমধ্যেই আপত্তি তুলতে শুরু করেছে। কেউ কেউ পথে নেমে প্রতিবাদ জানাবে বলেও ঠিক করেছে। এই আপত্তির কথা জেনেই শনিবার বিকেলে তড়িঘড়ি সাংবাদিক বৈঠকের সিদ্ধান্ত। সেখানে তৃণমূলের আইনজীবী সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম জানান, রমজানের সময়ে ভোট না করার জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানানোর ব্যাপারে তাঁরা চিন্তা-ভাবনা করেছেন। কল্যাণবাবু বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ দফায় ভোট করার নির্দেশকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকেই আমাদের কাছে আবেদন করেছেন, রমজান মাসের আগে ভোট করা হোক।” সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন জানানো নিয়ে এ দিন তপসিয়ায় তৃণমূল ভবনে আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের সঙ্গে দলীয় নেতৃত্ব একপ্রস্ত আলোচনাও করেন। তৃণমূল অন্দরের খবর, আগামিকাল, সোমবারই রাজ্য সরকারের তরফে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানানো হতে পারে। |
কল্যাণবাবু জানিয়েছেন, আগামী ৯ জুলাইয়ের আগেই ভোট পর্ব মেটানোর জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদনের কথা ভাবছেন তাঁরা।
তিনি বলেন, “রাজ্যে প্রায় ৪৫ হাজার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রার্থী আছেন। রমজানের সময়ে ভোট হলে ওঁদের অসুবিধা হবে।” তাঁর কথার সূত্র ধরে পুরমন্ত্রী বলেন, “আমরা সর্বধর্মকে সম্মান দিই। আমরা মানুষের অসুবিধা করে কোনও কিছু করার বিরোধী।” তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়েরও বক্তব্য, “ভোট গ্রহণের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ। ৯ জুলাইয়ের মধ্যে ভোট-পর্ব শেষ না হওয়ার কোনও কারণ নেই।”
পরে মীরা পাণ্ডেকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচনের দিন ঠিক করে দিয়েছে।” একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “রোজার সময় তো অফিস-আদালত খোলা থাকে। এর বেশি আমি কোনও মন্তব্য করব না। তবে বলতে পারি, অনিদির্র্ষ্ট কালের জন্য তো পঞ্চায়েত ভোট পিছিয়ে দেওয়া যায় না।” এই প্রসঙ্গে তৃণমূল নেতারা যা বলছেন, তার প্রেক্ষিতে মীরাদেবীর বক্তব্য, “অন্য কারও বক্তব্য নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না। যা ঘটেছে, শুধু তা নিয়েই বলতে পারব। যে হেতু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এই নির্বাচন হচ্ছে, তাই ভোটের দিনক্ষণ বদলের কোনও ক্ষমতা কমিশনের নেই।”
ভোট চলার সময় যে সব সংখ্যালঘু ভোটকর্মী রোজা করবেন, রোজা ভাঙার সময় কিছুক্ষণের তাঁদের ছুটি দেওয়া হবে কি? মীরাদেবী বলেন, “ভোট চলার সময় কোনও রকম বিরতি দেওয়া যায় না।” তিনি জানান, বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত যাঁরা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকবেন, তাঁরা সবাই ভোট দিতে পারবেন। কমিশনের অন্য একটি সূত্র বলেছে, নির্বাচন প্রক্রিয়া চলার সময় রাজ্য সরকারের ছুটি সংক্রান্ত সব আইন কার্যকর না করার সম্ভাবনাও রয়েছে। বিশেষ করে ভোট দান পর্ব চলার সময় সরকার-নির্দিষ্ট ছুটি কমিশনকে দিতেই হবে, এমন বাধ্যবাধকতা নেই কমিশনের।
বিরোধী দলগুলির অভিযোগ, শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টে রায়ের সময়ে কিন্তু রাজ্য সরকার চুপ ছিল। এখন সংখ্যালঘুদের ভাবাবেগে আঘাত লাগতে পারে, এই ভয়ে তোড়জোড় শুরু করেছে। তৃণমূল নেতৃত্বের উপরে চাপ বাড়িয়ে রবিবার দুপুরে বিড়লা তারামণ্ডল থেকে কমিশনের দফতরে মিছিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংখ্যালঘুদের একটি সংগঠন। এআইইউডিএফের নেতা সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী শনিবার দলের কর্মিসভায় জানিয়েছেন, রমজান মাসে ভোট না করে এক মাস পিছিয়ে দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের উচ্চতর বেঞ্চে তাঁরা আবেদন করবেন।
এই পরিস্থিতিতে পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে নতুন জটের আশঙ্কা করছে বিরোধী শিবির। এবং সে জন্য তারা যাবতীয় দায় চাপিয়েছে শাসক তৃণমূলের উপরেই। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন আলিমুদ্দিনে বলেন, “আমাদের প্রতিনিধি আগেই সর্বদল বৈঠকে রথযাত্রা এবং রমজানের কথা তুলেছিলেন। কিন্তু তখন ওরা গুরুত্ব দেয়নি। শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টে ওদের আইনজীবীরাও রমজান মাসে ভোটের ব্যাপারে কোনও আপত্তি জানাননি। কিন্তু এখন ওঁরা সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার কথা ভাবছেন!” তাঁর বক্তব্য, “ঠিক সময়ে পঞ্চায়েত ভোট না করে এ ভাবে রমজান মাস পর্যন্ত ভোট টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য তো দায়ী রাজ্য সরকারই।” সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুও এক বিবৃৃতিতে বলেছেন, “এই নির্বাচনের বর্তমান সময়সূচির জন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়-সহ সমগ্র জনগণের যে অসুবিধা হবে, তার জন্য বর্তমান তৃণমূল সরকারই একমাত্র দায়ী।”
তবে শেষমেশ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মানার উপরেই জোর দিয়েছেন সূর্যবাবু। তাঁর প্রশ্ন, “এখন আবার ভোট পিছোনোর কথা আসছে কেন? সুপ্রিম কোর্ট সব ফয়সলা করে দিয়েছে।”
কংগ্রেস অবশ্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুবিধার কথা বিবেচনা করে ভোটের তারিখ পুনর্বিবেচনার জন্য নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ জানাবে। এ দিন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “সংখ্যালঘু ভাই-বোনদের সঙ্গে যাতে কোনও ভুল বোঝাবুঝি না হয়, তার পথ তৈরির অনুরোধ করব কমিশনকে।” সে জন্য সংখ্যালঘু সংগঠনগুলির সঙ্গে কথা বলতে কমিশনকে পরামর্শও দিয়েছেন তিনি। বিষয়টি আগামী মঙ্গলবার কমিশনের ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকেও তাঁরা তুলবেন বলে জানিয়েছেন প্রদীপবাবু। রমজান মাসে ভোটের বিরোধিতা করে তৃণমূলের কোর্টে যাওয়ার ভাবনাচিন্তাকে তীব্র সমালোচনা করেছে বিজেপিও। দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের বক্তব্য, “আশানুরূপ ফল হবে না আশঙ্কা করেই তৃণমূলের এই অপপ্রয়াস।” একই সঙ্গে রাহুলবাবুর বক্তব্য, “মুসলিমরা রমজান মাসে চাকরি, ব্যবসা-সহ সমস্ত কাজ করেন।
সুতরাং, ভোটও দিতে পারবেন বলে আশা করি।” |